মনমোহন সিংহ তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন শিবশঙ্কর মেনন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যাচ্ছিলাম চীন সফরে। প্রধানমন্ত্রীর বিমানে শিবশঙ্কর মেনন সাংবাদিকদের ব্রিফ করছিলেন সফর নিয়ে।
বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে হতে চীন কিভাবে মিয়ানমারের সীমান্তে সড়ক নির্মাণ করছে, বিভিন্নভাবে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে—এসবও উঠে এলো সেই আলোচনায়।
আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করছিলাম, যদি মিয়ানমারের সীমান্তে চীন সড়ক বানাতে পারে, তাহলে ভারতও সেই কাজটা করে না কেন? ভারতও তো উন্নয়নের প্রশ্নে তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সীমান্তে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে পারে। ভারতও তো মস্ত বড় একটা দেশ। ভারতও তো প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে বন্দর এবং সড়ক নির্মাণে একটা সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে। মিয়ানমারের ক্ষেত্রে ভারত কেন এ কাজে এগিয়ে আসছে না? চীন একতরফাই বা এমনটা করে কেন?
আমার বেশ মনে আছে, উত্তরে শিবশঙ্কর মেনন বলেছিলেন, ভারতের মতো একটা গণতান্ত্রিক বৃহৎ রাষ্ট্রে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কিছু অসুবিধা থাকে।
চীন এমন একটা রাষ্ট্র, যেখানে গণতান্ত্রিক নয়, কমিউনিস্ট একনায়কতন্ত্রের শাসন মেনে চলা হয়। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো যে সিদ্ধান্ত নেয়, সরকার বা রাষ্ট্র সেটা কার্যকর করে। আর যেহেতু সেখানে এই গণতান্ত্রিক বিতর্কের কোনো রাজনৈতিক পরিসর থাকে না, কাজেই ওদের পক্ষে এটা কার্যকর করা অনেক সহজ হয়ে যায়। আজ এত বছর পর এই বিতর্কের কথা যে আমার মনে পড়ছে, তার কারণ শুধু মিয়ানমার নয়, অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও কিন্তু চীন সড়ক বানাবে বলে হৈহৈ করে এগোচ্ছে। এখন বাংলাদেশের কাছ থেকেও তারা সমর্থন আদায় করতে চাইছে। পাকিস্তান রাজি হলেও বাংলাদেশ কিন্তু এখনো সম্মতি দেয়নি। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে মিয়ানমার পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোলাটে হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি মণিপুরের সীমান্ত এলাকায় আসাম রাইফেলসের ওপর জঙ্গি আক্রমণ হয়েছে। আক্রমণ এতটাই গুরুতর, যেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল বিপ্লব ত্রিপাঠী তাঁর স্ত্রী-পুত্রসহ নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আরো চারজন সেনা জওয়ানও নিহত হয়েছেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তদন্ত করে জানতে পেরেছে যে যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে সেই জঙ্গিরা পালিয়ে চলে গেছে মিয়ানমারে। তারা জঙ্গি কার্যকলাপের জন্য প্রশিক্ষণও নিয়ে এসেছে মিয়ানমার থেকে। মিয়ানমারের জঙ্গলে বেশ কিছু জঙ্গি ঘাঁটি, যেগুলো ভারতবিরোধী কার্যকলাপে ব্যস্ত, তাদের সন্ত্রাস দমন করা আজ অনেক বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। এই কারণে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা সম্প্রতি মিয়ানমার সফরে গেছেন। সেখানে গিয়ে তিনি এই সন্ত্রাস নিয়ে মিয়ানমারের সামরিক শাসনের সঙ্গে আলোচনা করছেন এবং প্রশ্ন তুলেছেন, কেন এই জঙ্গিরা ভারতবিরোধী কার্যকলাপে সক্রিয় হবে? কেন মিয়ানমার এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না?
আমি পাঠকবন্ধুদের স্মরণ করাতে চাই, একটা সময় ছিল, যখন বাংলাদেশেও উলফা জঙ্গিরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়েছে। সেই সময় তারা বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে থাকত। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর এই জঙ্গিদের দমন করা হয়েছে। আর ভারতবিরোধী কার্যকলাপে বাংলাদেশের মাটিকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন ভুটান থেকে তাড়া খেয়ে যেসব উলফা জঙ্গি বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছিল, তাদেরও সেখান থেকে তাড়ানো হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই উলফা জঙ্গিরাও মিয়ানমারের ঘাঁটিতে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং মিয়ানমারে জঙ্গি ঘাঁটি গড়ে তোলে। অবশ্য অনেক উলফা জঙ্গিকে দমন করা সম্ভব হয়েছে এবং এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার প্রভূত সাহায্য করেছে। বেশ কিছু উলফা জঙ্গিকে ফেরত পাঠিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। সেই প্রত্যর্পণ ব্যতিরেকে যারা এখনো রয়েছে, তারা মিয়ানমারের জঙ্গলেই লুকিয়ে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। জঙ্গিদের সংগঠন ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু ভারতবিরোধী জঙ্গিদের সন্ত্রাস মিয়ানমার থেকে হয়েছে—এই অভিযোগের ভিত্তিতে শ্রিংলা সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন এবং তিনি সেখানে গিয়ে সাক্ষাৎ করেছেন ওই দেশের সামরিক শাসনকর্তাদের সঙ্গে।
গত আগস্ট মাসে বাংলাদেশ সফরে গিয়েছিলেন হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। আর সেটাই ছিল তাঁর প্রথম বিদেশ সফর। তারপর করোনা বিপর্যয়ের মধ্যেও অক্টোবর মাসে সেনাপ্রধান মনোজ মুকুন্দকে সঙ্গে নিয়ে শ্রিংলা মিয়ানমারে গিয়েছিলেন। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল মিয়ানমারের এস্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে মিয়ানমার থেকে এ ধরনের জঙ্গি সন্ত্রাসমূলক কাজকর্ম না হয়। এবারও তিনি মিয়ানমারে গিয়ে সু চির দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করলেও সু চির সঙ্গে শ্রিংলাকে সাক্ষাৎ করতে দেয়নি জান্তা সরকার। এ ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ক্ষোভও প্রকাশ করা হয়েছে। সু চি বন্দি রয়েছেন। ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী কারাবন্দি অং সান সু চি। সেই জন্য শ্রিংলার এই সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এবার আসা যাক বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার সম্পর্কে। বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের সম্পর্ক অত্যন্ত সংবেদনশীল। চট্টগ্রাম থেকে মিয়ানমার সমুদ্রপথে কতটুকুই বা দূরত্ব। একটা সময় ছিল, যখন মানুষ চট্টগ্রামে বেড়াতে গেলে সেখান থেকে মিয়ানমারও ঘুরে আসত। এতটাই ছিল সেখানকার পর্যটনের প্রাসঙ্গিকতা। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হয় রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে। বাংলাদেশ থেকেই রোহিঙ্গাদের উৎপত্তি—এই অভিযোগ করে মিয়ানমার সরকার তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে উদ্যত হয়। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ওপর অভিবাসনের এই চাপ কিন্তু অর্থনীতির ওপর একটা মস্ত বড় কুপ্রভাব ফেলতে পারে। অথচ এই বাংলাদেশের মানুষ বলে চিহ্নিত সম্প্রদায় আসলে মিয়ানমারেই থাকতে আগ্রহী ছিল। তারা নিজেরাও বাংলাদেশে চলে আসতে চায়নি। তার কারণ দীর্ঘদিন ধরে এই রোহিঙ্গা সম্প্রদায় মিয়ানমারে থেকে তাদের জনবসতির যে সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যেটাকে ইংরেজিতে বলে হ্যাবিট এবং হ্যাবিট্যাক্ট, সেই পরম্পরাকে নষ্ট করে, তাদেরকে জোর করে সেখান থেকে চলে আসতে বাধ্য করা হয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রবল প্রতিবাদ জানায়। বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের কাছেও দাবি জানায়, যাতে এ ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপরে তারা চাপ সৃষ্টি করে।
বেশ কিছুদিন ধরে নরেন্দ্র মোদি দোটানায় ছিলেন। কারণ তিনি মনে করেন, মিয়ানমারের সঙ্গে সেনা শাসনের বিরুদ্ধে সংঘাতের পথে যাওয়া কখনো রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নয়। তার একটা মস্ত বড় কারণ হলো, চীন মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলছে। চীন-পাকিস্তান অক্ষ যদি মিয়ানমারকেও সঙ্গে নিয়ে নেয়, যেখানে নেপাল থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত চীন তাদের ড্রাগনের থাবা বিস্তারিত করছে, সেখানে মিয়ানমারের সঙ্গে সংঘাতের পথে গেলে কিন্তু ভারতের বিপদ বাড়বে। কাজেই বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার—এই দুটি দেশের মধ্যে মোদি সরকারের একটা Tug of war চলছিল।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ না মিয়ানমারের অগ্রাধিকারকে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হবে—এসব নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে শ্রিংলা তাঁর প্রথম বাংলাদেশ সফরে গিয়ে এই বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলেন যে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে ভারত আলোচনা করবে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে একটা সেফ প্যাসেজ তৈরি করা হবে, একটা রুট তৈরি করা হবে—এসব আশ্বাস কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে দেওয়া হয়েছিল।
এত কিছুর পরও কিন্তু মিয়ানমারনীতিতে বদলটা বাংলাদেশ সরকার তেমনভাবে দেখতে পাচ্ছিল না। তাই চাপ সৃষ্টি করছিল। এরই মধ্যে আফগানিস্তানে তালেবান সরকার গঠন হয়েছে, ভারত এবং বাংলাদেশের সম্পর্কের মধ্যে অনেক টানাপড়েন হয়েছে, প্রতিষেধক দেওয়া থেকে শুরু করে, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের চেষ্টা চীনের সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। এ রকম নানা ঘটনা, যেটা ভারত সরকারকে নানাভাবে চিন্তায় ফেলেছে।
এবার যখন মিয়ানমার থেকে জঙ্গিরা এসে ভারতে আক্রমণ করছে তখন ভারত তার নিজের সার্বভৌম স্বার্থে এই ব্যাপারে আরো বেশি সক্রিয় হয়েছে। আসলে ‘সব ভালো যার শেষ ভালো তার। ’ অর্থাৎ এখন বাংলাদেশের বিষয়টি নিয়েও ভারত সরকার মিয়ানমারের ওপরে চাপ সৃষ্টি করেছে। অর্থাৎ হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বাংলাদেশ সরকারকে যে আশ্বাস দিয়েছিলেন, সেটা কিন্তু তিনি এবারে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন।
আমরা ছোটবেলায় মিয়ানমার বলতাম না, বলতাম বার্মা। বার্মার আগেও যে নামটা জনপ্রিয় ছিল সেটা হলো রেঙ্গুন। এই রেঙ্গুন থেকে ভারতেও তো কম মানুষ আসেনি। বলিউডের বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী হেলেনের জন্ম হয়েছিল বার্মায়। শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের একটা খণ্ডই হলো রেঙ্গুনকে কেন্দ্র করে। ভারত থেকেই শ্রীকান্ত রেঙ্গুনে গিয়েছিল। সেই রেঙ্গুনের কথা শরত্চন্দ্রের সাহিত্যের ছত্রে ছত্রে রয়েছে। বাঙালি অভিনেত্রী সুপ্রিয়া চৌধুরীও রেঙ্গুনের মানুষ। তাঁর বাবা রেঙ্গুনে কাঠের ব্যবসা করতেন। সেখান থেকেই তাঁরা কলকাতা শহরে আসেন। বাংলাদেশেও বহু মানুষ তৎকালীন রেঙ্গুন থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এ সবই হলো দেশ বিভাগের আগের কথা।
আজ এত বছর পর সাংস্কৃতিক দিক থেকে ভারত, বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার—একটা সুন্দর সুসম্পর্কের ত্রিভুজ হতে পারত। কেননা সাংস্কৃতিক দিক থেকে এই তিনটি দেশের মধ্যেই ভীষণভাবে একটা সুসম্পর্কের ইতিহাস আছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী বারবার মিয়ানমারে গিয়েছেন, সেখানকার সব ভারতীয় স্মৃতি এবং মনীষীদের স্মৃতিচিহ্নগুলো দেখতে এবং সেগুলোকে বারবার স্মরণ করিয়েছেন শুধু সম্পর্ককে পুনরুদ্ধারের জন্য। এত বছর পর যদি এই সম্পর্কে চিড় ধরে! ভারতে এখন নরেন্দ্র মোদি ‘লুক ইস্ট’ থেকে ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ পলিসিতে গেছেন। অর্থাৎ পূর্বের দিকে শুধু তাকানো নয়, এখন ‘অ্যাক্ট’ অর্থাৎ কার্যকর করতে হবে সেই পররাষ্ট্রনীতিকে।
প্রতিবেশীই আগে, প্রতিবেশীই প্রথমে—এই নীতিটাও ভারত ঘোষণা করেছে। তার ফলে চীন-পাকিস্তান অক্ষ যখন মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ককে সুমধুর করে ভারতবিরোধিতার লাইন নিতে চাইছে, তখন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক রাখাটা আরো বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে গেলে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কটা যেমন নষ্ট করাও যাবে না, আবার কঠোর নীতিও নিতে হবে, যাতে মিয়ানমারকে বোঝানো সম্ভব হয় যে এই সন্ত্রাস এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের নীতিতেও বদল আনতে হবে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে নতুন বছর ২০২২ শুরুর সময় শ্রিংলার এই মিয়ানমার সফর যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ শুধু নয়, আগামী দিনের জন্যও অনেক আশাব্যঞ্জক বলে মনে করা যেতে পারে।
কালের কণ্ঠের সৌজন্যে
news24bd.tv/ কামরুল