নিয়াজির চোখেই ২৫ মার্চের গণহত্যা চেঙ্গিস-হালাকু-ডায়ারের নিষ্ঠুরতাকে হার মানায়!

সোহেল সানি

নিয়াজির চোখেই ২৫ মার্চের গণহত্যা চেঙ্গিস-হালাকু-ডায়ারের নিষ্ঠুরতাকে হার মানায়!

সোহেল সানি

জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণই মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বপূর্ণ ঘটনা। এর দুটি দিক আছে। এক, জেনারেল নিয়াজির দালিলিক স্বাক্ষরেই পাকিস্তান দু’টুকরো হয়,অর্থাৎ তার দেশ পূর্ব পাকিস্তানের মালিকানা হারায়। দুই, এর মাধ্যমে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের।

জেনারেল নিয়াজি ছিলেন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক বাহিনীর প্রধান। তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সামরিক অভিযানের জন্য দায়ী করেন জেনারেল টিক্কা খানকে। নিয়াজির লেখা “দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান” নামক গ্রন্থটিতে অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে এসেছে। যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিরোধে বলিষ্ঠ ভুমিকা রাখতে পারে।

স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্কেরও মৃত্যু ঘটে গ্রন্থটিকে দালিলিক প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করলে।

২৭ মার্চের মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত কোন শব্দ নেই। শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণাকারী ও প্রতিপক্ষরূপে চিহ্নিত হয়েছেন। যুদ্ধের প্রকৃতি, পাকিস্তানের ভাঙ্গন, যুদ্ধ পরিকল্পনা, আক্রমণ, সশস্ত্র বাহিনী, আলবদর, আলসামস, রাজাকার বাহিনী,যুদ্ধ শিবির, গোপনীয় রিপোর্ট, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খানের ভুমিকা, বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথকমান্ড, মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণের প্রেক্ষিত ও বাধ্যবাধকতা নিখুঁতভাবে বর্নিত হয়েছে গ্রন্থে।

পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান, জুলফিকার আলী ভুট্টোকে দায়ী করেন। তিন জনকে পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতক বলেছেন। নিয়াজির ভাষায়, পূর্ব পাকিস্তান সংকট ছিল একটি রাজনৈতিক সংকট। যার সমাধান কোনো সামরিক যুদ্ধের মাধ্যমে হওয়ার ছিল না।

নিয়াজি দাবি করেন যে, ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে জরুরি বার্তা পাঠিয়ে বলি, সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলনেতা শেখ মুজিবকে মুক্তি দিন এবং তাঁর কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। কিন্তু ইয়াহিয়া আমার আবেদনে সাড়া দেননি’।
 
নিয়াজি বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ নিপীড়নের কথা স্বীকার করেন। কেন তাকে শাসকগোষ্ঠীর নিদের্শে দায়িত্বপালন করতে হয়েছে, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেছেন নিয়াজি।  

তিনি লিখেছেন, ‘আমাকে উপরের নির্দেশেই যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। যা ছিল চরম অপমানের, তার চেয়ে মৃত্যুবরণ করা ভালো হতো’।

অবশ্য নিয়াজি আত্মমর্যাদার আত্মহত্যা করেননি। আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করে মিত্রবাহিনীর হাতে বন্দীত্ববরণ করেন। নিয়াজি পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে সিজারের চেয়ে পরাক্রমশালী বলেন। তাঁর গ্রন্থ প্রকাশ বিলম্বের কারণও ভুট্টোর ক্ষমতাকে দায়ি করেছেন।

আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে ভারতীয় হামলা সম্পর্কে অবগত করলে জবাবে বলেন,পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আমি কি করতে পারি? আমি পারি কেবল প্রার্থনা করতে। তিনি এই বাক্যটি দ্বারা রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে তার সকল দায়িত্ব-কর্তব্য শেষ করেন।

পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষা করতেই আমার ওপর আত্মসমর্পণের নির্দেশ নাজিল হয়। আর তিনি ১৪ মার্চ (ভুট্টো) ‘ওধার তুম ইধার হাম’ বলতে দুটি পাকিস্তানকে বুঝিয়ে ছিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছিল না। কারণ আওয়ামী লীগ এমন এক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল যেখান থেকে তার ফেরার পথ ছিল না।  

নিয়াজি লিখেছেন, “১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে পূর্ব পাকিস্তানে পালিত হয় প্রতিরোধ দিবস। মুজিবের বাসভবনে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়। মুজিব কর্নেল ওসমানীকে সার্বিক অপারেশনের কমান্ডার নিযুক্ত করেন। মেজর জেনারেল (অবঃ) মাজেদের তত্ত্বাবধানে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের তালিকাভুক্ত করা হয়। ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র ও গোলাবারুদ আসতে থাকে। ভারতের সক্রিয় সহযোগিতায় সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। মনে রাখা প্রয়োজন যে, তখনো বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ করেনি। ২৫ ও ২৬ মার্চ মধ্যরাতে জেনারেল টিক্কা আঘাত হানেন। একটি শান্তিপূর্ণ রাত পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে, চারদিকে আর্তনাদ, অগ্নিসংযোগ। জেনারেল টিক্কা তার সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যেন তিনি তার নিজের বিপথগামী লোকের সঙ্গে নয় শত্রুর সঙ্গে লড়াই করছেন’।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই সামরিক অভিযানের হিংস্রতা ও নৃশংসতা বুখারায় চেঙ্গিস খান, বাগদাদে হালাকু খান এবং জালিয়ান ওয়ালাবাগে বিট্রিশ জেনারেল ডায়ারের নিষ্ঠুরতাকেও ছাড়িয়ে যায় বলে জেনারেল নিয়াজি মন্তব্য করেন।

তিনি লিখেছেন, সশস্ত্র বাঙালি ইউনিট ও ব্যক্তিবর্গকে নিরস্ত্র এবং বাঙালি নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করার জন্য টিক্কা খানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি এ দায়িত্ব পালন করার পরিবর্তে বেসামরিক লোকজনকে হত্যা এবং পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেন। তিনি তার সেনাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘আমি মাটি চাই মানুষ নয়। ‘মেজর জেনারেল ফরমান ও বিগ্রেডিয়ার জাহানজেব আরবাব ঢাকায় তার এ নির্দেশ পালন করেন। জেনারেল রাও ফরমান তার টেবিল ডায়েরিতে লিখেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের শ্যামল মাটি লাল করে দেয়া হবে। আসলেই ‘বাঙালির রক্ত দিয়ে মাটি লাল করে দেয়া হয়েছিল।

‘৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাঙালিরা গভর্নর হাউজ (বঙ্গভবন) অবরোধ করার পর তারা ফরমানের ডায়েরি খুঁজে পায়। বাংলাদেশ সফরকালে মুজিব ভুট্টোকে এ ডায়েরি দেখিয়েছিলেন বলেও গ্রন্থটিতে উল্লেখ করেছেন। আমার সঙ্গে সাক্ষাতকালে ভুট্টো এ ডায়েরি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তাকে আমি বলি এ ব্যাপারে আমার কিছুই জানা নেই। এও লিখেন টিক্কা তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন থেকে সরে যান। ফলে সকল বাঙালি সশস্ত্র ব্যক্তি ও ইউনিট, অস্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, সাজসরঞ্জাম ও পরিবহন নিয়ে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করে।

নিয়াজির ভাষায়, মুজিব ছাড়া সব নেতৃবৃন্দ পালিয়ে যায় এবং কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন করে। ২৫ ও ২৬ মার্চ সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার আগে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগকালে টিক্কাকে বলেন, তাদেরকে খুঁজে বের করো। টিক্কার নিষ্ঠুরতা দেখার জন্য ভুট্টো ঢাকায় রয়ে যান। তিনি দেখলেন ঢাকা জ্বলছে।

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাসবিদ।

(মত-ভিন্নমত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv/আলী