নিজের বাবার বিকৃত মানসিকতা থেকেও রেহাই পায়না অনেক শিশু

এ্যামি জান্নাত

নিজের বাবার বিকৃত মানসিকতা থেকেও রেহাই পায়না অনেক শিশু

এ্যামি জান্নাত

একটি শিশুর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হচ্ছে তার পরিবার। তার চিন্তা, চেতনা, জ্ঞান ও মানসিক বিকাশ ঘটে প্রাথমিকভাবে পরিবার থেকেই। আর শিশুদের মন স্বভাবতই স্পর্শকাতর হয়। তাই যেকোনো ভালো ঘটনা যেমন তার মনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে তেমনি যেকোনো খারাপ কিছুই তার মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

ইতিবাচক দিকগুলো শিশুর মেধা ও মননের বিকাশ ঘটায়। কিন্তু নেতিবাচক দিকগুলোর প্রতিক্রিয়া শিশুর কোমল মনে এতটাই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যে তার মনোজগতে এর প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং মারাত্মক বিষয় হলো পরিবার, আত্মীয়-স্বজন বা কাছের কারও দ্বারা যৌন নির্যাতন। পরিসংখ্যান বলছে বাংলাদেশে প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ শিশুর যৌন হয়রানির ঘটনাই ঘটে পরিবারের ঘনিষ্ঠজন, বন্ধু বা আত্মীয়দের মাধ্যমে৷ মেয়ে শিশুদের মধ্যে প্রতি চার জনে একজন যৌন হয়রানির শিকার হয়।

আর ছেলে শিশুরাও এর শিকার হচ্ছে।  

প্রতি ছয় জন ছেলে শিশুর মধ্যে একজন যৌন হয়রানির শিকার হয়।

এখন প্রশ্ন, এক্ষেত্রে কয়টি পরিবার এই বিষয়গুলো জানে বা গুরুত্ব দেয়? আমার নিজের দেখা কিছু কেস স্টাডি থেকে বলছি, নিজের খুব নিকট আত্মীয় যেমন চাচা, খালু বা মামা, বাসায় পড়াতে আসা হুজুর বা শিক্ষক, বন্ধুর বাবা, যাদের কাছে নানাভাবে যৌন নিপীড়িত শিশুরা অনেকে ভয়ে পরিবারে বলতে পারেনি, বা বলতে গিয়ে গুরুত্ব পায়নি, অথবা কেউ কেউ উলটো দোষী সাব্যস্ত হয়ে চুপ হয়ে গেছে। এমনকি দুই/একটি পরিবারে নিজের বাবার বিকৃত মানসিকতা থেকেও রেহাই পায়নি অনেক শিশু।

কিন্তু এই যে না বলতে না পারা বা গুরুত্ব না পেয়ে নিজেই দোষী হওয়া শিশুগুলোর মনের অবস্থা কি হতে পারে সেটা নিয়ে ভাবে কয়টা পরিবার? এর প্রভাবে অনেক শিশুই নিজের প্রতি, নিজের পরিবারের প্রতি একটা ঘৃণার মনোভাব নিয়ে বেড়ে ওঠে যেটা হয়তো আড়ালই থেকে যায়। যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে শিশুটির ভবিষ্যৎ জীবনে। বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা একটি কোমল হৃদয় নিজেকেই হারিয়ে ফেলে। কুঁড়িতেই নষ্ট হয়ে যায় অনেক স্বপ্ন। শুধু সেই খোঁজ সবাই রাখে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার চলাফেরা বা আচরণে স্বাভাবিকতা থাকলেও মনের মধ্যে থাকা ক্ষোভগুলো স্বাভাবিক থাকে না।

 সবচেয়ে মারাত্মক হয় সেগুলো, যারা নিজের শরীরের প্রতি বিতৃষ্ণা নিয়ে বড় হয়, নিজের শরীরকেই ভালোবাসতে পারে না। এর থেকে যেকোনো ধরণের বিপজ্জনক পদক্ষেপও সে নিতে পারে। তাই নিজের সন্তানের পড়াশোনা, মানসিক বিকাশে খেয়াল রাখার পাশাপাশি বিকাশটুকু সঠিক পদ্ধতিতে  বা আদৌ হচ্ছে কি না সে বিষয়ে নজর দেওয়াটা সবচেয়ে জরুরি।  

হ্যাঁ, এখন শিশু থেকে শুরু করে বাবা-মা কেও যৌনশিক্ষার ব্যাপারে সচেতন করা হচ্ছে। কিন্তু শিশু যৌন নির্যাতনের হার অনুযায়ী শুধু এটুকুই যথেষ্ট না। আমাদের দেশে কয়টা মুভি বা নাটক নির্মিত হয় পরিবারে শিশু নির্যাতন নিয়ে? যেখানে বিশ্বের অনেক দেশে এই বাস্তব চিত্রগুলো নিয়ে নির্মাণ করা মুভিগুলো এওয়ার্ড জয় করে! কয়টা ওয়ার্কশপ হয় শুধু এই একটা বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে? মঞ্চস্থই বা হয় কয়টা নাটক? হলেও খুব হাতে গোনা। যা আমরা সবাই নাগাল পাই না। আর আইন তো অনেক দূর!

এই প্রতিটি বিষয় হওয়া উচিৎ প্রত্যেকটি পরিবারের জন্য, প্রতিটি শ্রেণীর মানুষের জন্য। যারা অনেকে জানেই না এই শব্দগুলো, জানেইনা এরকম একটা বিষয় থাকতে পারে যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হুমকিস্বরূপ। গ্রাম থেকে শহর, নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত, প্রভাবশালী থেকে ধনবান সবার জন্য যার ক্ষেত্রে যেভাবে প্রযোজ্য ঠিক সেভাবেই এই শিক্ষাগুলো তুলে ধরা আবশ্যক। এতে যারা জানেনা তারা জানবে আর যারা জেনেও চুপ করে থাকে, তাদের কিছু সংখ্যক হলেও সচেতন হবে। সেই সচেতনতার বিস্তারও ঘটবে এবং শিশুরা  এই নিপীড়ন থেকে বের হতে পারবে, আশা করা যায়।

লেখক : এ্যামি জান্নাত,সাংবাদিক।

(মত-ভিন্নমত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv/আলী