ছাত্রী 'বিয়ে' করলে তার কি 'ছাত্রীত্ব' থাকবে না?

মারজিয়া প্রভা

ছাত্রী 'বিয়ে' করলে তার কি 'ছাত্রীত্ব' থাকবে না?

মারজিয়া প্রভা

'মেয়েদের হল', 'মেয়েদের বাথরুম', 'মেয়েদের পার্লার' এই সবকিছুর মধ্যে আমি এবস্ট্রাক্ট একটা যোনি দেখতে পাই। যেহেতু আমাদের সমাজে লৈংগিক আইডেন্টিটিগুলো কনস্ট্রাক্টই হয় যোনি কিংবা পেনিস দিয়ে, এবং জীবনভর সেই আইডেন্টিটি,আচরণকে বহন করানোর জন্য সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার ওৎ পেতে থাকে, সেহেতু 'মেয়েদের' যেকোন কিছুতেই একটা আলাদা, বিশেষায়িত টার্মস এন্ড কন্ডিশন থাকেই।  

এখন যখনই  'ঐ রুমটা মেয়েদের' বলে তাক করা হয়, তখনই আমার ব্যাপক ভয় লাগে, ওখানে নিশ্চয়ই এমন কিছু আছে, যেইটা আমার ভয়াবহভাবে জেন্ডার চ্যালেঞ্জ করা মন নিতে পারবে না।  কিন্তু 'মেয়েদের হল' তো একটা অলিখিত এবং আবার দরকারী প্রতিষ্ঠানের মত হয়ে গেছে।

ছেলে মেয়েকে তো রাষ্ট্র আর সমাজ 'বিয়ে' ব্যাতীত একসাথে থাকার উন্মুক্ততা দিতেছেই না, কারণ এরা ধরে বসেই থাকে 'ছেলে মেয়ে একসাথে' থাকা মানেই সেক্স। আবার ধরেন, বাসাবাড়িতে আলাদাভাবেই একলা ছেলে মেয়েদের ভাড়াই দিচ্ছে না।  

একলা বা গ্রুপ করে আলাদাভাবে ছেলে মেয়ে থাকা মানেই ওখানে গ্রুপ সেক্স হবে, মাদক হবে, ফুর্তি হবে এসব বাড়িওয়ালারা ভাবে। তারা চায় ফ্যামিলি কেবল ভাড়া নিবে বাসা।

আমাদের দেশের বাড়িওয়ালারা সবাইকে কাবিন দিয়ে বিয়ে করায় দিতে পারলে কি যে খুশি হয়! ভাবা যায় না!

তাই যে মেয়েটি, ছেলেটি দুরদুরান্ত থেকে পড়তে কিংবা জব করতে আসছে, তার থাকার জায়গা হয়, প্রতিষ্ঠান মারফত দেওয়া 'হল' কিংবা বাসাবাড়ির ব্যাচেলর মেস বা বেসরকারি কিছু 'ছাত্রী হল' বা 'ছাত্র হল'।  

তো প্রায় সময়ই এই 'ছাত্রী হল' গুলোতে অদৃশ্য ভ্যাজাইনা বিরাজমান থাকে। যেখানে হল কর্তৃপক্ষ এমন সব লিংগবাদী নিয়ম প্রণয়ন করে, তা দেখলে রীতিমত বিভীষিকার অনুভুতি হয় আমার। যেমনটা 'ওইঘরটা মেয়েদের' শুনলে মনে হয়, আগেই বললাম! 

ছাত্রী হলগুলোতে সবচেয়ে বড় যে নিয়ম বাঁধা, তা হচ্ছে ফেরার সময় বেঁধে দেওয়া। যেই হল সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা দেয়  মেয়েদের, সেইটাও বলে ' মামণিরা রাত ১২ টার মধ্যেই তোমাদের ফিরে আসতে হবে'! হ্যাঁ অনেক নারীরাই এইসব নিয়ম তোয়াক্কা করে বাইরে থাকে মাঝে মাঝে, একটু আধটু প্রিভিলেজপ্রাপ্ত হয়, তাতে করে এই 'নিয়ম' টা তো নিয়ম ই থাকে তাই না? এবং নিয়ম মানে এমন জিনিস, যেইটা মাথায় ক্যাক করে বোঝা রেখে দেওয়ার মত। যারা প্রিভিলেজপ্রাপ্ত, তারা ওই বোঝাটা নামাতে পারে। যারা নয়, তাদের বোঝা নিয়েই আগাতে হয়।

মজা হচ্ছে, এই প্রিভিলেজপ্রাপ্তদেরকেও যদি সময়ের পরে ফিরে আসতে হয় তবে তাকে 'ইমার্জেন্সির গল্প' সাজাতে হয়।  কিংবা আগে পারমিশন নিতে হয়। মানে তার বলার উপায় নেই কোনমতে, 'বাল আমার ইচ্ছা হইছে আমি বেশি রাত করছি'!

আরও পড়ুন: শিশুকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে সুপারি বাগানে ধর্ষণচেষ্টা

অথচ ছেলেদের হলের দিকে তাকায় দেখেন। এরা কখন যাচ্ছে, কখন বের হচ্ছে তার কোন সীমারেখা নাই। ইমার্জেন্সি গল্প বানানোর ঝামেলা নাই। রাতের এই মুক্ত জীবন কাটানোর জন্য তাদের আলগা প্রিভিলেজ নিতে হয় না, তারা আজন্মই এসবক্ষেত্রে প্রিভিলেজপ্রাপ্ত। তাদেরকে সমাজ, রাষ্ট্র প্রিভিলেজ দিয়াই রাখছে যে 'রাতের শহরটা ভাই তোর!'। এরমধ্যে ব্যাতিক্রম ঘটনা তো আছে। কিন্তু আমি কথাটা বলছি বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা নিয়ম নিয়ে।

গত দুইদিন আগে ফেসবুকে ঢাবির হল নিয়ে একটা অতি অসংবেদনশীল আলাপ দেখতেছি। বিবাহিত নারী এবং অন্ত্বঃস্বত্তা নারীদের নাকি হলে থাকতে দেওয়া হবে না। একটা নারীর ছাত্রী অবস্থায় বিয়ে করতে ইচ্ছে করতে পারে না? বাচ্চা নিবে না? নারীর সেক্স কিংবা জরায়ু কি সে রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠানের কাছে বর্গা দিছে! যে ছাত্রী থাকা অবস্থায় বিয়ে করবে না? 

এখন ছাত্রী 'বিয়ে' করলে তার কি 'ছাত্রীত্ব' থাকবে না? তার ছাত্রীত্ব থাকলে সে হল কেন পাবে না? এইটা তো একটা শিক্ষার্থীর কনক্রিট অধিকার।  

আবার অন্ত্বঃস্বত্তা নারীদের হলে না থাকতে দেওয়া মানে তার যে মাতৃত্বকালীন অধিকার আছে তা রীতিমত লংঘন করা। হুদাই নারীদেরকে মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেওয়া  হয় না৷ এই পেটের বাচ্চা দিয়ে রাষ্ট্রের 'জনগণ' নামক জিনিস তৈরি হয়। সভ্যতা টিকে। মানুষ টিকে। এইগুলা নারীর 'হাওয়ায় পাওয়া ধন' না। মানুষের সারভাইভালের প্রশ্নেই নারী এই অধিকারগুলো অর্জন করেছে।  

এখন ধরেন ঢাবির ছাত্র হলে থাকা ছেলেটা বিয়ে করলে, বাচ্চার বাবা হলে কেউ তাইরে কওয়ার হিম্মত রাখে না! 'তুমি বিবাহিত এবং বাচ্চার বাবা, তাই হলে থাকতে পারবে না"! কোনদিন কইতেই পারবে না। থাবড়াইয়া উড়ায় দিবে সবাই মিলে।  

পুরুষের এই থাবড়া দিয়ে হ্যাডমের কারণ হচ্ছে সমাজ পুরুষের বিয়ে, বাচ্চা হওয়াকে যৌন রাজনীতির ক্ষেত্রে 'সুপ্রিম ফ্যাক্ট' ভাবে। মানে পুরুষের যৌনতা একখান ভারী, শক্তিশালী, শাসনের জিনিস। পুরুষ হচ্ছে 'দিছে'। পুরুষ যৌনতায় দাতা। নারী গ্রহিতা। দাতা রোলে 'পুরুষের সমাজ' পুরুষকে সুপিরিওর হিসেবে দেখে। আর গ্রহীতা নারীকে দেখে অবদমিত শাবানা হিসেবে, যে নারী ভারবারেবল, পেটে বাচ্চা নিয়ে ঘুরে, দশমাস পুরুষের মত উৎপাদনক্ষম থাকেনা। দাতা গ্রহীতারে সমানভাবে এই দুনিয়া দেখে না।  

আর তাই পুরুষের দুনিয়া এই নিয়মগুলো বানানোর এত হিম্মত রাখে। এমনকি এত লড়াই করে পাওয়া 'নারীর মাতৃত্বকালীন সুবিধার' মত অধিকারকেও একটা খোচায় নাই করে দিতে পারে। এদের এতোই ক্ষুরধার শক্তি।  

বাংলাদেশে মেগাসিটি, ছোট শহর, বড় শহরের হলনিবাসী মেয়েরা সবাই একসাথে চিল্লাইতে পারত, তাহলেই 'মেয়েদের হল' নামক নারীর ব্যক্তিজীবনের উপর অত্যাচারের প্রলাপ বন্ধ হত। কিন্তু ঐ চিল্লানোটাই আর হচ্ছে না! দূর থেকে এসেছে একটু পড়তে,  একটু ভালো জীবনের সন্ধান পেতে। হয়ত নিয়ম করে ভালো মেয়ের পাঠ নিচ্ছে, সন্ধ্যায় ভালো মেয়ের মত ঘরে ফিরছে আর  একদিন সিস্টেমের উপরে যেয়ে সিস্টেম ভাংগবে ভাবছে! 

কিন্তু সিস্টেমকে উপর্যুপরি ধরে না থাবড়াইলে সিস্টেম ভাংগে না। ঢাবির মেয়েরা চিল্লাচ্ছে। তাদের জন্য সাধুবাদ এবং সংহতি।

(মত-ভিন্নমত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। ) 

news24bd.tv/ কামরুল