১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পাহাড়িদের একটি সংগঠন জনসংহতি সমিতির (শান্তিবাহিনী) সঙ্গে চুক্তি করে। ওই চুক্তির মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সাময়িক অবসান হয়।
কিন্তু এই ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তির ২৪ বছর পার হলেও সেখানে শান্তি পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা হয়নি। সংঘাত, চাঁদাবাজি, হত্যা, অপহরণসহ নানা অপরাধ, অস্থিরতা থামেনি।
চুক্তি স্বাক্ষরকারী পাহাড়িদের সংগঠনগুলোর অভিযোগ, চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিভিন্ন গোষ্ঠী নানা উদ্দেশ্য নিয়ে সক্রিয় থাকার সুযোগ পাচ্ছে এবং সে কারণে অস্থিরতা বাড়ছে।
আরও পড়ুন
এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু আজ
প্রকাশ্যে কাউন্সিলর হত্যা: এবার ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রধান আসামি নিহত
জানা যায়, চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে সরকার ৪৮টি ধারা পুরোপুরি বাস্তবায়নের কাজ সম্পন্ন করেছে। বাকি ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়ন এবং ৯টি ধারা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তবে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির জন্য পালনযোগ্য চুক্তির প্রধান শর্ত ‘সব অস্ত্র জমা দেওয়া’ এখনো কার্যকর করেনি সংগঠনটি। চুক্তির বিরোধিতাকারীরাও তাদের সশস্ত্র অবস্থান বহাল রেখেছে।
স্থানীয় গণ্যমাধ্যমকর্মী আবু দাউদকে পাহাড়ি নেতা সন্তোষিত চাকমা বকুল বলেন, চুক্তির মূল বিষয়গুলোর মধ্যে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি, অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার, স্থানীয় পুলিশ বাহিনী গঠনসহ অনেক বিষয়ের সমস্যা রয়ে গেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) কেন্দ্রীয় সহসভাপতি বিভূ রঞ্জন চাকমা জানান, দীর্ঘ সময়েও চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ ধারাই বাস্তবায়িত হয়নি। চুক্তির মৌলিক ধারাগুলোর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ, পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বিধিমালা চূড়ান্তকরণ, অভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তু ও ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের পুনর্বাসন করা হয়নি।
অন্যদিকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী বলেন, জনসংহতি সমিতির নেতারা চুক্তিতে স্বাক্ষরের পর শর্ত মানছেন না। তাঁরা এখনো সব অস্ত্র জমা দেননি। উল্টো সশস্ত্র সংগঠনের সংখ্যা বেড়েছে। সংগঠনগুলো আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘাতে লিপ্ত। তিনি বলেন, চুক্তির ফলে পাহাড়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। পার্বত্য মন্ত্রণালয় সৃষ্টি, আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদে গতিশীলতা, ভূমি কমিশন গঠন—সবই চুক্তির ফসল।
চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ও শরণার্থীবিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি বলেন, ‘কিছু সমস্যা থাকলেও চুক্তির বেশির ভাগ বিষয় বাস্তবায়িত হয়েছে। আরো কিছু ধারা ও উপধারা বাস্তবায়নের পথে। চুক্তি যেমনভাবে সবার আন্তরিক চেষ্টায় হয়েছিল, তেমনিভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও মান-অভিমান ভুলে নিজেরা আরেকটু আন্তরিক হলেই সহজ হয়।
রাঙামাটির সাংবাদিক ফজলে এলাহীকে রাঙামাটির প্রবীণ সাংবাদিক সুনীল কান্তি দে বলেন, সরকারকে অবশ্যই পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে সিরিয়াসলি ভাবতে হবে, সংকটের সমাধানসূত্র অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। আর অবৈধ অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার বন্ধ করতে না পারলে সংকট থেকে উত্তরণ অসম্ভব।
রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. মুছা মাতব্বর বলেন, ‘পাহাড়ে সংঘটিত প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচারও নিশ্চিত করতে হবে। আঞ্চলিক দলগুলোর সশস্ত্র সন্ত্রাসের সবচেয়ে বড় শিকার এখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই। ’
রাঙামাটি জেলা বিএনপির সভাপতি হাজি মো. শাহ আলম বলেন, ‘পাহাড়ের সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করে সব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং সন্ত্রাসীদের নিশ্চিহ্ন করা না হলে এসব চলতেই থাকবে। ’
রাঙামাটি সরকারি কলেজের সাবেক জিএস এবং নাগরিক আন্দোলনের নেতা জাহাঙ্গীর আলম মুন্না বলেন, ‘আঞ্চলিক দলগুলোর ভৌগোলিক আধিপত্য বিস্তার আর চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সশস্ত্র বিরোধের মাসুল গুনছে পাহাড়ের মানুষ। ’
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) আইনবিষয়ক সম্পাদক ও বাঘাইছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা বলেন, ‘আমরা তো আক্রমণ করি না, আক্রমণের শিকার। আমরা সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতি ও প্রসীত খীসার ইউপিডিএফের সশস্ত্র হামলার শিকার হয়েছি বারবার। গত ১০ বছরে আমাদের ৮৫ জন নেতাকর্মী এ দুই দলের হাতে মারা গেছে। ’
অন্য পক্ষ সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বাঘাইছড়ি উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিব চাকমা বলেন, ‘আমাদের কোনো সশস্ত্র শাখা বা কর্মী নাই। আমরা চুক্তি বাস্তবায়নে গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রাম করছি। পাহাড়ে হত্যা, খুন ও গুমের কোনো ঘটনার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই। ’
প্রসীত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সংগঠক বাবলু চাকমা বলেন, পাহাড়ে শান্তি বা অশান্তির দায় সরকারেরই। সরকার চাইলে এসব বন্ধ হবে।
রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) তাপস রঞ্জন ঘোষ বলেন, পাহাড়ে আঞ্চলিক দলগুলো মূলত এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারের জন্যই সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত।
news24bd.tv/ কামরুল