প্রকৃতি প্রেমী আলম : বাঘসহ প্রাণ বাঁচিয়েছে ২০০ বন্য প্রাণীর

প্রকৃতি প্রেমী আলম : বাঘসহ প্রাণ বাঁচিয়েছে ২০০ বন্য প্রাণীর

শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট

সুন্দরবনের প্রাণ প্রকৃতি প্রেমী আলম হাওলাদার (৩২) ১৬ বছরে ৪০টি বাঘসহ ২০০ বন্যপ্রাণির জীবন বাঁচিয়েছে। সুন্দরবন থেকে লোকালয়ে চলে আসা রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, কিং কোবরা, পাইথনসহ শতাধিক বিষধর সাপ, শুকর, বানরসহ উদ্ধার করে বনে ফিরিয়ে দিয়েছেন। সুন্দরবন সন্নিহিত বাগেরহাটের শরণখোলা চালিতাবুনিয়া গ্রামের মজিবর রহমান হাওলাদারের ছেলে আলম ছোটবেলা থেকেই তার সুন্দরবনের প্রাণ প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচয়। বলতে গেলে বনেই তার বেড়ে ওঠাও।

সে কারণে বন্যপ্রাণির প্রতি টান একটু বেশিই।

 ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে পর পর সুন্দরবন থেকে তার গ্রামে পর পর দুটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার ঢুকে পড়ে। গ্রামবাসী পিটিয়ে মেরে ফেলে সেই বাঘ দুটিকে। বাঘ মারতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে আহত হন কয়েক জন গ্রামবাসীও।

ওই দুটি বাঘের নির্মম মৃত্যুদৃশ্য খুব কাছ থেকে দেখে তার কিশোর মন আবেগতাড়িত হয়ে ওঠে। সেদিন থেকে প্রতিজ্ঞা, বড় হয়ে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণে মানুষকে সচেতন করে তোলার কাজে জড়িত হবেন। যে কথা সেই কাজ। আলম আজ ১৬ বছর ধরে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণি রক্ষায় কাজ করে চলেছেন।
 
বিগত ২০০৪ সালে ‘সুন্দরবন টাইগার প্রজেক্ট’ নামে বাঘ সুরক্ষায় একটি প্রকল্প গ্রহন করে সুন্দরবন বিভাগ। এই প্রকল্পের মাধ্যমেই বন্যপ্রাণি সংরক্ষণে আলমের সেই ছোট বেলার লালিত স্বপ্ন পুরণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ২০০৫ সালে এসএসসি পাস করে কিশোর আলম পরিবারের বাধা উপেক্ষা করে তখন নিজ ইচ্ছায় সেই প্রকল্পে যুক্ত হন। ওই প্রকল্প শেষ হওয়ার পর বন বিভাগের সহযোগিতায় ভিলেজ টাইগার সেরপন্স টিম (ভিটিআরটি) নামে আরেকটি প্রকল্প চালু হয়। একই সাথে শুরু হয় ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ (ডব্লিউটিবি) নামে আরেকটি প্রকল্প। আলম এসময়েে মধ্যে সুন্দরবন থেকে লোকালয়ে আসা কমপক্ষে ৪০টি বাঘ বনে ফিরিয়ে দেয়ার কাজে অংশ নিয়েছেন।  

এছাড়া, এককভাবে কিং কোবরা ও পাইথনসহ শতাধিক বিষধর সাপ, ১২টি হরিণ, ২০টি শুকর, পাঁচটি বানরসহ অসংখ্য স্থানীয় প্রজাতির পশু-পাখি লোকালয় থেকে উদ্ধার করে সুন্দরবনে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আলমের ভষ্যমতে, বিগত ১৬ বছর ধরে ৪০টি বাঘসহ দুই শতাধিক বন্যপ্রাণির জীবন সুরক্ষায় করেছে। সুন্দরবন থেকে বাঘের আক্রমণে আহত এপর্যন্ত ১৭ জন জেলে, বাওয়ালী ও মৌয়ালীকে উদ্ধার করে চিকিৎসা করিয়েছেন। দিন-রাত নেই, গ্রামের কোথাও বন্যপ্রাণি আসার খবর পেলেই ছুঁটে যান সেখানে। অভিজ্ঞতা অর্জনে সুন্দরবন ও পাহাড়ি বন সবখানেই তার বিচরণ। বন্যপ্রাণি সংরক্ষণের বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন দেশ-বিদেশে। বর্তমানে এসব সংগঠনের হয়ে সুন্দরবন সন্নিহিত পাঁচটি জেলার শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ, মোংলা, পাথরঘাটা, মঠবাড়িয়া, দাকোপ, কয়রা ও শ্যামনগর এই ৮টি উপজেলায় বন্যপ্রাণি রক্ষা এবং প্রাণি ও মানুষের মধ্যে দ্ব›দ্ব কমিয়ে আনতে সচেতনতামূলক কাজ করে চলেছেন আলম।  

আলম হাওলাদার জানান, ২০০৬ সালে বাঘ জরিপ কালে বন বিভাগের সাথে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কচিখালীতে যান। সে সময়ে সকালে সুন্দরবনের ভেতর থেকে যাওয়ার সময় একটি বাঘ হঠাৎ ঝোপের মধ্যে থেকে বেরিয়ে তেঁড়ে আসে তাদের দিকে। সঙ্গীরা ৬-৭ জন বাঘ দেখে পাশের খালে লাফিয়ে পড়ে। তখন জীবনের মায়া ছেড়ে দিয়ে লাঠি হাতে আলম এবং অস্ত্রধারী এক বনরক্ষী বাঘের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যান। তখন বাঘটিও থমকে যায়। একপর্যায়ে তাদের প্রতিরোধের মুখে বাঘটি পাশ থেকে লাফ দিয়ে গহীন বনে চলে যায়। সুন্দরবনের সাতক্ষীরার শ্যামনগরে ২০১১ সালে ১৯ ফেব্রুয়ারি কইখালী ফরেস্ট ক্যাম্পের কাছে গোলাখালী গ্রামে ওইদিন বিকেলে একটি বাঘ ঢুকে পড়ে। টিমের সদস্যদের নিয়ে বাঘটি কৌশলে বনে ফিরিয়ে দেন। একইদিন সন্ধ্যার পর আরো একটি বাঘ আবার চলে আসে ওই গ্রামে। বন বিভাগের লোকজন কোনোভাবেই বাঘটি বনে ফেরাতে পারছিলেন না।

 তখন আলম তার টিম নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে রাত অনুমান দেড়টার দিকে প্রথমবার তিনি নিজ হাতে বাঘের শরীরে বন্দুকের (ট্রাংকুলাইজার গান) মাধ্যমে চেতননাশক ইনজেকশন পুশ করে বাঘটি ধরাশাই করেন। পরে সুন্দরবনে অবমুক্ত করা হয় ওই বাঘটি। সুন্দরবন থেকে শুরু করে পাহাড়ি বনাঞ্চলসহ সর্বত্র কাজ করার পাশপাশি প্রতিবেশী দুটি দেশেও সফর করেছে সে। বাঘ গণনার জন্য ক্যামেরা ট্রাপিং এবং বন্যপ্রাণি সংরক্ষণে প্রশিক্ষণ গ্রহনের জন্য ২০০৯ সালে ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশের হয়ে নেপাল যান। নেপালের চিতন ন্যাশনাল পার্কে ক্যামেরা ট্রাপিং এবং বাঘ নিয়ে কাজ করার হাতে কলমে প্রশিক্ষণ নেন। ২০১৯ সালের জুন মাসে সপ্তাহব্যাপী ভারতে গিয়ে সেদেশের ভিটিআরটি দলের সঙ্গে বাংলাদেশর বাঘ ও বন্যপ্রাণি সংরক্ষণের অভিজ্ঞতা ও কৌশল বিনিময় করেন। সেই থেকে বাঘ ও বন্যপ্রাণি রক্ষায় বাংলাদেশের কৌশলকে ভারতের ভিটিআরটি দল মডেল হিসেবে নিয়ে কাজ করে যচ্ছে বলে জানান আলম।  

সুন্দরবনের এই বন্যপ্রাণি প্রেমিক আলম আরও জানান, বন্য ও স্থানীয় প্রজাতির প্রাণি সংরক্ষণে আমি আজীব কাজ করে যাবো। বন বিভাগ এই সুযোগ করে দেয়ায় তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে ভবিষ্যতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রাণি সংরক্ষণে একটি সংগঠন গড়ে তোলার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে  সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে সকলের সহযোগিতা চায় আলম। মানুষ যাতে বন্য প্রাণিকে শত্রু ভেবে হত্যা না করে সেজন্য একটি সংগঠনের মাধ্যমে জনসচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যেতে বন বিভাগসহ সকলের সার্বিক সহযোগিতা চায় আলম হাওলাদার।
news24bd.tv/আলী