আজকে চারপাশে চাওয়ার মানুষের সংখ্যাই বেশি

আমার দশ বছর বয়স থেকে পনোরো বছর বয়স পর্যন্ত অদ্ভুৎ এক আলো আধাঁরিতে ভরা ছিল। তখন থেকেই আমার মধ্যে এক অন্য আমি তৈরি হয়েছিল। অনেক যন্ত্রণাময় যেমন ছিল সেই বয়সটা, তেমনি অনেক আনন্দের ছিল। তখন থেকেই আমি ভিষন নিঃসঙ্গতায় ভুগতে শুরু করি। আমার কোনো বন্ধু ছিল না। দলছুট হয়ে গেছিলাম আমি। আমার খেলার সাথীদের সাথেও আমার সখ্য হয়নি কখনো। যা কিছু আমি মায়ের সাথেই শেয়ার করতাম।

এক-একদিন সন্ধ্যেবেলা আমার খুব মন খারাপ লাগত। এমন এক-একটা বিকেল বেলা আছে যখন সূর্য ডুবে যাওয়ার সময়ে অন্তত একটা মায়াবী অপার্থিব আলো এসে পড়তো উঠোনে। আকাশের রং যেত পালটে। সমস্ত বাড়িটায় কেমন এক আলো আঁধারির সৃষ্টি হত। হঠাৎ হঠাৎ আমার বহুজনের মাধ্যে হারিয়ে যাওয়া আমাকে অনুভব করতাম। টের পেতাম আমার আলাদা একা এক ’আমি’ আছে।  

সেই সব বিষন্ন বিকেলে আমার মাঝে মাঝে মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে হত।   সারা বাড়ি খুঁজে মাকে হয়ত পেতাম বড় ঘরের পাটাতনের সিঁড়ির তলায় গামলায় চাল মেপে তুলছে। আমি অবোধ দুর্জ্ঞেও এক বিষন্নতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই যে মার কাছে গেছি তা মা বুঝত না। শুধু একটুক্ষণের জন্য হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিত। একটুক্ষণের জন্য মাথাটা চেপে রাখত বুকে, এই যা।  

স্কুলে পড়ার সময়টায় আমার অনেক কিছুর লোভ হতো। যে যা করত আমি তাই করতে চাইতাম। আমি ক্লাসে ফার্স্ট বয় হতে চাইতাম, আমি মার্বেল খেলতে চাইতাম, ঘুড়ি উড়াতে চাইতাম, চারা খেলতে চাইতাম, ঘুরতে যেতে চাইতাম, ভোরে উঠে আজান দিতে চাইতাম, কোরান মুখস্থ করতে চাইতাম, তিরিশটা রোজা রাখতে চাইতাম,, বডি বানাতে চাইতাম, সুন্দর কাপড় পড়ে ফ্যাশন করতে চাইতাম, সিনেমা দেখতে চাইতাম, লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়তে চাইতাম, স্কুলের গেটে আইসক্রীম খেতে চাইতাম, ঘটি গরম খেতে চাইতাম, চিনা বাদাম খেতে চাইতাম, মেয়েদের দিকে ছ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকতে চাইতাম। অনেক কিছুই চাইতাম।

কিন্তু সব চাওয়া পূর্ন হতো না। কিন্তু কখনো কাউকে বলতাম না। যদিওবা মা কে বলতাম তাও আমার বুক ভেঙ্গে যেতো দ্বিধায়, লজ্জায়। আমার আত্মসম্মানবোধ  খুব প্রখর। প্রত্যাখ্যানকে আমি অনেক ভয় পাই। অনেক তীব্র আকাঙ্খাকে বুকের মধ্যে চেপে রাখতাম। মা একদিন বলল, তুমি তো কখনো কিছু চাও না। না চাইলে মায়েও দুধ দেয় না বুজছ!

আমার ছেলে মেয়েরা পেয়েছে আমার স্বভাব। খুবই অবাক কান্ড যে আমার ছেলে মেয়ে দুজনের একজনও আজ পর্যন্ত মুখ ফুটে আমার কাছে কিছু চায়নি। দশ টাকাও চায়নি আজ পর্যন্ত। ছোট থাকতে যখন আমি বিদেশে যেতাম দু’জনেই শুধু বইয়ের লিষ্ট দিত আমার কাছে। আমি আমেরিকা থেকে কয়েকবার বাক্স ভরে বই কিনে নিয়ে গিয়েছি।

তারপর কানাডা আসার পর যখনই হাই স্কুলে উঠেছে তখন থেকেই দুজনে কাজ শুরু করেছে। তারপর থেকে তাদের পিছনে আমার আর কোনো খরচ নাই। উল্টো আমাকে নানা অকেশনের অজুহাতে কত কি গিফট করে। যখন ওরা ছোট ছিল আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ওদের যেনো কখনো কিছু চাইতে না হয়, ওদের কি দরকার সেটা আমি বুঝতে পারতাম। আমি যে কষ্ট পেয়েছি সেটা যেনো তারা না পায়। তারা কখনো কিছু দাবী করেনি আমার কাছে। আজকে আমার চারপাশে চাওয়ার মানুষের সংখ্যাই বেশি। শুধু পেতে চায়, দিতে চায় খুব কম মানুষ। কেনো যে এই বৈপরিত্য কে জানে! হাত পেতে নেওয়ার মধ্যে কোনো গৌরব নাই বরং গ্লানি আছে।   টেরন্টো ৬ এপ্রিল ২০২১

(ফেসবুক থেকে  নেওয়া)

news24bd.tv/আলী