যেমন কাটত নবীজির দিন-রাত

অনেকেরই জানার আগ্রহ, আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের দিন-রাতের ২৪ ঘন্টা কীভাবে কাটাতেন? তিনি দিন-রাত কি কি আমল করতেন? মোটকথা, উনার দৈনন্দিন জীবন কেমন ছিলো? এ নিয়েই বিশেষ প্রতিবেদন।   

যতদুর জানা যায়, নবীজি মধ্যরাতে ঘুম থেকে জেগে উঠতেন। আলহামদু লিল্লাহিল্লাযী আহয়ানা বা’দামা আমাতানা ও ইলাইহিন্ নুশুর-এই দোয়া পড়তেন। ঘুমের মধ্যে তিনি কোন স্বপ্ন দেখলে সাহাবায়ে কিরামকে তা শুনাতেন; আবার সাহাবায়ে কিরামের স্বপ্ন শুনতেন। কখনো এই সময় সাহাবায়ে কিরামদের থেকে হামদ-নাত শুনতেন।

প্রাকৃতিক প্রয়োজনে প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণে তিনি জুতা পরিধান করে মাথা ঢেকে বাঁ পা দিয়ে পায়খানা ঘরে প্রবেশ করতেন। প্রবেশের ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযুবিকা মিনাল খুবসি ওয়াল খাবায়িস’ পূর্বে এই দুআ পাঠ করতেন। আসার সময় পড়তেন, ‘গুফরানাকা আলহামদুলিল্লা হিল্লযী আযহাবা আন্নিল আযা ওয়া আফানি’।

শেষ রাতে  প্রথমে ওযূ করতেন। এই দোয়া বারবার পড়তেন, ‘আল্লাহুম্মাগফিরলী যাম্বী ওয়া ওয়াস্সিলী ফীদারী ওয়া বারীকলী ফি রিযকী’। অর্থাৎ, হে আল্লাহ! তুমি আমার গুণাহ মাফ করে দাও এবং আমার রিযিকে বরকত দাও এবং আমার বাসস্থান প্রশস্থ করে দাও। তিনি ওযূ শেষে আকাশের দিকে তাকিয়ে কালিমা শাহাদাত পড়তেন। এরপর তাহাজ্জুদের নামায আদায় করতেন। ৪, ৬, ৮ বা কখনো ১২ রাকাআত নামাজ আদায় করতেন। হযরত বেলাল (রা:) ফযরের আযান দিলে ২ রাকাআত সুন্নত নামাজ ঘরে আদায় করতেন। এরপর ফজরের নামায মসজিদে আদায় করতেন।

ফজরের পর ফজরের নামাজ আদায় করে কিছুক্ষণ নিজ স্থানে বসে থাকতেন। যিকির ও বিভিন্ন তাসবীহ পাঠ করতেন। কুরআন-হাদিসের বানী শুনাতেন। ওহি নাযিল হলে পরে সাহাবীদের নিকট হুকুম-আহকাম বর্ণনা করতেন। লোকদের মূর্তি পূজা ছেড়ে আল্লাহর ইবাদত করার দাওয়াত দিতেন। ব্যবসা বাণিজ্যে সততা অবলম্বনে গুরুত্বারোপ করতেন।

সাহায্য প্রার্থী এলে তিনি সাহায্য প্রার্থীদের দু'হাত খুলে সাহায্য করতেন। সামর্থবানদের ভিক্ষা না করে খেটে খাওয়ার পরামর্শ দিতেন। প্রতিবেশী, এতিম, বিধবা, ও দুস্থদের প্রতি খেয়াল রাখতেন। তাদের সমস্যা সমাধানে সর্বাত্বক চেষ্টা করতেন।

ঘরোয়া কাজকর্মে অংশগ্র্হন খুশি মনে তিনি কাজে অংশগ্রহন করতেন। ঘর পরিস্কার, পশু-পাখীদের খাবার দিতেন। নিজ হাতে বকরীর দুধ দোহন করতেন। কাপড়, জুতা সেলাই করতেন। বাজার করতেন। নিজ হাতে আটা পিষতেন। ঘরোয়া কাজে তিান সাহায্য করতেন।

রুচি সম্মত পোষাক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামা এবং লুঙ্গি পরিধান করতেন। তাঁর জামার হাতা কব্জি পর্যন্ত লম্বা থাকত। জামা পরিধানের সময় ডানদিক থেকে এবং খোলার সময় বাঁ দিক থেকে শুরু করতেন। তিনি জুমার দিন নতুন পোষাক পরিধান করতেন। সাদা পোষাক বেশী পরিধান করতেন। সাদা ছাড়া অন্য রঙের কাপড়ও পড়তেন। পাগড়ী পড়তেন। পাগড়ীর নীচে টুপিও পড়তেন আবার কখনও শুধু টুপি পড়তেন।

জুতা, আংটি, নখের যত্ন প্রিয় নবী ফিতাযুক্ত জুতা ব্যবহার করতেন। মাঝে মাঝে মোজা পরিধান করতেন। ওযূর সময় মোজার উপর মাসাহ করতেন। তাঁর আংটি ছিল রুপার তৈরী। সেই আংটিতে আল্লাহ, রাসূল, মোহাম্মাদ খোদাই করে লেখা ছিল। তিনি কখনো ডান হাতে বা বাম হাতের মধ্যমায় আংটি পড়তেন। এর দ্বারাই চিঠিতে সীল মোহর দেয়া হতো। ১৫দিন পর পর নখ কাটতেন এবং পায়ের আংগুলের ক্ষেত্রে প্রথমে ডান পা তারপর বাম পায়ের নখ কাটতেন।

পানাহার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঠান্ডা ও মিষ্টি পানীয় পছন্দ করতেন। পেয়ালা বা গ্লাস ডান হাতে ধরতেন। বসে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে অল্প অল্প করে ২-৩ বারে পানি পান করতেন। হাত ধুয়ে মাটিতে বসে দস্তরখানায় খাবার খেতেন। শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে সামনের দিক থেকে খাবার নিতেন। খাবার শেষ হলে আঙ্গুল চেটে খেতেন এবং কোন খাবার পাত্রে অবশিষ্ট রাখতেন না। নিজ পরিবারের সদস্যদের সাথে বসে একত্রে খাবার খেতেন। নিজে এমন ভাবে খেতেন যাতে সাথীদের লজ্জা পেতে না হয়। খাওয়া শেষ হলে দুআ পড়তেন।

কারো ঘরে দাওয়াতে গেলে তিনি মেজবানের জন্য বরকত ও কল্যাণ কামনা করতেন। ধনী গরীব সকলের দাওয়াত কবুল করতেন। তিনি কখনো চেয়ারে বসে বা হেলান দিয়ে খাবার খেতেন না। পেট ভরে খাবার খেতেন না। খেজুর, রুটি, খুরমা, ছাতু ইত্যাদি নিত্যদিনের আহার্য ছিল উনার। তিনি কাচাঁ রসুন, পেয়াজ পছন্দ করতেন না। কেউ খেলে ভাল করে মুখ পরিস্কার করতে বলতেন। মৌসুমী ফল হাদিয়া পেলে আল্লাহর প্রশংসা করতেন। সবচেয়ে কম বয়সীকে প্রথমে খেতে দিতেন।

সুগন্ধি ও তেল ব্যবহার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রায়হান মেশ্ক এবং উদের খোশবু পছন্দ করতেন। গোসলের পর ও রাতে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। মাথায় ও দাঁড়িতে তেল ব্যবহার করে তা চিরুনী করতেন।

চলা ফেরার সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম সাহাবাদের পেছনে চলতে পছন্দ করতেন। তিনি বলতেন, আমার পেছনে ফেরেশতা আসতে দাও।  কোথাও গমনকালে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে রওয়ানা করতেন। উচু স্থানে আরোহনের সময় ‘আল্লাহু আকবার’ এবং নীচে নামার সময় ‘সোবাহান আল্লাহ’ বলতেন। তিনি হাঁচির পরে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলতেন এবং হাঁচির জবাব দিতেন।

মজলিসে অংশগ্রহণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াজ-নসিহত করতেন। পবিত্র কুরআন নাযিল হলে সাহাবীদের মাঝে মাস্আলা-মাসায়েল বর্ণনা করতেন। নিজ পরিবারে হুকুম আহকাম, মাস্আলা-মাসায়েল বর্ণনার নির্দেশ দিতেন। সাহাবীরা সেসব নির্দেশনা পরিবারের সদস্যদের কাছে বর্ণনা করতেন।

রোগীর সেবায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোগীদের দেখা শুনার জন্য পায়ে হেঁটে বাড়ী যেতেন। অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করে রোগীর সেবা যত্ন করতেন এবং কপালে হাত রাখতেন। সান্তনা দিয়ে তার আরোগ্যের জন্য দোয়া করতেন। অমুসলিম রোগীদেরও সেবা শুশ্রুষা করতেন।

তাঁর হাস্য রসিকতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাঝে মাঝে বাস্তবতার নিরিখে কৌতুক করতেন। তিনি একদা জনৈক সাহাবীকে বললেন, ‘ওহে দুই কান ওয়ালা। ’ তিনি জনৈক বৃদ্ধা মহিলাকে বললেন, ‘কোন বৃদ্ধা মহিলা জান্নাতে যাবে না। ’ একথা শুনে বৃদ্ধা কাঁদতে শুরু করল। রাসূলুল্লহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'বৃদ্ধারা যুবতী হয়েই জান্নাতে যাবে'। তিনি মুচকি হাসতেন। জোরে হাসতেন না। কাঁদার সময়ও তিনি শব্দ করে কাঁদতেন না।

পরিচ্ছন্নতা ও চিত্ত বিনোদন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিস্কার পরিচ্ছন্নতাকে ঈমানের অঙ্গ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি নিয়মিত গোসল করতেন এবং সাহাবীদের পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন। তিনি নাক পরিস্কার করতেন বা হাতে। প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের পর বাম হাতে পানি খরচ করতেন। মাঝে মাঝে চিত্ত বিনোদনের জন্য বাগানে যেতেন এবং ঘোড়া, উট, গাঁধার উপর আরোহন করতেন। পশু-পাখির যত্ন নেওয়ার কথা বলতেন। শ্রমিকদের মজুরী ঘাম শুকাবার পূর্বে পরিশোধের জন্য মালিকদের নির্দেশ দিতেন।

জানাযায় অংশগ্রহন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কারো জানাযায় অংশ নিলে জিজ্ঞেস করতেন, তার ওপর করজ আছে কিনা? যদি থাকে তবে সাহাবীদের বলতেন, ‘তোমরা নামাজ আদায় কর। ’ আর যদি পরিশোধের ব্যবস্থা হতো তবে তিনি নিজেই নামায পড়াতেন। কাঁধে লাশ নিয়ে কবর দিয়ে তার জন্য মাগফিরাত কামনা করতেন।

দিনের কর্মসূচীর সমাপ্তি জামায়াতে ইশার নামায আদায় করার পর সাহাবীদের বিদায় দিয়ে নিজ ঘরে যেতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিছানায় থাকত সুরমাদানী, কাঁচি, মেসওয়াক, চিরুনী, তেলের বোতল, আয়না এবং ছোট কাঠ যা দ্বারা তিনি গা চুলকাতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিছানা খেজুর পাতার তৈরী। কখনো তা দুই ভাঁজ করে বহন করা যেত। শোবার পূর্বে চোখে সুরমা ব্যবহার করতেন। ওযু অবস্থায় ডান কাত হয়ে কিবলার দিকে মুখ দিয়ে শয়ন করতেন। সেই সময় তিনি ‘আল্লাহুম্মা বিইসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া’ পাঠ করে সুরা ইখলাস, সূরা ফালাক, সূরা নাস্ পরে দুই হাতে ফুঁ দিয়ে সারা দেহে স্পর্শ করতেন। এই আমল তিনবার করতেন।

(সংগৃহিত)