ঋণখেলাপি ও দুর্নীতিবাজরা আগামী নির্বাচনে যেন মনোনয়ন না পায় : ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

অতিথিদের সঙ্গে যৌথভাবে বিজয়ী দলের বিতার্কিকরা

ঋণখেলাপি ও দুর্নীতিবাজরা আগামী নির্বাচনে যেন মনোনয়ন না পায় : ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

অনলাইন ডেস্ক

আর্থিক খাতে যোগ্যতা, দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা না গেলে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। স্বাধীনতাবিরোধী, ঋণখেলাপি, করখেলাপি, বিলখেলাপি, দুর্নীতিবাজরা যেন আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারে সে বিষয়ে নতুন নির্বাচন কমিশনকে দৃঢ় অবস্থান দেখাতে হবে। ব্যাংকগুলো মধ্যরাতে সভা করে ঋণখেলাপিদের যেভাবে দায়মুক্তি দিয়ে নির্বাচন করার সুযোগ দেয় তা নৈতিকতা বিরোধী। যে পরিমাণ ঋণ আদায় করা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি অবলোপন করা হচ্ছে।

ব্যাংকিং সেক্টরে ১০ শতাংশ ঋণখেলাপির যে তথ্য দেওয়া হয় সেটিও সঠিক নয়। কোনো ঋণখেলাপি যাতে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স এর সদস্য হতে না পারে সে বিষয়ে ব্যাংক মালিকদের সতর্ক থাকতে হবে। একই সাথে ঋণখেলাপি ও আর্থিক খাতে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক ঘৃণা ছড়িয়ে দিতে হবে।

আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সদিচ্ছা ও যোগ্যতার অভাব রয়েছে।

তাই ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা এড়িয়ে চলে। গণতন্ত্র ও সুশাসনের পাশাপাশি আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখা টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন টেকসই হবে না। অনেক দৃশ্যনীয় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাবে শ্রীলংকার মতো দেশকে বাংলাদেশ থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে।

আজ শনিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) এফডিসিতে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির আয়োজনে ‘আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারের সদিচ্ছ’ শীর্ষক ছায়া সংসদে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।

সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা দিন দিন ক্যান্সারের রূপ ধারণ করছে। যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতির পরিধি সংকুচিত করছে। আর্থ সামাজিক খাতে বাংলাদেশের উন্নয়ন অব্যাহত থাকলেও আর্থিক খাতের অনিয়ম আমাদের জন্য একটি কালো অধ্যায়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে সরকার গর্ববোধ করলেও ব্যাংকিং খাতের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা লজ্জিত হই। দেশে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, উন্নয়ন হচ্ছে আবার মহালুটপাটও হচ্ছে।

কিরণ বলেন, দেশে আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় দুষ্টু ক্ষত হলো ঋণ জালিয়াতি ও অর্থপাচার। এতে ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি সরকারি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সম্পৃক্ত। করোনা মহামারির দেড় বছরে দুবাইয়ে আবাসন খাতে চীনকে পেছনে ফেলে পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে বেশি বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশিরা।

জানা গেছে, এক শ্রেণির বাংলাদেশি ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও আমলারা শুধু বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের জন্য গত দেড় বছরে বিনিয়োগ করেছে ২৮৮ কোটি টাকা। এছাড়াও দুবাইয়ের বিভিন্ন ব্যাংকে কী পরিমাণ টাকা বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করে জমা করেছে এবং দুর্নীতির অর্থ বিনিয়োগ করেছে তার সঠিক হিসাব জানা যায়নি। বাংলাদেশ থেকে গত এক দশকে ৩২ জন ২০ লাখ পাউন্ড বাংলাদেশি টাকায় ২৪ কোটি টাকা করে বিনিয়োগের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে গোল্ডেন ভিসা সংগ্রহ করেছে। অভিবাসী ভিসা নামে এই সুবিধাটি অতি ধনীরা নিয়ে থাকে।

আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা রক্ষায় ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ ১০ দফা সুপারিশ প্রদান করেন।

সুপারিশগুলো হচ্ছে : 
১. অর্থপাচার প্রতিরোধে কঠোর অবস্থানের পাশাপাশি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন।
২. দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের সাথে জড়িত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ সকল দুর্নীতিবাজদের তালিকা জাতীয় সংসদ সহ গণমাধ্যমে প্রকাশ।
৩. ব্যাংকিং খাতের আত্মসাৎকৃত অর্থ আদায়ে ও অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার করা।
৪. ঋণ জালিয়াতি ও অর্থপাচার রোধে সর্বদলীয় রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা।
৫. বড় বড় ঋণখেলাপীরা যাতে কেউ বিদেশে যেতে না পারে তার জন্য নৌ, স্থল ও বিমানবন্দরগুলোতে তাদের তালিকা পাঠানো।
৬. রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগ না দিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরে সুনামের সাথে কাজ করেছেন এমন দক্ষ পেশাদার ব্যক্তিকে এসব পদে নিয়োগ দেওয়া।
৭. ব্যাংকিং খাতে অভিজ্ঞ নয় এমন ব্যক্তিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ না দেওয়া।
৮. নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তা যাচাই করা।
৯. চরম লোকসানে নিপতিত ব্যাংকগুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করা।
১০. সুইস ব্যাংক সহ বিদেশে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে পাচার করা অর্থের পরিমাণ ও পাচারকারীদের নাম সংগ্রহের জন্য সমঝোতা চুক্তি করা।

বিতর্ক প্রতিযোগিতায় সমান নাম্বার পেয়ে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিতার্কিকরা যৌথভাবে বিজয়ী হয়। প্রতিযোগিতা শেষে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মাঝে ট্রফি ও সনদপত্র বিতরণ করা হয়। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন ড. এস এম মোর্শেদ, সাংবাদিক রেজাউল হক কৌশিক, সাংবাদিক কাবেরী মৈত্রেয় ও সাংবাদিক রিজভী নেওয়াজ।