ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ভুলে দেশমাতৃকার প্রশ্নে একাট্টা হয়েছিলেন জাতীয় চার নেতা

সোহেল সানি

ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ভুলে দেশমাতৃকার প্রশ্নে একাট্টা হয়েছিলেন জাতীয় চার নেতা

সোহেল সানি

সরকার গঠনের আগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলে পরিচয় দেন তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল এ পরিচয় দিলেও বাস্তবিক এর কোনো ভিত্তি ছিলো না। কেননা তখনও পর্যন্ত আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড পর্যায়ে সিদ্ধান্ত দূরে থাক অস্থায়ী সরকার গঠন নিয়ে কোন আলোচনাই হয়নি। আওয়ামী লীগ এক সপ্তাহ উত্তপ্ত বৈঠক শেষে ১০ এপ্রিল সরকার গঠন করে।

রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী পরিষদ গঠন হওয়া সত্ত্বেও শপথ অনুষ্ঠান বিলম্বিত হয়। অবাঙালি মহকুমা প্রশাসক বাঙালিদের হাতে নিহত হবার পর চুয়াডাঙ্গায় শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের কথা ছিল। কিন্তু চুয়াডাঙ্গা আবারও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখলে চলে যাবার ফলে শপথ অনুষ্ঠান বিলম্বিত হয়। পরবর্তীতে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলাকে বেছে নেয়া হয় এবং ১৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক শপথ অনুষ্ঠান।

বিএসএফ'র এক কমান্ডারের মাধ্যমে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীনের সাক্ষাৎ ছিল অভিনব ঘটনা। ইন্দিরা গান্ধীর কাছে তাজউদ্দীন আহমদ প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। প্রধানমন্ত্রী পরিচয় দিলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রথমেই জানতে চান "শেখ মুজিব কোথায়?" জবাবে তাজউদ্দীন বলেন, 'তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে অদৃশ্য স্থান থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন - তাঁর নির্দেশেই আমি এসেছি। আপনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আমাদের অস্থায়ী সরকারের প্রতি সমর্থন দিন'।

উল্লেখ্য, তাজউদ্দীন আহমদ ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে ধানমন্ডিস্থ নিজের বাড়িতে চলে যান। ডঃ কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে বেরিয়ে তাজউদ্দীনের বাড়িতে গিয়েছিলেন। পরক্ষণেই শুরু হয়ে যায় গণহত্যার তান্ডবলীলা। তাজউদ্দীন আহমদ ডঃ কামাল ও ব্যারিস্টার আমীরকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। পথিমধ্যে ডঃ কামাল নেমে যান। তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীরকে নিয়ে কিভাবে মেহেরপুর কুষ্টিয়া সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতীয় বিএসএফ ফাঁড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তা বর্ণনা করার আগে অস্থায়ী সরকার গঠন নিয়ে তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শোনা যাক।

মুজিবনগর সরকার গঠন ও পদপদবি নিয়ে পাঁচ সদস্যের ‘হাইকমান্ড’ জড়িয়ে পড়েছিল চরম এক অন্তঃকলহে। বঙ্গবন্ধু হাইকমান্ড গঠন করে রেখেছিলেন যেকোন পরিস্থিতি মোকাবিলায় নেতৃত্বের শূন্যতা যাতে সৃষ্টি না হয়। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সংসদীয় দলের নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সেই হিসেবে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী বলে সম্মোধনও করেছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়ার ২৫ মার্চের গণহত্যা পরবতী ২৬ মার্চ গ্রেফতারত্তোর বঙ্গবন্ধু কর্তৃক  "বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন" ঘোষণা করার প্রেক্ষিতে শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। স্বভাবতই পাকিস্তানের সরকার কাঠামোর পরিবর্তে বাংলাদেশের সরকার কাঠামোর ভিন্ন চিন্তা আসে হাইকমান্ডের মাথায়।

১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে একটি সরকার কাঠামো গঠন করা হয়। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে করা হয় উপরাষ্ট্রপতি। তিনিই বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। প্রাদেশিক পরিষদের সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে এম মনসুর আলীর পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কথা। কিন্তু প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন অস্থায়ী সরকারের স্বঘোষিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হন। ফলে সমস্যার সৃষ্টি হয়। এএইচএম কামরুজ্জামান নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তাঁকে হাইকমান্ডের সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ এ কথা বলে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন প্রাদেশিক পরিষদের নেতা হিসেবে এম মনসুর আলী হবেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি অপারগতা প্রকাশ করলে হবেন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান। হাইকমান্ডের অপর সদস্য ড. কামাল হোসেন ২৬ মার্চ রাতে গ্রেফতার না হলে মন্ত্রী হতেন। যাহোক পদপদবী নিয়ে সৃষ্ট অন্তঃকলহের উত্তাপ ছড়ায় ৮ এপ্রিল। কলকাতার ভবানীপুরের রাজেন্দ্র রোডের এক বাড়িতে। ওখানে উপস্থিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের অধিকাংশ তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রীর পদগ্রহণ নিয়ে পরিস্থিতি সরগরম করে তোলেন। প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী ও  যুবনেতাদের পক্ষে শেখ ফজলুল হক মনি এ বিতর্কের অবতারণা করেন। চরম বাকবিতণ্ডায় হয় তাদের মধ্যে।  

"প্রধানমন্ত্রীত্ব নিয়ে কলহ"

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’। শুরু হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তান্ডব। এরপর একেক করে আওয়ামী লীগের নেতারা সীমান্তে গিয়ে জড়ো হন। বঙ্গবন্ধু আগেই তাদের আত্নগোপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতাকে বাস্তবে রূপায়নের অবশ্যকীয় শর্ত-সরকার গঠন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা না থাকায় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সরকারকাঠামোর প্রকৃতি নিয়ে এ  মতবিরোধ দেখা দেয়াটা ছিল স্বাভাবিক ঘটনা।

তাজউদ্দীন আহমেদের নীতি নৈতিকতা নিয়েও প্রধানমন্ত্রীর পদের দাবিদার মনসুর আলী এসময় বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি বলেন, মতভেদ থাকলেও স্বাধীনতার প্রশ্নে আমরা এক। তিনি তাজউদ্দীনের প্রতি সদয় হয়ে সেদিন যে উদারতা প্রদর্শন করেন তা বিরল। তিনি অস্থিরতাহীন সঠিক সিদ্ধান্তগ্রহণে ধীশক্তি দ্বারা অসীম নৈব্যর্ত্তিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। তাজউদ্দীনের রাজনৈতিক আচরণ ও নৈতিকতা নিয়ে কটাক্ষ করে মনসুর আলী বলেন, তিনি এটা ঠিক করেননি, তবুও বিরাজমান অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীরূপে তাজউদ্দীন আহমেদকে মেনে নেয়া ব্যতীত গত্যন্তর নেই। বস্তুত মনসুর আলীই প্রথমে কামরুজ্জামানকে সম্মত করান। খন্দকার মোশতাক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ দাবি করায় সমস্যায় পড়েন তাজউদ্দীন আহমদ। এ দফতরটি নিজের হাতে রাখতে চাইছিলেন। শেষে মোশতাকেই আইন ও পররাষ্ট্র দফতর দেয়া হয়। মোশতাক প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে রাখার চাল চাললেও সৈয়দ নজরুল ইসলামের অসাধারণ মানসিকতার কারণে তা ভেস্তে যায়। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত বলার আগে পূর্বাপর ঘটনার দিকে তাকানো যাক।

নগেন্দ্র সিংকে দায়িত্ব দিলেন। একটি ছোট বিমানও দেয়া হলো। তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতায় আসেন। গাজা পার্কের কাছে একটা বাড়িতে এইচ এম কামরুজ্জামান ও মনসুর আলী ছিলেন। সেখানে শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদও ছিলেন।  

ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে একটি কক্ষে ডেকে নিয়ে শেখ ফজলুল হক মনি বলেন, সরকার গঠনের প্রশ্নে পরিষদ সদস্যরা খুশি নন। তারা প্রিন্সেস স্ট্রিটের এমএলএ হোস্টেলে আছেন। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বুঝতে পারলাম। কামরুজ্জামানকে নিয়ে পরিষদ সদস্যরা একটি বৈঠকও করলেন। মিজানুর রহমান চৌধুরীও দ্বন্দ্বে ছিলেন। রাতের বেলা লর্ড সিনহা রোডে বৈঠক বসলো। শেখ মনি তাঁর বক্তৃতায় বললেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শত্রু শিবিরে বন্দী, বাংলার যুবকরা বুকের তাজা রক্ত দিচ্ছে। এখন কোন মন্ত্রিসভা গঠন করা চলবে না। মন্ত্রী মন্ত্রী খেলা এখন সাজে না। এখন যুদ্ধের সময়। সকলকে রণক্ষেত্রে যেতে হবে। রণক্ষেত্রে গড়ে উঠবে আসল নেতৃত্ব। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করতে হবে।

বৈঠকে প্রায় সকলেই একই সুর। কামরুজ্জামান ছিলেন প্রাণখোলা সরল মানুষ। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মেনে নিতে তিনি আর দ্বিধা করলেন না। ১০ এপ্রিল বিমানে তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, শেখ মনি ও তোফায়েল আহমেদ লর্ড সিনহা রোড থেকে সোজা বিমানবন্দর চলে যান আগরতলায় যাওয়ার জন্য। প্রাদেশিক পরিষদের নেতা হিসেবে মনসুর আলীর প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হলেও তাজউদ্দীন আহমদকে মেনে নিলেন। ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ সম্প্রচারিত হলো ভারত রেডিও থেকে। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামের কন্ঠে বলা হলো এখন ভাষণদান করবেন বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। গোলক মজুমদারকে ১০ এপ্রিল এ ভাষণ সম্প্রচার করতে মানা করলেও তা প্রচার হয়ে যায়। সারা বিশ্ব জেনে গেলো সরকার গঠনের খবর। তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণের পর রাতে কর্নেল নুরুজ্জামান ও আব্দুর রউফ আসেন। খুঁজে পাওয়া গেলো সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আবদুল মান্নানকে। ওখান থেকে আগরতলা।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম জানান তিনি ডাঃ আলীম চৌধুরীর ছোট ভাইয়ের বাসায় আত্মগোপন করেছিলেন। সেই বাসা হতে পরচুলা ও মেয়েদের শাড়ি পরে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। কর্নেল ওসমানীও আগরতলায়। দৃষ্টি আকর্ষণ করা সেই গোঁফ আর নেই। খন্দকার মোশতাককে ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছেন ডঃ টি হোসেন। সিলেট থেকে আব্দুস সামাদ আজাদ ও  চট্টগ্রাম থেকে জহুর আহমেদ চৌধুরীও এসেছেন। তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও মাহবুবুল হক চাষী আগেই আসেন। আগরতলার সার্কিট হাউজে বসে কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান হতে অনুরোধ করা হলো।

খন্দকার মোশতাক খুবই মন খারাপ করে আছেন। বললেন তাকে যেন মক্কা পাঠিয়ে দেয়া হয়। টি হোসেনের ভাষ্যমতে খন্দকার মোশতাক প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত মোশতাক বললো তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিতে হবে। মোশতাক রাজী হওয়ায় জহুর আহমেদ চৌধুরী মোনাজাত করলেন। ১৩ এপ্রিল কলকাতা ফিরে গেলেন সকলে। আনুষ্ঠানিক শপথের জন্য ১৪ এপ্রিল নির্ধারণ করা হলো। চুয়াডাঙ্গায়। কিন্তু ১৩ এপ্রিল পাক বাহিনী দখল করে নেয়ায় সে চিন্তা বাদ দেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত মানচিত্র দেখে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলাকে শপথ গ্রহণের উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রের খসড়া তৈরি করালেন।  কলকাতা হাইকোর্টের বিখ্যাত আইনজীবী সুব্রত রায় চৌধুরী ঘোষণা পত্রটি দেখে দেন। বিএসএফ ওসমানীর সামরিক পোশাক তৈরি করে দিল।

সাংবাদিকদের জড়ো করার দায়িত্ব ছিল আব্দুল মান্নানের ওপর। ১৬ এপ্রিল কলকাতা প্রেসক্লাবে গেলেন। ১৭ এপ্রিল সারারাত না ঘুমিয়ে ভোরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক, মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও ওসমানী একটি গাড়িতে রওয়া হলেন।  আম্রকাননে পৌঁছাতে ১১ টা বেজে গেলো। মাহবুব উদ্দিন ও তৌফিক এলাহি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করলেন। চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলি স্বাধীনতার সনদ পাঠ করেন।

কোরআন তেলওয়াতের মাধ্যমে শপথ অনুষ্ঠানের শুরু। ছোট মঞ্চে আব্দুল মান্নান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম শপথ বাক্য পাঠ করান। তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক ও কামরুজ্জামানকে মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তারপর সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি  ও তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাষণ দেন। তাজউদ্দীন আহমদ স্থানটির নাম 'মুজিব নগর' নামকরণ করেন। মন্ত্রীর মর্যাদায় মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে এম এ জি ওসমানী বাংলাদেশকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব বন্টন করেন। শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ ঘটে মুজিব বাহিনীর (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স - বিএলএফ এর। তাদের অধিনায়কত্বে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, আসম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ, আব্দুল কুদ্দুস মাখন সহ অধিনায়ক হন।

শুরু হয় নয় মরণপর মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতীয় মিত্র বাহিনী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর কাছে পরাজিত হয় পাকবাহিনী। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যৌথবাহিনীর কমান্ডার জগৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করে ৯৫ হাজার পাক সদস্যের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী। পৃথিবীর বুকে অভ্যুদয় ঘটে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের। ২২ ডিসেম্বর মুজিব নগর সরকার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করে। পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা রূপে স্বদেশে ফিরে আসেন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৭ মার্চ ভারতীয় মিত্রবাহিনী স্বদেশে ফেরানোর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে বিশ্ববাসীর সামনে উজ্জ্বল করে তোলেন।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক।