ইতিহাস জার্মানির বিপক্ষে!

ইতিহাস জার্মানির বিপক্ষে!

• সাহিদ রহমান অরিন

➖ ➖ ➖ ➖ ➖

প্রাইমারির গণ্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে ভর্তি হতেই বাংলা হয়ে গেল দুই ভাগ! দ্বিতীয় পত্রের সিলেবাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ টপিক হয়ে উঠলো ভাব সম্প্রসারণ। এই যেমন- ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন’।

তবে বিশ্বকাপ জ্বর শরীরে জেঁকে বসায় এবার বদলে ফেলতে হচ্ছে ব্যাকরণ। এখন সবকিছু ভাবতে হচ্ছে ফুটবলীয় ভাষায়।

তাই আর ভাব সম্প্রসারণ নয়; প্রশ্নপত্র তৈরি করতে হচ্ছে ‘অভিশপ্ত ইতিহাসের অপসারণ’ নিয়ে। আর পরীক্ষার হলে এ বিষয়ে লিখতে হবে জার্মানদের!

প্রশ্ন: অভিশপ্ত ইতিহাসের অপসারণ করো- ‘বিশ্বকাপ জয়ের চেয়ে শিরোপা ধরে রাখা কঠিন’। সময়: ১৪ জুন- ১৫ জুলাই, পূর্ণমান: ২১ (একুশতম বিশ্বকাপ বলে)

হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। বিশ্বকাপ ধরে রাখতে হলে আগের ধারা বদলে নতুন ইতিহাস রচনা করতে হবে জার্মানদের।

ইতিহাস বলছে, ফিফা আয়োজিত আরেক বৈশ্বিক আসর ‘কনফেডারেশন্স কাপ’ জিতে বিশ্বকাপে অংশ নেয়া কোনো দল শিরোপা ধরে রাখতে পারেনি!
➖ ➖ ➖ ➖ ➖

সেটা ইতিহাস-পরিসংখ্যান ঘাটলেই স্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে:

১৯৯২ কনফেডারেশন্স কাপ চ্যাম্পিয়ন → আর্জেন্টিনা  ️
১৯৯৪ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন → ব্রাজিল 

১৯৯৭ কনফেডারেশন্স কাপ চ্যাম্পিয়ন → ব্রাজিল  
১৯৯৮ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন → ফ্রান্স 

২০০১ কনফেডারেশন্স কাপ চ্যাম্পিয়ন → ফ্রান্স 
২০০২ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন → ব্রাজিল ️

২০০৫ কনফেডারেশন্স কাপ চ্যাম্পিয়ন → ব্রাজিল  ️
২০০৬ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন → ইতালি 

২০০৯ কনফেডারেশন্স কাপ চ্যাম্পিয়ন → ব্রাজিল ️
২০১০ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন → স্পেন 

২০১৩ কনফেডারেশন্স কাপ চ্যাম্পিয়ন → ব্রাজিল
২০১৪ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন → জার্মানি

২০১৭ কনফেডারেশন্স কাপ চ্যাম্পিয়ন → জার্মানি
২০১৮ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন → ______ ?
➖ ➖ ➖ ➖ ➖

১৯৯২ সালে কনফেডারেশন্স কাপের উদ্বোধনী আসর বসে সৌদি আরবে। ফাইনালে স্বাগতিকদের ৩-১ গোলে হারিয়ে শিরোপা ঘরে তোলে গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা-দিয়েগো সিমিওনের আর্জেন্টিনা। কোনো বৈশ্বিক আসরে এটাই ছিল আলবিসেলেস্তেদের সর্বশেষ শিরোপার স্বাদ। সে সময় অবশ্য এই টুর্নামেন্টের নাম ছিল ‘কিং ফাহাদ কাপ’।

আর্জেন্টিনার এই দলটাই ১৯৯৪ ফুটবল মহযজ্ঞের দ্বিতীয় রাউন্ডে পা হড়কে মার্কিন মুলুক থেকে বাড়ি ফিরে আসে। তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল সেইবারই দুই যুগ বিশ্বকাপ জিততে না পারার আক্ষেপ ঘুচিয়ে চতুর্থবার বিশ্ব ফুটবলের রাজ সিংহাসনে বসে।

১৯৯৭ সালে ‘কিং ফাহাদ কাপ’কে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় ফিফা। আজকের ‘ফিফা কনফেডারেশন্স কাপ’-এর নামকরণ করা হয় তখনই। বস্তুত, সেটাই ছিল প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত কনফেডারেশন্স কাপ। ওই আসরটিরও আয়োজক ছিল সৌদি। ওইবারের শিরোপা নির্ধারণীতে অস্ট্রেলিয়াকে ৬-০ গোলে চূর্ণ করে রোমারিও-ডুঙ্গার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল।

পরের বছর ফ্রান্সে পেন্টা জয়ের খুব কাছ থেকে ফিরতে হয়েছে সেলেসাওদের। সেন্ট ডেনিসের ফাইনালে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের ৩-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে বিশ্ব জয়ের আনন্দে মাতে জিনেদিন জিদান-থিয়েরি অঁরি-ফাবিয়েন বার্থেজরা, যে দলের নেতৃত্বে ছিলেন বর্তমান ফ্রেঞ্চ কোচ দিদিয়ের দেশম।

ফরাসিদের জয়জয়কার জারি থাকে ২০০১ কনফেডারেশন্স কাপেও। প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের ৩ বছর পর প্রথম ‘মিনি বিশ্বকাপ’ জয়ের স্বাদ পায় ‘লে ব্লুরা’।

সেই ফ্রান্স ️২০০২ সালে এশিয়ার মাটিতে (কোরিয়া-জাপান যৌথ আয়োজক) অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে গ্রুপ পর্বেই ধরাশায়ী! ওইবারই পেন্টা  জয়ের পাশাপাশি ভিন্ন চার মহাদেশে বিশ্ববিজেতার মুকুট পড়ার অনন্য কীর্তি গড়ে রোনাল্ডো-রিভালডো-কাফু-কার্লোসদের পরাক্রমশালী ব্রাজিল।

পেন্টাজয়ী ব্রাজিল এতোটাই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে যে, তাদের দ্বিতীয় সারির দলের কাছেও সে সময় কেউ পেরে উঠতো না। এই বেঞ্চ গরম করাদের একাংশকে ২০০৫ সালে জার্মানিতে পাঠিয়েই কনফেডারেশন্স কাপ পুনরুদ্ধার করে কাকা-রোনালদিনহো। কিন্তু পরের বছর পূর্ণ শক্তির দল নিয়ে বিশ্বকাপে অংশ নিয়েও কোয়ার্টার ফাইনালে হেক্সা স্বপ্নের সলিল সমাধি ঘটে সেলেসাওদের।

তবে কনফেডারেশন্স কাপের পরের দুই আসরে (২০০৯ ও ২০১৩) শিরোপা ধরে রেখে হ্যাটট্রিক নৈপুণ্য অর্জন করে সাম্বা বয়েজরা। এর মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈশ্বিক ফুটবল প্রতিযোগিতাটিকে এক প্রকার ‘নিজেদের সম্পত্তিতে’ পরিণত করে ব্রাজিল। কিন্তু ইতিহাসের মারপ্যাঁচে হেক্সা জয় এখনো অধরাই রয়ে গেছে।

কনফেডারেশন্স কাপ আর বিশ্বকাপের পারস্পরিক সাংঘর্ষিক ও রহস্যময় ইতিহাসে পরের দুই আসরে বিশ্বকাপ জিতে নেয় স্পেন (২০১০) এবং জার্মানি (২০১৪)।

সবশেষ, গেল বছর কনফেডারেশন্স কাপের শিরোপা শোকেজে ভরিয়ে আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, ব্রাজিলের পর চতুর্থ জাতি হিসেবে সব ধরনের ভূমণ্ডলীয় ট্রফি জয়ের তালিকায় নাম লেখায় বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানি।

আর সেটা করেই যে সাংঘাতিক ভুল ❌ করে ফেলেছে ডি মানশাফ্টরা! মনে আছে? যে কথামালা দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম- ‘কনফেডারেশন্স কাপ জিতে বিশ্বকাপ খেলতে নামা কোনো দল অদ্যবধি শিরোপা ধরে রাখতে পারেনি। ’

সত্যিই, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। বিশ্বকাপ জয়ের চেয়ে শিরোপা ধরে রাখাটা আরও বেশি কঠিন।

জোয়কিম লো’র ছাত্ররা কি পারবে, ইতিহাস পাল্টে নতুন ইতিহাস লিখতে? থমাস মুলার-মেসুত ওজিল-ম্যানুয়েল ন্যুয়াররা কি পারবে অভিশপ্ত ইতিহাসের ‘ডেডলক’ ভাঙতে? ক্ষণ গণনা শুরু হলো আজ, এখন, এই মুহূর্ত থেকেই।

ফিফা বিশ্বকাপ রাশিয়া ২০১৮™-তে সবাইকে স্বাগত।
➖ ➖ ➖ ➖ ➖

অরিন/নিউজ টোয়েন্টিফোর

সম্পর্কিত খবর