প্যারেন্টিং বা মা-বাবার দায়িত্ব ব্যাপারটাই একটা প্রসিডিওর

প্যারেন্টিং বা মা-বাবার দায়িত্ব ব্যাপারটাই একটা প্রসিডিওর

এমি জান্নাত

আমরা অনেকেই প্যারেন্টিং নিয়ে কথা বলি। অর্থাৎ সন্তানের প্রতি মা-বাবার আচরণ এবং দায়িত্ব। শিশুর শারীরিক, মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক সকল কিছুর দায়িত্ব পালন। অনেক কথাই শুধু বলার জন্য বলে থাকে অনেকে।

কিন্তু সেটার পরবর্তী কার্যকারিতা নিয়ে অনেক সময় ভাবা হয় না। আর অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার অন্যতম হলো সন্তানের প্রতি আচরণ।

একটি শিশু জন্মের পর থেকেই কিছু না কিছু শিখতে শুরু করে। আর প্রথম শিক্ষা অবশ্যই মা অথবা মাতৃতূল্য কারও কাছ থেকেই পায়।

মাতৃতূল্য বলছি এই জন্য যে যারা জন্মের পর কোনো কারণে মাকে পায়না। সেটা হতে পারে মৃত্যু বা অপ্রত্যাশিত কিছু। সেই সংখ্যা নিতান্ত কম তাই অধিকাংশ নিয়েই বলি। মায়ের কাছে শিশু প্রথম ভাষা শেখে যেটা তার মাতৃভাষা। মায়ের অনেক আচরণ সে বড় হতে হতে ধারণ করে ফেলে। তাই বাবা এবং পরিবারের অন্য সদুস্যদের তুলনায় অন্তত প্রাথমিক দায়িত্বটা মায়েরই বেশি থাকে। তাই নিজের সন্তানকে কীভাবে বড় করতে চান সেটা প্রথম ধাপেই সফল হওয়ার চেষ্টা করাটা খুব জরুরি। কারণ প্রথম কয়েকটা বছরেই শিশুর বেসিক অর্থাৎ ভিত্তিটা গঠন হয়ে যায়। আর সুষ্ঠু পরিবেশ পেলে সেটা সুষ্ঠুভাবেই গড়ে ওঠে।

শিশু যখন একটু বড় হয় তখন পরিবারের সকলের দায়িত্ব এসে পরে তাকে সঠিক পথ দেখানোর। যেহেতু প্যারেন্টিং নিয়ে কথা বলছি তাই মা-বাবা দুজনকেই তখন সমান ভূমিকা পালন করতে হয়। কিন্তু দেখা যায় অনেক মা-বাবাই অন্যের শিশুর শিক্ষা নিয়ে কথা বলছে বা তাকে কীভাবে গড়ে তুলবে সেই পরামর্শ দিচ্ছে। কিন্তু নিজের সন্তানের ক্ষেত্রে সেটা প্রয়োগ করতে পারছে না। তখন এটা নিছকই বলার জন্য বলা বা নিজেকে জাহির করার মতো ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে।

প্রথমত, নিজের সন্তানকে শিষ্টাচার, মূল্যবোধ, সততা এইসব মানবিক গুণাবলি শেখানোর সর্বচ্চ চেষ্টা করতে হবে। হ্যাঁ, এর মধ্যে অনেক কিছুই সে নেবে, আবার অনেক কিছুই জেনেটিক্যালি কিংবা জন্মগতভাবে পাওয়া স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের জন্য গ্রহণ করবে না। তবে শিশুর চারপাশের পরিবেশ তার উপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। সেটা যতটা ইতিবাচকভাবে আপনি তার সামনে উপস্থাপন করবেন সে ততটা ইতিবাচক মনোভাব নিয়েই বড় হবে। আর মা-বাবা হিসেবে প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব হলো শিশুর ভিত্তিটা সঠিকভাবে গড়ে তোলা।

ইতিবাচক পরিবেশ তৈরির অনেকগুলো পথ থাকে। যেমন, শিশুকে সরাসরি কোনো কাজে "না" শব্দটি না বলে সেই ব্যাপারটা কেন করা যাবে না সেটা বুঝিয়ে বলা। এটারও একটা উদাহরণ হতে পারে, আপনার শিশু কোনো প্রাণীকে বা অন্য কোনো শিশুকে আঘাত করছে। সেটা আপনি তাকে শেখাননি কিন্তু কোথাও দেখে শিখেছে। তখন তাকে  যদি রেগে বলেন; এটা করবে না, তখন তার মনে আরও জেদ চেপে বসবে সেটা করার জন্য। বরং এই আঘাতের জন্য অন্যের কষ্ট হচ্ছে এবং তার সাথে ঘটলে তারও কষ্ট হবে, এটা বোঝালে সে বিষয়টা অনুভুতির মধ্যে দিয়ে উপলব্ধি করবে।

আরেকটা বিষয় খুব কমন দেখা যায়, অনেক মা-বাবা কিংবা দাদা-দাদী, নানা-নানী করে থাকেন যে শিশু পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলে কিংবা কোনো কিছু দিয়ে আঘাত পেলে অথবা অন্য শিশু তাকে আঘাত করলে তাদেরকে পালটা আঘাত করে তাকে শান্ত করা হয়। কিন্তু এটা আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ বিষয় মনে হলেও এর ভয়াবহ দিক হলো, শিশুটি প্রতিশোধপরায়ণতা শেখে, আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু আপনি যদি বলেন, ও তোমাকে ব্যথা দিয়েছে, ওকে আদর করে দাও। তাহলে ও আর তোমাকে ব্যথা দিবে না। এতে শিশুটি ক্ষমাশীল হতে শেখে, উদারতা শেখে। তারপর যেকোনো কিছু সবার সাথে ভাগ করে নেওয়া। হতে পারে খাবার বা জামা-কাপড়। তার সমবয়সী বা অন্যদের সাথে খাবার শেয়ার করা, বেশি জামা-কাপড় হলে কাউকে উপহার দেওয়া এগুলো একটা শিশুর মানবিক গুণাবলি বাড়াতে সুদুরপ্রসারি ভূমিকা রাখে।

এই ছোট ছোট বিষয়গুলো যদি শুরু থেকেই গুরুত্বের সাথে দেখা যায় তাহলে পরে মা-বাবাকেও খুব একটা চাপ নিতে হয় না শিশুর আচরণ নিয়ে। কারণ চাইল্ড সাইকোলজি বা শিশুর মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো খুব সংবেদনশীল। একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, চাপ দিয়ে বা জোর করে কোনো কাজ যে কাউকে দিয়ে করাতে চাইলেই সেটা খুব একটা ফলপ্রসূ হয় না। আর শিশুর সংবেদনশীল মনে কখনোই চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। শিশুরা স্বভাবতই অনুকরণপ্রিয়। তাই নিজের আচরণকেও তার কাছে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরতে হবে। নিজেদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, অন্য সবাইকে সম্মান করা, সবার সাথে সৌহার্দপূর্ণ ব্যবহার করা এই বিষয়গুলো আপনাকে অনুকরণ করেই সে শিখবে।

প্যারেন্টিং ব্যাপারটাই একটা প্রসিডিওর। যার মাধ্যমে শিশুর জন্মের পর থেকে নিজে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারার সময় পর্যন্ত মা-বাবার দায়িত্ব তাকে হাতে কলমে শিক্ষার পাশাপাশি নিজেদের আচরণ দিয়ে শেখানো। এটা প্র‍্যাকটিক্যালি করতে হয় বলেই  প্র‍্যাকটিসটাও সঠিক নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে আনতে পারলে সুফল পাওয়া যাবে।

লেখা : এমি জান্নাত, সাংবাদিক।

( সোশ্যাল মিডিয়া বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv তৌহিদ

এই রকম আরও টপিক