লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড: ত্রুটি নিয়ে অন্য লঞ্চের সঙ্গে পাল্লা

সংগৃহীত ছবি

লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড: ত্রুটি নিয়ে অন্য লঞ্চের সঙ্গে পাল্লা

অনলাইন ডেস্ক

এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে নতুন ইঞ্জিনে ত্রুটি থাকার কারণে গত বৃহস্পতিবার রাতে চলার সময় বিকট শব্দ হচ্ছিল। চিমনি দিয়ে স্বাভাবিকভাবে ধোয়া বের হচ্ছিল না। সেখানে আগুনের ফুলকি বা স্ফুলিঙ্গ বের হতে দেখা যায়। এর মধ্যেও অন্য লঞ্চের সঙ্গে পাল্লা দিতে অভিযান-১০-এর গতি বাড়ানো হয়।

এক পর্যায়ে ইঞ্জিন রুমে বিকট শব্দে ধোয়ার কুণ্ডলি বের হয়। তখন গোটা লঞ্চের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ইঞ্জিন রুম থেকেই লঞ্চে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। অভিযান-১০ লঞ্চের নিচতলার প্রত্যক্ষদর্শী যাত্রী ও লঞ্চের কর্মীদের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে ঘটনা তদন্তে তিনটি কমিটিই প্রাথমিকভাবে লঞ্চ কর্তৃপক্ষের অবহেলা খুঁজে পেয়েছে। কমিটির সদস্যরা বলছেন, আগুনের সূত্রপাত ইঞ্জিন রুম থেকে। আগুন লাগার পর তা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না করে লঞ্চ রেখে চলে যান চালক ও কর্মীরা। লঞ্চের ওপরে বয়া না রেখে খোলা রাখা হয়েছে। এ কারণে যাত্রীরা প্রাণ বাঁচাতে দ্রুত নদীতে নামতে পারেননি। অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রও ছিল না।

তদন্ত সূত্র জানায়, ইঞ্জিনের সিলিন্ডারের ফায়ারিং কডে ত্রুটির আলামত পাওয়া গেছে। এ কারণেও আগুন লাগতে পারে। বিশেষজ্ঞদের দেখিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত হবেন তদন্তকারীরা।

দুই মামলা, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

গতকাল অভিযান-১০ লঞ্চের মালিক হামজালাল শেখকে প্রধান আসামি করে বরগুনার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে  মামলা করেছেন উপজেলার এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান আইনজীবী নাজমুল ইসলাম নাসির।

মামলায় আসামি করা হয়েছে লঞ্চের মালিক হামজালাল শেখ, শামীম আহমেদ, রাসেল আহমেদ, ফেরদৌস হাসান এবং এ ছাড়া মাস্টার ইনচার্জ রিয়াজ আহমেদ, মাস্টার খলিলুর রহমান, ড্রাইভার ইনচার্জ মাছুম বিল্লাহ ও ড্রাইভার আবুল কালামকে।

অন্যদিকে ঢাকার নৌ আদালতে লঞ্চের মালিক হামজালাল শেখসহ আটজনের বিরুদ্ধে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক শফিকুর রহমান বাদী হয়ে আরেকটি মামলা করেন। গতকাল মামলাটি গ্রহণ করে আসামিদের নামে পরোয়ানা জারি করেছেন নৌ আদালতের বিচারক যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ জয়নাব বেগম।

ইঞ্জিনের ত্রুটি ও মামলার বিষয়ে জানতে গতকাল সন্ধ্যায় হামজালাল শেখের মোবাইল ফোনে কল করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন:


নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতিকে ৭ দফা প্রস্তাব ন্যাপের  


এমন ফুলকি বাইর হইতে দেখি নাই

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডের (ঘোষিত বার্ন) বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন অভিযান-১০ লঞ্চের লস্কর মো. সেলিম (৫০)।  তিনি বলেন, এর আগে গোসেরহাট রুটের শারুক-১ লঞ্চে কাজ করতেন। গত বৃহস্পতিবারই যোগ দেন অভিযান-১০-এ। সিঁড়ি ফেলা, ঝাড়ু দেওয়াসহ বিভিন্ন কাজ করে তিনি। রাত ২টার দিকে দ্বিতীয় তলায় নামাজের স্থানে ঘুমাতে যান। এর আগে তিনি নিচে বাথরুমে গেলে ইঞ্জিনে অনেক জোরে শব্দ ও আগুনের ফুলকি দেখেন। তখন একজন সুপারভাইজার চেয়ারে বসে ইঞ্জিনের অবস্থা তদারকি করছিলেন। সেলিম আরো বলেন, ‘১৪ বছরের চাকরি জীবনে ইঞ্জিন থেইকা এমন ফুলকি বাইর হইতে দেখি নাই। ওইখান থেকেই আগুন লাগছে। আগে বিস্ফোরণও হইছে। জোরে পাল্লা দিয়া চালানোর কারণে এ অবস্থা হইছে। ’

বিকট শব্দে ধোয়ার কুণ্ডলি বের হয়

লঞ্চের নিচতলায় ইঞ্জিনের কাছেই ডেকে ছিলেন বরগুনার বামনার মো. দুলাল (৪০)। তাঁর বাবা কাঞ্চন আলী শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দুলাল জানান, স্ত্রী হাওয়া বেগম, মা মিনারা বেগম, এক বছরের শিশু রায়হান ও সাত বছরের ছেলে রাব্বিকে নিয়ে তিনি ডেকে বিছানা পাতেন। তাঁর বাবা ও বড় ছেলে রিমন (১৫) ছিল দ্বিতীয় তলায়। রাতে টয়লেটে যাওয়ার সময় তিনি ইঞ্জিন রুম থেকে আগুনের ফুলকি বের হতে দেখেন। একসময় বিকট শব্দে ধোঁয়ার কুণ্ডলি বের হয়। এরপর দেখেন আগুন। তাড়াতাড়ি তিনি মা ও মেজ বাচ্চাকে নিয়ে লঞ্চের সামনে যান। বউ আর ছোট বাচ্চাকে খুঁজে পাননি। আগুন বাড়লে লঞ্চের লোকেরা গেট বন্ধ করে দেন। এ কারণে ভেতরে আর ওপরে বেশি লোক মারা গেছে।

সুপারভাইজারের জবানিতে ইঞ্জিন রুম 

লঞ্চের সুপারভাইজার আনোয়ার হোসেন গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, আগুনের ঘটনার সময় তিনি নিচতলার পেছনের একটি টয়লেটে ছিলেন। ওই সময় বাতি বন্ধ হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি বের হয়ে জানতে চান, বাতি বন্ধ হলো কেন? তখন তিনি তিনটি জেনারেটরের একটি চালু করতে গেলে দেখেন ইঞ্জিন রুমে আগুন। ওই সময় ড্রাইভার কালাম আর গ্রিজারম্যান সুমন দৌড়ে ‘বোতল কই, বোতল কই (অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র)’ বলছিলেন। মুহূর্তেই আগুন দোতলায়ও ছড়িয়ে পড়ে।

গতকাল ঝালকাঠির ঘাটে রাখা ক্ষতিগ্রস্ত লঞ্চটির স্থানে গিয়ে দেখা গেছে, ইঞ্জিনের ভেতরে দুটি গ্যাস সিলিন্ডার অখ্যাত আছে। সেখানে ড্রামে তেল রাখা ছিল। দুটি ড্রাম পড়ে থাকতে দেখা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য মতে, নিচে একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ইঞ্জিনের অংশ বিস্ফোরিত হয়েছে বলে ধারণা করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। বরিশাল বিভাগীয় প্রধান উপপরিচালক কামাল উদ্দিন ভুইয়া বলেন, ‘গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আলামত সেখানে আমরা দেখিনি। আগুন ইঞ্জিনের বা আশপাশের অন্য কিছু থেকে। ’

ইঞ্জিন রুম থেকেই আগুনের সূত্রপাত

গতকাল ঘটনাস্থল ও বরগুনায় প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। ইঞ্জিন রুম থেকেই আগুন লেগেছে, এ বিষয়ে তাঁরা অনেকটা নিশ্চিত।

বরিশাল বিআইডাব্লিউটিএর নির্বাহী প্রকৌশলী (নৌযান) বাহারুল আমীন বলেন, লঞ্চে যথেষ্ট পরিমাণ অগ্নিনির্বাপকের ব্যবস্থা ছিল না। লঞ্চটির ইঞ্জিন রুম খুবই জরাজীর্ণ। ইঞ্জিন রুমে আগুনের ফুলকি দেখার পরই অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ব্যবহার করা উচিত ছিল।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, আগুন লাগার পর দ্রুত লঞ্চটি তীরে নিয়ে গেলে এত লোকের মৃত্যু হতো না। লঞ্চের চালক সেটা করেননি। তাঁরা লঞ্চটিকে নদীর মাঝখানে রেখে চলে যান। ফলে মানুষ নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে, আগুনে দগ্ধ হয়েছে।   

তদন্ত কমিটির প্রধান যুগ্ম সচিব তোফায়েল হোসেন বলেন, ‘ইঞ্জিন রুম থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল বলে আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি। লঞ্চের মাস্টার প্রশিক্ষিত কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আর লঞ্চটিতে কারিগরি কোনো ক্রটি ছিল কি না তাও দেখা হবে। ’

আজ ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ

অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করা ২৩ জনের পরিচয় শনাক্তে আজ সোমবার স্বজনদের ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করা হবে। বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান জানান, যাঁদের স্বজন নিখোঁজ আছেন তাঁদের সবার ডিএনএ নমুনা গ্রহণ করে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হবে। সূত্র: কালের কণ্ঠ