দেশের শীর্ষস্থানীয় চিনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নাটোর সুগার মিল। মানসম্পন্ন চিনি উৎপাদনে সুনাম অর্জন করলেও বর্তমানে আর্থিক সঙ্কটে মুখ থুবড়ে পড়ছে চিনিকলটি। মার্চের পর প্রতিষ্ঠানটির সাড়ে ৬শ কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকের বেতন-ভাতা, ওভারটাইম ও মজুরি দিতে পারেনি চিনিকলটি।
টাকার পরিবর্তে দেয়া চিনি নিয়েও কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
মিলের তালিকাভুক্ত এক এসইডিও চিনির দামের ওপর শতকরা ৫ ভাগ কমিশন বাগিয়ে নিচ্ছেন। সেই সাথে জুড়ে দিয়েছেন আরো শর্ত।এ নিয়ে গতকাল সুগার মিলে গেট মিটিং ডেকে কমিশন বাণিজ্যের প্রতিবাদ জানিয়ে নায্য পাওনাদি পরিশোধের দাবি জানানো হয়েছে।
সরেজমিন নাটোর সুগার মিল ঘুরে দেখা যায়, গুদামে মজুদ বস্তা-বস্তা চিনি।
এক পর্যায়ে মজুরি দিতে না পারায় বিকল্প হিসেবে মিল কর্তৃপক্ষ সমপরিমাণ অর্থের চিনি শ্রমিক-কর্মচারীদের দেয়ার প্রস্তাব দেয়। শুরুতে রাজি না হলেও শ্রমিক কর্মচারীদের কেউ কেউ নিরুপায় হয়ে চিনি নিতে সম্মত হয়। বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে চিনি বিক্রি করেও পাওনাদি আদায়ে কমিশন বাণিজ্যের শিকার হচ্ছে শ্রমিক-কর্মচারীরা।
তাদের অভিযোগ, চিনি বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে তার ওপর ৫% কমিশন দাবি করছে সুগার মিলের এসইডিও ও স্থানীয় ব্যবসায়ী কামাল হোসেন। এককভাবে কামাল হোসেনকে চিনি দিলেই তিনি সুগার মিলের মজুদ চিনি কিনবেন- এমন শর্তে মিল কর্তৃপক্ষ তার নিকট চিনি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই সুযোগে তিনি শ্রমিক-কর্মচারীদের থেকে ৫% কমিশন বাগিয়ে নিচ্ছেন। তাদের দাবি, এই কমিশন বাণিজ্যের নেপথ্যে রয়েছেন ব্যবস্থাপকসহ মিল প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা।
এদিকে, মিল পাওনাদি পরিশোধ না করায় মানবেতর জীবনযাপন করছে শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের ভয়, গণমাধ্যমের সাথে এ নিয়ে কথা বললে, ছোট ছোট অভিযোগ এনে নোট দিয়ে চাকুরিচ্যুত করা হয়। এমনকি সময়মত মজুরি না পাওয়ায় এক শ্রমিকের সন্তান এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারেনি।
বয়লার হাউজের শ্রমিক আবু তালেব বলেন, ঈদের আগে মজুরি কমিশনের অগ্রিম টাকা পাইনি। তার ওপর ২ মাসের বেতনও বকেয়া। ধার-দেনা করে ঈদ পার করেছি, এখন আর চলার সামর্থ্য নেই।
মিলের ওয়ারিং ও বিদ্যুৎ হাউজের কর্মচারী বাবর আলী বলেন, ৩ মাস ধরে বেতন পাই না। চাইতে গেলে মিল কর্তৃপক্ষ বলে, টাকা নেই। ৫% কমিশনে চিনি বেচে বেতন নেন।
হিসাব বিভাগের জ্যেষ্ঠ করণিক সাহেব আলী বলেন, ওভারটাইম, বকেয়া বেতন, বাড়ি ভাড়াসহ ২ মাসের বেতন দিচ্ছে না মিল কর্তৃপক্ষ। চিনি দিতে চাইছে বাজারের চেয়েও কম দামে। আবার সেই চিনি বিক্রি করতেও ৫% কমিশন দিতে হবে ক্রেতাকে, এটা মেনে নেয়া যায় না। কমিশনের বিনিময়ে বেতন-ভাতা গ্রহণ করবো না আমরা।
শ্রমিক জালাল উদ্দীন বলেন, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের গৃহীত কমিশনের সিদ্ধান্ত মানি না। কাজ করেছি বেতন পাওয়ার জন্য। অথচ টাকা দিয়ে বেতন নেয়ার কথা বলছে ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
চিনিকল শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, বেতন-মজুরি সাড়ে ৬শ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নায্য অধিকার। সকলে একমত হয়েছে কমিশন দিয়ে বেতন না নিতে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে শিল্পমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শরীফুল ইসলামও শীর্ষস্থানীয় এ চিনিকলের ৬ শতাধিক কর্মকর্তা-শ্রমিক-কর্মচারীর পাওনা পরিশোধ করতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি বলেন, ৫% কমিশন দিয়ে শ্রমিক-কর্মচারীরা বকেয়া বেতন নিলে অবশিষ্ট কিছুই থাকে না। এখানকার কর্মকর্তা-শ্রমিক-কর্মচারীরা তাদের নায্য পাওনাদি না পেলে ভবিষ্যতে চিনি উৎপাদনে উৎসাহ হারাবে। তখন চিনিশিল্প মুখ থুবড়ে পড়বে।
এ ব্যাপারে মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদ উল্লাহ মিলের আর্থিক সঙ্কটের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, চিনি বিক্রির টাকা থেকে গত ফেব্রুয়ারী ও মার্চ মাসের বেতন দেয়া হয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। সরকারের বেঁধে দেয়া ৫০ টাকা কেজিতে ব্যবসায়ীরা চিনি কিনতে চান না। তাই চিনি অবিক্রিত থাকছে এবং বকেয়া বেতন-ভাতা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
অনান্য মিলগুলোতে নির্দিষ্ট কমিশনের বিনিময়ে চিনি বিক্রি করেই বকেয়া পরিশোধ করা হচ্ছে জানিয়ে সঙ্কট নিরসনে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।
নাসিম/অরিন/নিউজ টোয়েন্টিফোর