বই রেখে কদবেল বিক্রি করতে লজ্জা লাগে: তানজিন

কদবেল বিক্রি

বই রেখে কদবেল বিক্রি করতে লজ্জা লাগে: তানজিন

Other

তানজিন সরদার (১১)। হাতে একটি ঝুঁড়ি। ঝুঁড়িতে পাকা কদবেল সাজিয়ে রাখা। দৌলতদিয়া ফেরি ঘাটে যাত্রীবাহী বাসগুলো ভিরতে দৌড়ে যাচ্ছে বিক্রি করতে।

শতশত হকারের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে কদবেল গুলো বিক্রি করতে। তাই গাড়িগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে। তবুও তানজিনের মলিন মুখে হাসি ফুঁটেছে।

বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে রাজবাড়ী জেলার দৌলতদিয়া ফেরি ঘাট এলাকায় গিয়ে কথা হয় তানজিন সরদার (১১) এর সাথে।

কথা শুরু করতে সে বলে আমি পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ালেখা করি। তবে নিয়মিত স্কুলে যেতে পারি না। কদবেল বিক্রি করতে হয়। স্কুল রেখে কেন কদবেল বিক্রি করতে আসো প্রশ্ন করতে তানজিন বলে স্যার খাবো কি? জামা-কাপড় পাবো কোথায়? যে কারণে স্কুল রেখে কদবেল বিক্রি করতে আসি।
 
তানজিন আরও বলে, স্যার আমারও মন চায় প্রতিদিন স্কুলে যাই। ঘাটে এসে কদবেল বিক্রি করতে লজ্জা লাগে। বন্ধুরা যখন বই নিয়ে বাবা-মায়ের সাথে স্কুলে যায় আমি তখন কদবেলের ঝুঁড়ি নিয়ে চলন্ত গাড়ির পিছনে দৌড়াই। স্কুলের বন্ধুদের সামনে পড়লে লজ্জায় লুকিয়ে পরি। চলে গেলে আবারও বিক্রি করার চেষ্টা করি। কখনও কান্না, কখনও হাসি মুখে কথাগুলো বলতে ছিল তানজিন।  
          
তানজিনের কথায় জানা গেল রাজবাড়ী জেলার দৌলতদিয়া কর্মজীবি কল্যান সংস্থা (কেকেএস) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। বাবা মজনু সরদার একজন দিন মজুর। সংসারে অভাব-অনটন। দুই ভাই ও ১টি বোন এবং বাবা-মা নিয়ে সংসার। বাড়ি রাজবাড়ী জেলা গোয়ালন্দ উপজেলা দৌলতদিয়া ইদ্রিস মিয়ার পাড়া।  

সকাল ৭টায় ঘুম থেকে উঠে পান্তা ভাত খেয়ে রোজগারের উদ্যেশে কদবেলের মহাজনের কাছে। কদবেলে ঝুঁড়ি সাজিয়ে সকাল ৮টা থেকে টানা সন্ধ্যা পর্যন্ত ছুঁটে চলন্ত গাড়িগুলোর পিছনে পিছনে। সন্ধ্যার পর মহাজনের টাকা দিয়ে লাভের দেড়/দুই শত টাকা নিয়ে বাড়িতে। বাড়িতে গিয়ে মা-বাবার হাতে রোজগারের টাকা দিয়ে ক্লান্ত অবস্থায় বিশ্রামে যেতে হয় তানজিনের। এভাবেই চলে, এভাবেই চালিয়ে যাচ্ছে তানজিন। মাঝে মধ্যে স্কুলে গিয়ে হাজিরা।  

তানজিনের সাথে কথা শেষ করতে না করতে পাশে এসে দাঁড়ালো আরও দুই জন। এদের মধ্যে সুলতান সরদার নামের একটি ছেলে বলে স্যার তানজিন আমার চাচাত ভাই। ছোট ছেলে না বুঝে অন্যায় করেছে। ওকে মাপ করে দেন। সুলতানের ধারণা তানজিন হয়ত আমার সাথে কোন অন্যায় করেছে।  

সুলতানকে বুঝিয়ে বলার পর বুঝতে পারলো। বললো স্যার, আমি পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি। করোনার সময় থেকে আর স্কুলে যাওয়া হয় না। স্কুলে গেলে এখন সেভেনে পড়তাম। তবে স্যার আগের চেয়ে এখন অনেক ভাল আছি। আগে তিন বেলা খেতে পারতাম না। এখন খেতে পারি। তবে, স্কুলে যেতে পারি না। আমার অনেক বন্ধু এখন সেভেনে পড়ে।
 
পাশে মন খারাপ করে আরও একটি ছেলে কদবেল এর ঝুঁড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের চেয়ে একটু বড়। সে বলে ভাই আমি দৌলতদিয়া মডেল হাই স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র। মাঝে মধ্যে স্কুলে যাই। বাড়ি একই গ্রামে। কতদিন যাবৎ ঘাটে এসে হকারী করো জানতেই বলে করোনার সময় থেকে।  

তখন অনেক অভাব ছিল বাড়িতে। বাবার রোজগারে আমাদের চলতো না। তখন বাবা প্রতিদিন কাজও করতে পারেনি। সেই অভাবের জন্য এখন আমি প্রতিদিন দৌলতদিয়া লঞ্চ ও ফেরি ঘাটে এসে হকারী করে রোজগার করি। মাঝে মধ্যে স্কুলে যাই।
 
তানজিন, সুলতান ও হাসানের মত শতশত শিশু প্রতিদিন স্কুল রেখে সংসার চালানোর জন্য কর্মের পথে। যার সঠিক হিসেব নেই সংশ্লিষ্ট কর্তকর্তাদের নিকট।

দৌলতদিয়া মডেল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সহিদুল ইসলাম বলেন, করোনা কালীন অনেক ছেলে মেয়ে স্কুলে আসে না। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি অনেক মেয়ের বিয়ে হয়েছে এবং ছেলেরা কর্মে চলে গেছে।  

তিনি আরও বলেন, অনেক ছেলেকে আমরা বুঝিয়ে স্কুলে নিয়ে এসেছি।  

গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আজিজুল হক খান মামুন জানান, আমরা ব্যর্থ হওয়ার কারণে অনেক শিশু কর্মের জন্য স্কুল ছেড়েছে। আমাদের উচিত এদের চিহ্নিত করে পাশে দাঁড়ানো।

জনপ্রতিনিধি এবং সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যদি অবহেলিত শিশুদের পাশে এসে দাড়ায় তাহলে শিশু শ্রম বন্ধ হবে। সকল শিশু মৌলিক অধিকার পাবে। সকল শিশু শিক্ষা অর্জন করতে পারবে।     

news24bd.tv/ কামরুল