ইউপি নির্বাচন: অন্তঃকোন্দলেই প্রাণহানি ৩৯

ইউপি নির্বাচন: অন্তঃকোন্দলেই প্রাণহানি ৩৯

অনলাইন ডেস্ক

দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল চলছিল মাত্র। ওই সময়ই মাগুরা সদর উপজেলার জগদল ইউপিতে প্রার্থী দেওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের অন্তঃকোন্দলে চারজনের প্রাণহানি ঘটে।

১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপের ভোটের দিন ভোরে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার প্রত্যন্ত চরাঞ্চল বাঁশগাড়ীতে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষে সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনজন মারা যান। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে নরসিংদীতে।

দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচন কেন্দ্র করে সহিংসতায় এ জেলায় নয়জন মারা যান।

জানা গেছে, দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে বেশ কয়েক দিন ধরেই উত্তেজনা বিরাজ করছিল। ১০ নভেম্বর সন্ধ্যায় দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সারা রাত থেমে থেমে চলে সংঘর্ষ।

ভোররাতে দুই পক্ষে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।

এ ছাড়া ৪ নভেম্বর সদর উপজেলার প্রত্যন্ত চরাঞ্চল আলোকবালী ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনজন নিহত হন। রায়পুরার চরাঞ্চল পাড়াতলী ইউনিয়নে ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের দুই পক্ষে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে দুজন নিহত ও পরে আরেকজন মারা যান।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত নয়জনই আওয়ামী লীগের অন্তঃকোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারের সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন। আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, যা নির্বাচন সামনে রেখে মীমাংসিত হওয়ার বদলে সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। বিশ্লেষকদের মতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, কেন্দ্রীয় নির্দেশ অমান্য করে আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করা, চরাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা খুব একটা ভালো না থাকায় পুলিশের কম নজরদারি, অবৈধ অস্ত্র সহজলভ্য হওয়ায় এমন সহিংসতা ঘটেছে।

এ ছাড়া গত ১০ বছরে আধিপত্য বিস্তারের নামে নরসিংদীর চরাঞ্চলগুলোয় ২ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। প্রথম ধাপের দুই দিনের ভোটে অর্থাৎ ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে প্রাণ হারিয়েছিলেন পাঁচজন। দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরুর আগেই মারা গেছেন ২৩ জন। আর ভোটের দিন ১১ নভেম্বর প্রাণ গেছে আরও সাতজনের। এ ছাড়া ভোটের দিন গভীর রাতে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় ঢাকার ধামরাইয়ে দুজন নিহত হন।

১১ নভেম্বর রাতে রাজবাড়ী সদর উপজেলার বাণীবহ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুল লতিফ মিয়াকে গুলি করে হত্যা করা হয়। যিনি এবারও নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। গাইবান্ধায় জয়ী এক ইউপি সদস্যকে গত রাতে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দুই ধাপে নির্বাচনী সহিংসতায় মোট ৩৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।

দেশে এবার দ্বিতীয়বারের মতো ইউপি চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হচ্ছে। বিএনপি এ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী দেয়নি। জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি দলের অংশগ্রহণও অনেকটা নামমাত্র। মাঠে বড় দল হিসেবে আওয়ামী লীগ একাই। আওয়ামী লীগ মনোনীত এবং এ দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যেই মূলত সহিংসতা ঘটছে। এ ছাড়া সাধারণ সদস্য (মেম্বার) পদে দলীয় প্রতীক না থাকলেও এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখার লড়াইয়ে রক্ত ঝরছে নিজ দলের।

 বিশ্লেষকদের মতে নির্বাচনী সহিংসতায় যে ৩৯ জনের প্রাণহানি হয়েছে তা মূলত আওয়ামী লীগের অন্তঃকোন্দলের কারণেই। এ ধাপের নির্বাচনে ৮৩৪ ইউপির মধ্যে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান হয়েছেন ৪৮৬, স্বতন্ত্র ৩৩০, জাতীয় পার্টি ১০, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ৪, জাতীয় পার্টি (জেপি) ১, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ১, খেলাফত মজলিস ১ ও জাসদের ১ জন। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অনেক ইউপিতেই বিদ্রোহীদের কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।

এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন কেন্দ্র করে যে সহিংসতাগুলো ঘটছে তার দায় নির্বাচন কমিশনের। ’ সংঘর্ষের সঙ্গে হালুয়া-রুটির সম্পর্ক আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘সার্বিক বিবেচনায় দেখা যাচ্ছে নির্বাচনে এখন হালুয়া-রুটির বিষয় আছে। এটা একটা বড় ফ্যাক্টর। এখন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়া মানে সে অনেক ক্ষমতাবান। ’ 

এদিকে নির্বাচন বিশ্লেষক ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেছেন, ‘নির্বাচনে আগেও প্রাণহানি হয়েছে। তবে নিজ দলের মধ্যে হয়নি। এখন যত প্রাণহানি হয়েছে তার অর্ধেকের বেশি শাসক দলের নিজেদের মধ্যে। অন্য দল তো নেই। শাসক দলের নেতা-কর্মীরাই এখন বিভক্ত। ’

২১ জুন প্রথম ধাপের ২০৪ ইউপি ভোটের দিন বরিশালের গৌরনদী উপজেলায় সহিংসতায় দুজন নিহত হন। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার হাজারীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন কেন্দ্র করে সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন নিহত হন। এ ছাড়া ২০ সেপ্টেম্বরের প্রথম ধাপের বাকি ১৬০ ইউপি নির্বাচনের দিন কক্সবাজারের মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকদের গোলাগুলি ও সংঘাতে দুজন নিহত হন।

এ ছাড়া দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের দিন ১১ নভেম্বর নরসিংদীর রায়পুরায় দুই প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে তিনজন প্রাণ হারান। কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার দুটি ইউনিয়নে আলাদা সংঘর্ষে মারা গেছেন দুজন।

কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল ইউনিয়নে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে নিহত হয়েছেন একজন।

এ ছাড়া ভোটের দিন ১১ নভেম্বর গভীর রাতে ঢাকার ধামরাইয়ে নিহত হয়েছেন দুজন। একই দিন রাতে রাজবাড়ী সদরে একজন সাবেক চেয়ারম্যান গুলিতে নিহত হয়েছেন। এর আগে নরসিংদীতে দুবারে ছয়জন, মাগুরায় চারজন, মেহেরপুরে দুজন, রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে দুই দফায় দুজন এবং কক্সবাজার, সিলেট, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, মৌলভীবাজার, পটুয়াখালী, ফরিদপুর ও গাইবান্ধায় একজন করে নিহত হয়েছেন।

 আরও পড়ুন:

ইমামের হাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন, গ্রেফতার যুবক

এদিকে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত ইউপি, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৪৬৯টি সহিংসতা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন ৬ হাজার ৪৮ জন এবং নিহত হয়েছেন ৮৫ জন। নিহতের মধ্যে আওয়ামী লীগের ৪১, বিএনপির ২, সাধারণ মানুষ ২২, পুলিশের গুলিতে ১৫ এবং একজন সাংবাদিক রয়েছেন। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন