ছাত্রীকে বিয়ে করতে স্কুল সভাপতির কাণ্ড!

ছাত্রীকে বিয়ে করতে স্কুল সভাপতির কাণ্ড!

নাসিম উদ্দীন • নাটোর প্রতিনিধি

বয়স তার মাত্র ২৪ বছর। এই বয়সেই স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি তিনি। এর আগেও এক মেয়াদে একই পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। সাথে ছাতনী ইউপি যুবলীগের সদস্যও বটে।

 

কম বয়সী এই মানুষটি এখন নাটোরে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তাকে নিয়ে আলোচনার জল গড়িয়েছে জেলা প্রশাসন পর্যন্ত। এক ছাত্রীকে কেন্দ্র করে তার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড যারপরনাই বিব্রত করছে সবাইকে।

নাটোর সদর উপজেলার তেলকুপি মদনহাটস্থ তেলকুপি উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি জালাল মণ্ডল ওই স্কুলের এক ছাত্রীকে বিয়ে করতে উঠেপড়ে লেগেছেন।

মেয়েটির নাম মিষ্টি খাতুন। সে ওই স্কুলের নামের দশম শ্রেণির মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী।

মিষ্টিকে বউ বানাতে স্কুলটির সহকারী প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে অন্যান্য সহকারী শিক্ষকদের জোরপূর্ব ছাত্রীটির বাড়ি গিয়ে প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য করেন জালাল মণ্ডল। স্কুলের শিক্ষক আব্দুস সালাম, ইসরাইল হোসেন, আমিনুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষককে আইসিটি শিক্ষক আফরোজা খাতুনের মাধ্যমে ওই ছাত্রীর বাড়িতে যেতে বাধ্য করা হয়।  

এর আগে ক্ষমতার জোরে জালাল ওই ছাত্রীর জন্য বিদ্যালয়ের স্টাফরুম একটি জীর্ণ কক্ষে স্থানান্তর করেন। প্রতিবাদ করলে প্রধান শিক্ষক কামাল সরকারকে জুতা তুলে মারতে উদ্যত হন। এছাড়াও রেজুলেশন ছাড়া চেক কেটে টাকা উত্তোলন এবং হিসাবের ভাউচার দাখিল না করার মতোও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে সভাপতি জালালের বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি তেলকুপি উচ্চ বিদ্যালয়ে জেলা শিক্ষা অফিসার রমজান আলী আকন্দের উপস্থিতিতে জালালের বিরুদ্ধে উপর্যুপরি অভিযোগ করেন স্কুলটির শিক্ষক, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসী। দিনভর চলতে থাকে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ।  

শুরুতে প্রধান শিক্ষক কামাল সরকার সভাপতি জালালের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো পড়ে শোনান সকলের উদ্দেশ্যে। তিনি জানান, জালাল স্থানীয় যুবলীগ নেতা হওয়ায় গায়ের জোরে যা ইচ্ছে তাই করে চলেছেন। স্কুল চলাকালীন লুঙ্গি পরে ক্লাসে ঢুকে পড়েন তিনি। এতে ছাত্রীরা বিব্রত হয়। ক্লাস চলাকালীন সময় তিনি শিক্ষকদের মনগড়া বিভিন্ন পরামর্শ দেন এবং তার কথা না শুনলে রূঢ় আচরণ করেন। এছাড়া অর্থ সংক্রান্ত বিভিন্ন লেন-দেন নিয়ম বহির্ভূতভাবে করেছেন জালাল।  

সম্প্রতি তার এসব কর্মকাণ্ডের জন্য শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে বিক্ষোভ করেছে।  

গেল বছরের নভেম্বর থেকে এমন অব্যবস্থাপনার জেরে চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় ১২ জন অকৃতকার্য হয়েছে।  

এ সব ব্যাপারে অভিযুক্ত সভাপতি জালাল মণ্ডল জানা, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অসত্য। তার সাথে ওই ছাত্রীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। মিষ্টির বয়স এখন ১৭ বছর। বয়স ১৮ হলেই বিয়ে করবেন তিনি।

লুঙ্গি পড়ে ক্লাসে ঢোকার ব্যাপারে জালাল বলেন, ‘বাইরের বখাটেরা স্কুলে ঢুকে মেয়েদের উত্যক্ত করে। আমি বাইরে লুঙ্গি পরে বসে বসে এসব দেখি। ক্লাসে ঢুকে প্রতিবাদ করি। ’

উল্টো স্কুলের প্রধান শিক্ষক কামাল সরদারের বিরুদ্ধে স্কুলে উপস্থিত না থাকাসহ বিভিন্ন কাজে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ আনেন জালাল।  

এ সময় কথা প্রসঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ লোকের মতো তুলনায় ‘ওই মজিবর’, ‘ওই মজিবর’ বলে সম্বোধন করেন। এতে উপস্থিত সকলে প্রতিবাদ করলেও একবারও তার মুখে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি উচ্চারিত হয়নি।

জালালের কথিত ‘হবু শ্বশুর’ ও মিষ্টির বাবা আব্দুর রউফও সভাপতি জালালের কথায় সহমত পোষণ করেন। তিনি উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে জানান, জালালের বাবা ও তিনি দীর্ঘদিনের বন্ধু। তাদের সম্মতি রয়েছে জালাল-মিষ্টির বিয়েতে। আইনি বাধ্যবাধকতায় বয়সজনিত কারণে তাদের বিয়ে ঠেকে আছে।  

news24bd.tv

স্কুলটির ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, জালাল একজন অশিক্ষিত ব্যক্তি। বয়স কম। কোন যোগ্যতায় তাকে সভাপতি করা হলো- তাই প্রশ্নবিদ্ধ।  

ছাতনী ৭ নং ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি শাহ আলম বলেন, স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নির্বাচনের সময় অনেক যোগ্য লোক ছিল। অথচ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য জালালের মতো একজনকে এ রকম গুরু দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।  

ছাতনী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি দুলাল সরকার ও ইউপি চেয়ারম্যান তোফাজ্জল সরকারও শাহ আলমের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন।

এদিকে, যে ছাত্রীকে কেন্দ্র করে এসব ঘটনার অবতারণা, সেই মিষ্টি খাতুনকে বৈঠকে হাজির করা হয়নি। এ নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকে।  

জানা গেছে, মিষ্টি এখন লালপুর উপজেলার আব্দুলপুরে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে অবস্থান করছে।  

তবে একটি অসমর্থিত সূত্র বলছে, সম্প্রতি গোপনে জালালের সাথে মিষ্টির বিয়ে দিয়েছে উভয়ের পরিবার। বিষয়টি যাতে জানাজানি না হয়, সেজন্য মিষ্টিকে দূরে রাখা হয়েছে।  

এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রমজান আলী আকন্দ বলেন,বিষয়টি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত হয়েছি আমরা। সভাপতির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে পাঠানো হবে। আর্থিক অনিয়মগুলোর ব্যাপারে ব্যাংক বিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা হবে। এক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষকেরও যদি কাজে গাফিলতি থাকে, তবে বিধি মোতাবেক তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।  

সেই সাথে নির্ভয়ে মিষ্টিকে স্কুলে পাঠাত বলেছেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা।

বৈঠক শেষে বের হবার সময় সভাপতি জালাল মণ্ডল জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্য করে প্রচ্ছন্ন হুমকি প্রদান করেন। জালালের ভাষ্য, তাকে সভাপতি পদ থেকে অপসারণ করা হলে লোকজন নিয়ে ডিসি অফিস ঘেরাও করা হবে।

এদিকে, অবিলম্বে জালালকে সভাপতির পদ থেকে অপসারণ করে তেলকুপি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ স্বাভাবিক করার দাবি জানিয়েছেন অভিভাবক ও এলাকাবাসী।  

নাসিম/অরিন/নিউজ টোয়েন্টিফোর

সম্পর্কিত খবর