আমার স্বপ্নের এই বিজয় অবশ্যই বিশ্ব জয় করবে

সংগৃহীত ছবি

আমার স্বপ্নের এই বিজয় অবশ্যই বিশ্ব জয় করবে

মোস্তাফা জব্বার

সবাই জানেন ১৬ মে ১৯৮৭ তারিখে বাংলা সাপ্তাহিক আনন্দপত্র প্রকাশ করে আমি কম্পিউটার দিয়ে বাংলা পত্রিকা প্রকাশের যুগে প্রবেশ করি। তখন আমরা সৈয়দ মাইনুল হাসানের মাইনুল লিপি ব্যবহার করেছিলাম। মুনীর কি-বোর্ড অনুসরণ করে চার স্তরের কি-বোর্ডটা আমিই বানিয়েছিলাম, যার নাম ছিল জব্বার কি-বোর্ড, আমার বাবার নামে নাম। কিন্তু কি-বোর্ডটির সমস্যা ছিল ১৮৮টি বোতাম মুখস্থ রেখে বাংলা টাইপ করতে হতো।

বিজয়ের জন্মের পেছনে প্রযুক্তিগত প্রধান কারণ এটি। টাইপরাইটার, সিসার কম্পোজ বা ফটোটাইপসেটারে বাংলা লিখতে গিয়ে অনুভব করেছি যে রোমান কি-বোর্ড দিয়ে অবিকৃতভাবে বাংলা বর্ণমালা তৈরি করা সত্যি সত্যি এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।  

হাজার বছরের বাংলা ভাষার ইতিহাসে এই সংকট মোকাবেলায় বাংলা অক্ষর কমানো, যুক্তাক্ষর বর্জন, অর্ধবর্ণ ব্যবহার এবং রোমান বা আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগগুলোর অন্যতম কারণ ছিল বাংলা যুক্তবর্ণ। আমি স্বপ্ন দেখতাম, কবে, কেমন করে এই যুক্তবর্ণের জটিলতার শিকল থেকে মুক্তি পাব।

বিজয় সৃষ্টি করে সেই শিকলটা আমি ভেঙেছি।

বাংলার ছাত্র বলে কি না জানি না, এটি আমার মাথায় পুরো ৮৭-৮৮ সাল জুড়েই ঘোরপাক খাচ্ছিল। যেহেতু আমি নিজে ‘জব্বার’ কি-বোর্ড বানিয়েছিলাম, সেহেতু যুক্তাক্ষর তৈরির গ্লিফগুলো সম্পর্কে আমার ধারণা খুব স্পষ্ট ছিল। কিন্তু আমি চাইছিলাম এমন একটি উপায়, যার সাহায্যে আমি ব্যবহারকারীকে কি-বোর্ড যুক্তাক্ষরের হাত থেকে রক্ষা করতে পারি। সেই ভাবনা থেকেই ‘বিজয়’ কি-বোর্ডের নকশা তৈরি করতে থাকি। পুরো বছরজুড়ে মোহাম্মদপুরের ৪২ সি কাজী নজরুল ইসলাম রোডের দোতলার বাসায় কত রাত যে আমি পায়চারি করে কাটিয়েছি তা মনে করা সম্ভব নয়। কিন্তু কোনোমতেই কম্পিউটারের সীমাবদ্ধ বোতামের মধ্যে সব বাংলা বর্ণের ঠাঁই করতে পারছিলাম না। তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম যে এমন একটি কিছু আমি অবশ্যই খুঁজে পাব—আমার মাথায় এমন কিছু আসবে, যার ফলে যুক্তাক্ষর নিয়ে কাউকে ভাবতে হবে না। তবে আমার সমস্যাও ছিল অনেক। আমি বাংলা ভাষা ও লিপি জানি, কম্পিউটারের ভাষা বা প্রগ্রামিং জানি না।  

কেমন করে কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম কাজ করে এবং তাতে কি-বোর্ড ইন্টারফেস কেমন করে তৈরি করা যায় তার কোনো ধারণাই আমার ছিল না। এ ছাড়া বাংলাদেশে ম্যাকিন্টোশ কম্পিউটারের জন্য প্রগ্রামার পাওয়া যেত না। ভারতের রাবা কন্টেলের অরুণ নাথ তখন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমি অরুণকে জানালাম, আমি ম্যাকিন্টোশের জন্য বাংলা কি-বোর্ড ড্রাইভার বানাতে চাই। আমার হাতে ফন্ট আছে; কিন্তু ফন্ট দিয়ে বাংলা লিখতে কি-বোর্ডের চার স্তর ব্যবহার করতে হয়। আমি চার স্তর চাই না, স্বাভাবিক দুই স্তর চাই। অরুণ আমাকে দিল্লি আসার বুদ্ধি দিলেন।  

সেখানে পরিচয় করিয়ে দিলেন, কুতুব হোটেলের কম্পাউন্ডের ভেতরেরই ডি-২ ফ্ল্যাটে রাবা কন্টেলে কর্মরত প্রগ্রামার দেবেন্দ্র জোশীর সঙ্গে। বেঁটে খাটো জোশী এবং তাঁর সঙ্গে কর্মরত আরো কয়েকজন সহকর্মী তখন ম্যাকিন্টোশে ভারতীয় ভাষার কি-বোর্ড ড্রাইভার ও ফন্ট নিয়ে কাজ করছেন। তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল দেবনাগরী ভাষাকে কম্পিউটারে প্রয়োগ করা। পাঞ্জাবি, গুজরাটি, তামিল, তেলেগু এবং মালয়ালমও তাঁদের তালিকায় ছিল। তবে বাংলা তাঁদের কাজের তালিকায় ছিল না। পশ্চিমবঙ্গে তখন ম্যাকের বাজার খুব ছোট। রাহুল কমার্স নামে তাঁদের যে ডিলার কলকাতায় ছিল, তাঁরা তাঁদের বঙ্কিম ফন্ট নিয়েই সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু আমি সুনন্দা ফন্টের পাশাপাশি বাংলা কি-বোর্ড ড্রাইভার নিয়েও ব্যস্ত ছিলাম। ডিসেম্বর মাসের শুরুতে (১৯৮৮ সাল) জোশীর সঙ্গে কুতুব হোটেলের ডি-২ ফ্ল্যাটে কাজ করা শুরু করে আমি অনুভব করলাম, আমার স্বপ্ন সফল করা যেতে পারে। জোশী বাংলা জানতেন না; কিন্তু হিন্দি খুব ভালো জানতেন।  

ফলে আমি যখন তাঁকে হসন্ত (জোশী বলত হলন্ত) ব্যবহার করে যুক্তাক্ষর তৈরির কথা বললাম, জোশী তখন আমাকে আমার ফন্ট ফাইলটি (সুনন্দা ফন্টটি থেকে আমি তন্বী সুনন্দা ফন্ট বানাই) সাজিয়ে নিতে পরামর্শ দেন। জোশী আমাকে এটিও জানান যে ফন্টে কোডের ব্যবহার বাড়ালেও কোনো অসুবিধা হবে না। আমি ১৮৮ অক্ষরের সংখ্যা বাড়িয়ে ২২০টি অক্ষর দিয়ে তন্বী সুনন্দা ফন্ট বানাই। আসকি কোডের যেসব জায়গায় কন্ট্রোল কী আছে সেগুলো ছাড়া ব্যবহার করা যায় এমন সব কোডই আমি ব্যবহার করলাম। একটি যুক্তাক্ষরের তালিকাও আমি বানাই। আমার সঙ্গে বিদ্যাসাগরের বর্ণ পরিচয় বইটি ছিল।

বইটি দিল্লি যাওয়ার পথে কলকাতায় কিনেছিলাম। তালিকাটি সেই মোতাবেক করা হয়। প্রতিটি যুক্তাক্ষর এবং তার কী কম্বিনেশন ও গ্লিফ চার্ট তৈরি করা হয়। যত দূর মনে আছে, কুতুব হোটেলের ছয়তলায় ৫২২ নম্বর রুমে বসে সাদা কাগজ আর পেনসিল দিয়ে বারবার কাটাছেঁড়া করে দুটি তালিকা প্রস্তুত করি। একই সঙ্গে প্রস্তুত করি বিজয় কি-বোর্ড কোন নিয়মে কাজ করবে তার নিয়মাবলি। সে জন্য বিজয় কি-বোর্ড প্রস্তুতের আগে আমাকে ভাবতে হয় অনেক কিছু।  

বিজয় কি-বোর্ড সেই সময়ে বিদ্যমান সব কি-বোর্ডের মৌলিক ধারণা থেকে স্বাতন্ত্র্য নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। বিজয়ের জন্মের সময় শহীদলিপি ও আবহ কি-বোর্ড ছাড়া টাইপরাইটারের মুনীর কি-বোর্ড প্রচলিত ছিল। শহীদলিপি ও আবহ কি-বোর্ড আমার পছন্দ হয়নি।  

কুতুব হোটেলের ৫২২ নম্বর ঘরে বসেই যখন শেষ নকশাগুলো সম্পন্ন করা হয়, তখন গভীর রাত। দিল্লির শহরতলির নীরব ওই হোটেলে কান পাতলে আমার শ্বাসের আওয়াজও আমি শুনতে পেতাম। চারপাশে জনবসতি নেই বলে গাড়িঘোড়াও চলে না। কাজ শেষ করে ফেলায় প্রায় সারা রাত উত্তেজনায় ঘুম হয়নি। আমার যদি সেই সময়ে মোবাইল ফোন থাকত তবে আমি অবশ্যই জোশীকে গভীর রাতেই জাগাতাম। আমার টেনশন ছিল, আমার লে-আউট, যুক্তাক্ষরের সর্বশেষ তালিকা ও কি-বোর্ডের নিয়মাবলি কাজ করবে তো? যদি ‘না’ করে তবে আবার চেষ্টা করা যাবে। কিন্তু যদি করে—তবে সেই আনন্দ আমি কোথায় রাখব?

সম্ভবত শেষ রাতে শুয়ে পড়েছিলাম এবং ঘুম থেকে উঠে নাশতা সেরে ডি-২-তে গিয়ে জোশীকে প্রস্তুতই পেয়েছিলাম। জোশী আগের দিনই বাংলা কি-বোর্ডের জন্য মূল প্রগ্রামিং তৈরি করে রেখেছিল। আমার কাছ থেকে কি-বোর্ডের লে-আউট, বাংলা অক্ষরের কোড নম্বর, লাতিন হরফের কোড নম্বর এবং যুক্তাক্ষর তৈরির সিকোয়েন্স ও তার কোডগুলো একের পর এক বসিয়ে গেলেন। ডি-২ অ্যাপার্টমেন্টে বসে ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই আমার তালিকার কাজ শেষ হলো। জোশী প্রগ্রামটি কম্পাইল করলেন নশনফ নামে। আমিই তাঁকে বলেছিলাম, এর নাম হবে বিজয় কি-বোর্ড। সামনেই ছিল ১৬ই ডিসেম্বর। সুতরাং আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ওই দিনে এই কি-বোর্ডটি প্রকাশ করব। স্বল্পভাষী জোশী মাত্র তিন কিলোবাইটের ওই প্রগ্রামটি আমাকে দেখালেন। আমি আমার আসল নামের গোলাম-এর জি অক্ষরটিকে লিংক বা হসন্ত হিসেবে রাখলাম। ইচ্ছা করলে এর বদলে এইচ বোতামটিকেও লিংক হিসেবে রাখা যেত। বাংলা কি-বোর্ড ও ইংরেজির মধ্যে টোগল কী হিসেবে রাখলাম কন্ট্রোল-অপশন-বি। ‘বি’ দিয়ে বিজয় এবং বাংলা—দুটিই বোঝায়।

বিজয় কি-বোর্ডটি যুক্ত করে বিজয় সফটওয়্যারের প্রগ্রামিং শেষে নশনফ ফাইলটি জোশী তাঁর ম্যাকের সিস্টেম ফোল্ডারে কপি করে দিয়ে আমাকে বললেন, পরীক্ষা করে দেখ। আমি তন্বী সুনন্দা ফন্ট এবং এর ১৪ পয়েন্ট সাইজ বাছাই করে কন্ট্রোল-অপশন বি টাইপ করে প্রথমেই ইংরেজি এইচ বোতামে চাপ দিই। ম্যাকের (সম্ভবত ম্যাক-২) পর্দায় বাংলা ব হরফ দেখা যায়। এরপর আমি ইংরেজি জে, জি এবং জে টাইপ করি। ক-এর পর হসন্ত এবং এরপর ক্ক হতে দেখে আমি প্রায় চিৎকার করে বলে উঠি—জোশী বিজয় কাজ করছে। জোশীর কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। একটা নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে জোশী বললেন, সব কম্বিনেশন চেক করো। আমার পেনসিলে তৈরি করা কি-বোর্ড লে-আউট এবং যুক্তাক্ষরের তালিকা আমি একের পর এক পরীক্ষা করি। বেশ সময় নেয় তাতে। সম্ভবত দুপুরের খাবারের সময় পার হয়ে যায়। কিন্তু আমার পেটে কোনো ক্ষুধা লেগেছিল বলে মনে নেই।  

পরীক্ষা শেষে বিস্ময়করভাবে আমি লক্ষ্য করেছিলাম, আমার তালিকা, কি-বোর্ড লে-আউট বা জোশীর কোডিংয়ের কোথাও সামান্য চুল পরিমাণ ত্রুটি ছিল না। সেদিন আমি যে এনকোডিং করেছিলাম তা (কিছুটা বদলে) ম্যাক ও.এস ৯.২ পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়। সেদিন যে কি-বোর্ড তৈরি করেছিলাম তা-ই এখনো ব্যবহৃত হয়। তবে কম্পিউটার সোর্সের পারফেক্ট কি-বোর্ডের লে-আউটে ভুল করে ত্ নিচে ও  উপরে ছাপা হয়। ফলে কি-বোর্ড বদলাতে হয়, যা এখন বিজয় কি-বোর্ডে বজায় রয়েছে। তবে পরে চেক করে দেখেছি দু-একটি যুক্তাক্ষর প্রথম তালিকায় ছিল না। ভ্ল, স্ক্ল এমন দুটি যুক্তাক্ষর আমি পরে যুক্ত করেছি। ২০০৪ সালে তিনটি বোতামের অবস্থানও পরিবর্তন করি।

তবে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ওই দিন পৃথিবীতে আমার চেয়ে সুখী মানুষ আর একটিও ছিল না। আমার মনে আছে, দিল্লির এই এলাকাটি আমার ভালো লাগত না। রুক্ষ্ম মরু অঞ্চলের মতো অজানা কাঁটাজাতীয় গাছে ভরা কুতুব হোটেলের চারপাশটাও আমার তেমন পছন্দ ছিল না। সবুজ দেশের মানুষের কাছে এমন মরু টাইপের অঞ্চল ভালো না লাগারই কথা। তবে হোটেলের রুম থেকে পুরোটাই সবুজ দেখা যেত। দালানকোঠা চোখেই পড়ত না। আমি কুতুব হোটেলের আশপাশে হাঁটতাম না। হোটেল কম্পাউন্ডটা খুব সুন্দর বাড়ির মতো; বরং ওটা আমি পছন্দ করতাম। কিন্তু সেদিন বিকেলে বালুময় কুতুব মিনার এলাকাটি মনে হলো ঘন সবুজ নরম মাটিতে মাখানো বাংলার মাটি। বালুতে পা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে মনে হয়েছে সবুজ দূর্বাঘাসের কার্পেটে ভর দিয়ে হাঁটছি, আর আমার জুতা ডেবে যাচ্ছে।  

হাঁটতে হাঁটতে অদূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা কুতুব মিনারের চূড়াটার দিকে চোখে পড়তেই মনে হয়েছে, ওখানে ওঠে দাঁড়ালে কি ঢাকা দেখা যাবে? ওখান থেকে ডাক দিলে কি সানু, রিনকি, তন্বী শুনবে? হেলেন, রাব্বানী বা কিবরিয়া কি পাবে আমার গলার আওয়াজ? যদি তখনই হামিদকে দেখিয়ে দিতে পারতাম, ওর ডিজাইন করা হরফকে আমি কত সুন্দর করে সাজিয়ে ফেলেছি? খুব কাছাকাছিই হজরত নিজামউদ্দিনের মাজার। একবার ভেবেছিলাম, বাবার মাজারের কথা স্মরণ করতে ওখানে যাব? মায়ের কথাও মনে পড়েছিল। কিন্তু সেদিনের সেই আনন্দ ভাগ করার কেউ ছিল না দিল্লিতে। তবে আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আমার স্বপ্নের এই বিজয় অবশ্যই বিশ্ব জয় করবে। ৩৩ বছর পর পরিমাপ করতে পারছি না সেই স্বপ্ন কতটা সফল হলো। তবে এটুকু বুঝি, বিজয় আমাকে বিশ্বজুড়ে বসবাসকারী বাঙালিদের মাঝে পরিচিত করেছে। এটিই এই জীবনের বড় পাওনা।

news24bd.tv/ কামরুল