আপন ভাইয়ের বিরুদ্ধে গিয়ে দূর সম্পর্কের ভাইকে সমর্থন

ছবি: ফাহমিদুল হক

আপন ভাইয়ের বিরুদ্ধে গিয়ে দূর সম্পর্কের ভাইকে সমর্থন

Other

খেলা যখন দুই দেশের মধ্যে হয়, তখন তো রাষ্ট্র, জাতি, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি ধরে খেলায় রাজনীতি ঢুকবেই। তা হোক মুদুমন্দ। কিন্তু তার বাড়াবাড়িই হলো সমস্যা। আমি বরাবরই এর বিরোধিতা করি।

খেলার আনন্দ ও উত্তেজনা যেন জাতিবিদ্বেষে না হারায়!

২০১৫ সালের বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে আম্পায়ারের ‘ভারতপন্থী’ সিদ্ধান্তের ভালোই বদলা নিয়েছিল বাংলাদেশ, পরমুহূর্তের বাংলাদেশ সফরে ভারতকে সিরিজ হারিয়ে। মুস্তাফিজ ম্যাজিক তা নিশ্চিত করেছিল। এরপর পাকিস্তানকেও সিরিজ হারিয়েছিল বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকাকেও। তখন থেকে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ মানেই উত্তেজনা।

পাকিস্তান তখন ম্যাচ ফিক্সিং ও জঙ্গী হামলার কারণে ম্রিয়মাণ একটা দল, তাদের দেশে কেউ খেলতেও যায় না, দলের পারফরমেন্সও ভালো না। ভাষ্যকাররা বলা শুরু করেছিল, ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচের যে উত্তেজনা আগে ছিল, তা এখন ভারত-বাংলাদেশের ম্যাচে সরে এসেছে।

মিরপুরে পাকিস্তানের পতাকা হাতে বাংলাদেশি সমর্থকরা

সে এক অভাবনীয় টার্ন ছিল বটে! কিন্তু সম্প্রতি দেখা গেল আরেক টুইস্ট। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতকে ১০ উইকেটে হারিয়ে, গ্রুপ লেভেলে একটাও ম্যাচ না হেরে, সেমিফাইনালে উঠলো পাকিস্তান। আর বাংলাদেশ হারলো লজ্জাজনক সব হার। পরপরই পাকিস্তানের বাংলাদেশ সফর। ক'দিন আগেই উইকেটের সুবিধা নিয়ে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। সেই উইকেটেই লজ্জাজনকভাবে বাংলাদেশ হারছে পাকিস্তানের কাছে। কিন্তু গ্যালারিতে চলছে আরেক নাটক। বাংলাদেশের সমর্থকদেরদের এক বিরাট অংশ হয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানের সমর্থক। পাকিস্তানের জয়ে আর বাংলাদেশের পরাজয়ে তারা খুশি। পাকিস্তানি পতাকা তারা ওড়ায়, পাকিস্তানি জার্সি তাদের গায়ে।  

এ কিন্তু এক মারাত্মক ব্যাপার! বাংলাদেশের স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে পাকিস্তানি পতাকা আগেও উড়েছে, বিশেষত ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচ হলে। কিন্তু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ম্যাচ হলে এমন হতো না। এক দু’জন হঠাৎ এরকম করে ফেললে তাকে সিঙ্গেল আউট করা হতো, এবং নিদারুণ গণধিক্বারের মুখে পড়তো। কিন্তু এবার যে জনজোয়ার!

এখানে পরস্পরবিরোধী দুটো তথ্য যোগ করে নিলে এই পরিস্থিতির জটিলতার গভীরতা বোঝা যাবে: ১। পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে ১৯৭১ সালে লাখ লাখ বাংলাদেশী হত্যা করেছিল এবং আজ অব্দি ক্ষমা চায় নি, শত্রুরাষ্ট্র পরে বন্ধু হলেও সেই ইতিহাস মুছে যায় নি, যাবে না। সে যুদ্ধে বাংলাদেশ জয়ী হয়েছিল। ২। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান, তাই ভাই-ব্রাদারের অনুভূতি দুই দেশের মানুষের মধ্যে কাজ করে।

আর তৃতীয় তথ্যটি জটিলতার এক নতুন ডাইমেনশন যোগ করে: ৩। অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে হারিয়ে দেবার সুবাদে, সাধারণ বাংলাদেশীদের মধ্যে পাকিস্তানিদের বিষয়ে যে হীনম্মন্যতা বা ইনফেরিওরিটির বোধ ছিল সেটাও প্রায় চলে গিয়েছিল। পাকিস্তানিরাও বলা শুরু করেছিল, তারা আমাদের অধীনে ছিল, আজ তারা কোথায়, আর আমরা কোথায়? আবার ধরা যাক, একসময় বাংলাদেশ টেস্ট খেলতো না, কালেভদ্রে ওয়ানডে খেলার সুযোগ পেত। সেই দিনও গত, ওয়ানডেতে বাংলাদেশের র‌্যাংকিং ৭, পাকিস্তানের ৫/৬-এ ওঠানামা করে। পার্থক্য খুব বেশি ছিলও না।

এসব পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে, পাকিস্তান যতই ভালো খেলুক আর বাংলাদেশ যতই খারাপ খেলুক, এবার যা ঘটেছে, তাতে দ্বিস্তরিক ব্যাপার আছে: ক। বাংলাদেশের ম্যাচে বাংলাদেশকে সমর্থন না করা খ। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গিয়ে অপর দলটিকে সমর্থন করা। আমি নিশ্চিত এই অপর দলটি যদি ভারত, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ হতো, এই ঘটনা ঘটতো না। ওপরের ১, ২, ৩-এর মধ্যে তাহলে তো ২-ই প্রধান ফ্যাক্টর এই টুইস্টের (মুসলমানরা ভাই ভাই)। তবুও তো এটা রক্তের ভাইয়ের বিরুদ্ধে গিয়ে দূর সম্পর্কের ভাইয়ের সাথে গলাগলির মতো হলো! আমি বাংলাদেশের ম্যাচে পাকিস্তানি জার্সি গায়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যাচ্ছে যে তরুণ সমর্থকরা, তাদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে চাচ্ছি, পারছি না। তারা তো ইমিগ্রান্টদের দেশ ইংল্যাল্ডে বসবাসকারী পাকিস্তানি না, যে লর্ডসে বসে পাকিস্তানকে সমর্থন করছে। মিরপুর স্টেডিয়ামে দু’চারজন ’আটকে পড়া পাকিস্তানি’ থাকতেও পারে, কিন্তু বেশিরভাগই বাঙালির ঘরে জন্ম নেয়া বাঙালি তরুণ।

আর এতদিন ধরে পাকিস্তান দেশ ও তার মানুষের (পাকি বা পাইক্যাগণ) বিরুদ্ধে এত আলোচনা হলো, ঘৃণার চাষাবাদ হলো সরকারি ভাষ্যে, বই ও সংবাদ-সাহিত্যে এবং ফেসবুকসাহিত্যে, তার দাগ পড়লো না কোথাও? 
খেলার সঙ্গে রাজনীতি না মিশিয়ে তো বিষটা বোঝারও উপায় নেই।

নোট ১। : বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য আরো খারাপি বাকি আছে। আগে দ্বিপাক্ষিক সফরে খেলা হতো, টেস্ট ও ওয়ানডে ম্যাচ, এখন হয় টেস্ট ও টিটোয়েন্টি। বাংলাদেশ কেবল ওয়ানডেতে বেশ ভালো, বাকি দুটোয় বেশ দুর্বল। আমি মনে করি না, বাংলাদেশের ক্রিকেট এমন কোনো তলানিতে গেছে, বরং যেমন ছিল তেমনই আছে। কেবল টিটোয়েন্টি ম্যাচ বেশি সংখ্যায় হওয়ায়, তাকে খুব দুর্বল দেখাচ্ছে, খেলোয়াড়দের মানসিক অবস্থাও ভেঙ্গে যাচ্ছে। সাংবাদিক, পর্য়বেক্ষক ও দর্শকদের এই দিকটি মনে রাখা দরকার। ওয়ানডে ম্যাচ শুরু হলে জয় দেখা যাবে, তবে টিটোয়েন্টির আধ্যিক্যে ও ধাক্কায় খেলোয়াড়দের মনোবল ও বিশ্বাস ততদিনে টিকে থাকে কিনা কে জানে!

নোট ২। মন্তব্যে পাকি, জারজ, রাজাকারশাবক ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার না করার অনুরোধ করছি। ঘৃণাবাচক এসব বলে যে লাভ হয় না, দেখতেই পাচ্ছেন!

আরও পড়ুন


চুয়াডাঙ্গায় ছেলের লাঠির আঘাতে মায়ের মৃত্যু

news24bd.tv এসএম