কানাডায় প্রবাসী বাঙালিদের রমজান আর ইফতারের আয়োজন

কানাডায় প্রবাসী বাঙালিদের রমজান আর ইফতারের আয়োজন

কানাডায় প্রবাসী বাঙালিদের রমজান আর ইফতারের আয়োজন

লায়লা নুসরাত, কানাডা

মাল্টিকালচারালিজমের দেশ কানাডায় বিভিন্ন দেশের লোক এখানে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। এর মধ্যে প্রচুর সংখ্যক মুসলমানও রয়েছে।

কানাডায় গত দুই বছরের তুলনায় এ বছর ইফতারের ব্যাপক আয়োজন লক্ষ্য করা গেছে। কানাডার আলবার্টায় করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় এবং সামাজিক দূরত্ব ও মাস্ক ব্যবহারের উপর বাধ্যতামূলক শিথিল করায় পুরো আলবার্টা যেন নতুন করে জেগে উঠেছে।

শুধু আলবার্টা নয়, এ চিত্র এখন পুরো কানাডার।  

ইতিমধ্যেই মসজিদ, মন্দির ও গির্জাসহ ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে প্রচুর সংখ্যক লোকের সমাগম ঘটেছে। দীর্ঘদিনের না দেখে থাকার বিরতি বিচ্যুতি ঘটাতে পারেনি পারস্পরিক সম্পর্কের। একে অপরের সান্নিধ্যে এগিয়ে আসছে, বিনিময় করছেন কুশলাদি।

রমজানের প্রথম শুক্রবারের জুম্মার নামাজে যেয়ে দেখা গেছে প্রচুর সংখ্যক মুসল্লির সমাগম ঘটেছে মসজিদে। মুসুল্লিরা একে অপরের সাথে কুশল বিনিময় করছেন। মসজিদ গেটের সামনে রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে পসরা সাজিয়ে বসেছে আতর আর জায়নামাজের দোকানগুলো। মাসব্যাপী রোযা রাখার সময়সূচি সম্বলিত রমজানের ক্যালেন্ডারও অনেকের হাতে।

ক্যালগেরির গ্রোসারির দোকানগুলোতে প্রবেশপথেই রমজানের প্রস্তুতি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের খাবার, জুস, ছোলা বেসনসহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন খাবার সমৃদ্ধি প্রস্তুতি দেখা গেছে। রমজান মাসে দোকানে প্রবেশ করলেই তা সহজেই অনুমেয়। কানাডার স্থানীয় বড় বড় স্টোর এবং বিভিন্ন দেশের স্টোর গুলিতেও রমজানকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে বড় করে মাহে রমজান সম্বলিত পোস্টার লেখা রয়েছে যা ক্রেতাদের সহজেই আকৃষ্ট করে।

অন্যদিকে প্রবাসী বাঙালিরা ছুটির দিনসহ কর্মময় দিনগুলিতেও পরিবার পরিজন নিয়ে আসছে রমজানের বিশেষ আইটেমগুলো কিনতে। প্রবাসী বাঙ্গালীদের মালিকানায় গ্রোসারিগুলো যেন বাংলাদেশের মতোই বাংলাদেশী পণ্য দিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেছে।

উল্লেখ্য, বরফাচ্ছন্ন কানাডার প্রায় ৮ মাসই বরফে আচ্ছাদিত থাকে। এ বছরও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। পবিত্র রমজান মাসে বাংলাদেশের মত এখানেও বাঙালিরা ছোলা মুড়ি মেখে মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনির অপেক্ষায় থাকে। ইফতারের আয়োজনে থাকে পেয়াজু, কলা, আলুর চপ, জিলাপি, খেজুর, চিকেন, হালিম আর শরবত। বিশেষ খাবার হিসেবে কমলা, আঙুর, আপেলসহ নানা দেশের বৈচিত্রময় ফল। বাংলাদেশি হোটেলগুলোতেও ইফতারিসহ খিচুরি ও বিরিয়ানির বেচা কেনা চলে জমজমাটভাবে।

প্রবাসী মুসলিম বাঙালিরা কানাডায় থাকলেও ভুলে যায়নি তাদের ধর্মীয় রীতি নীতির কথা। তার প্রতিফলন ঘটে তারাবির নামাজের সময় যখন ছোট ছোট শিশু কিশোররা অভিভাবকদের সাথে মসজিদে আসে। স্বাস্থ্যবিধির শিথিলতার কারণে এই বছর নতুন করে জেগে উঠবে মুসল্লিদের তারাবির নামাজ।

গত দু’বছর কোভিড-১৯ এর কারণে গৃহবন্দি আর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে মসজিদের রূপ ভিন্ন আকার ধারণ করেছিল। দূরত্ব বজায় রাখা আর সরকারের দেয়া বিধিনিষেধ মানতে যেয়ে অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছিল ধর্মীয় রীতিনীতি। কিন্তু এ বছর তার পুনরাবৃত্তি আর হচ্ছে না।

এ বছর মুসুল্লিরা সবাই মসজিদে বসে একত্রে ইফতারি করছে এ জন্য আগে থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বন্ধু-বান্ধব দের সবাইকে জানিয়ে দাওয়াত দিচ্ছেন। মসজিদ কমিটির অনেকেই ইফতারির জন্য অর্থ সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু করেছেন।

প্রবাস জীবনের যান্ত্রিকতাময় দিনগুলোতে ইফতার আর তারাবি নামাজ শেষে প্রবাসী বাঙালিরা যখন মিলিত হয় একে অপরের সাথে পুরো পরিবেশ তখন পরিণত হয় এক ভিন্ন আমেজের। কানাডার বিভিন্ন প্রদেশে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এশিয়ান এলাকায় উৎসব মুখর পরিবেশে সবাই যখন মসজিদে মিলিত হয়, তখন মনে হয় যেন একখণ্ড বাংলাদেশ।

কানাডার টরেন্টো প্রবাসী বাঙালি এ আলী তালুকদার জানান, 'গত দু'বছরের বন্দী জীবন থেকে বেরিয়ে এসে এ বছর বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজদের নিয়ে বাড়িতে ইফতার করতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র রমজান মাসে সারা বিশ্বের উম্মাহর যেন হেফাজত দান করেন এবং আগের মত রমজান পালন করার তৌফিক দান করেন, এমনটাই আমার প্রত্যাশা'।

ক্যালগেরির উৎসব সুইটস এন্ড রেস্টুরেন্টের স্বত্বাধিকারী ইরফান আরিফ জানান, 'আমাদের রেস্টুরেন্টে ইফতারের সব ধরণের আইটেম রয়েছে। রমজান মাসে ক্রেতা সাধারণের সর্বোচ্চ সেবা দিতে আমরা সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছি কম্পিটিটিভ প্রাইসের প্রতি যাতে করে সবাই সুন্দরভাবে পবিত্র রমজান মাসে ইফতার করতে পারি। আপনাদের সেবায় আমরা নিয়োজিত'।

বারাকা এ্যপায়ারেল এর স্বত্তাধিকারী আরিফা রব্বানী জানান, 'আমরা ইফতারিতে বাংলাদেশের স্টাইলে শাহী হালিম, শাহী জিলাপি, বেগুনি, পিয়াজু, আলুর চপ, ছোলা এবং অন্যান্য আইটেমসহ বাহারী রকমের ফল ও শরবতের ব্যবস্থা রাখি। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সবাই মিলে যখন ইফতারি করি তখন বাবা-মাসহ শৈশবের সেই ইফতারির দিনগুলোকে খুব মিস করি'।

উৎসব সুইটস এন্ড রেস্টুরেন্টের অন্যতম স্বত্তাধিকারী খায়রুল বাশার বলেন, 'পবিত্র রমজান মাসে আমরা সবাই একত্রিত হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে ইফতার ও নামাজ আদায় করতে পেরে খুবই আনন্দিত। মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা করি যেন সারা পৃথিবীতে শান্তি বর্ষিত হয়'।

সিয়াম সাধনার মাসে সংযম আর আত্মশুদ্ধির মধ্য দিয়ে যাবতীয় ভোগ বিলাস, অন্যায়, অপরাধ, হিংসা, বিদ্বেষ, সংঘাত পরিহার করে ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবনে বয়ে নিয়ে আসবে শান্তির বার্তা কানাডায় বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিদের এমনটাই প্রত্যাশা।

news24bd.tv/রিমু