সন্তানদের লড়াই করা শেখান

তুই একটা অপদার্থ, তোকে দিয়ে কিছুই হবে না- কথায় কথায় অনেক অভিভাবক বাচ্চাদের এভাবে বকেন। অনেকে তখন ধরে নেয়, ছেলেটা বুঝি আসলেই অপদার্থ। আচ্ছা রোজ সকালে সন্তানের স্কুলের ব্যাগ যেই বাবা মা টেনে দেয়, সন্তানকে স্বাবলম্বী হতে শেখায় না, লড়াই করতে শেখায় না, মূল্যবোধ শেখায় না, সেখানে তো এমনই হওয়ার কথা তাই না? 

চিকিৎসকরা বলে থাকেন, বাচ্চা যখন মাটিতে গড়াগড়ি খায়, এটা সেটা খায় তখন শরীরের ইমুনিটি গ্রো করে। ইন্টেস্টিনাল নরমাল ফ্লোরা শরীরে ঢুকায়। অথচ আজকাল বাচ্চাদের মাটির ছোঁয়া পেতেই দেয় না বাবা মায়েরা। ফলে বডি ইমুনিটি আসবে কীভাবে? 

আজকালকার অনেক বাবা-মায়েরা ভাবে, কমপ্ল্যান, বর্নভিটা, হরলিক্স দিয়া হাড্ডি মাংস সবল হবে। কিন্তু আসলে মিল্ক ইনজুরির শিকার হচ্ছে বাচ্চারা। থলথলে তুলার বস্তার মত বাচ্চা। না আছে শক্তি, না আছে সাহস। এদের কান্না থামাতে আমরা হাতে ধরিয়ে দেই মোবাইল-ট্যাব। এদের শৈশব-কৈশোরের লড়াই থাকেনা। এমনকি বড় হওয়ার পরেও দেখেন বাচ্চারা মেডিকেল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাবে, বাবা-মা হাজির। আমরা আসলে এই বাচ্চাদের একা পথ চলতেও শেখাই না।  

কয়েক বছর আগে চিকিৎসক সাঈদ সুজনের একটি লেখা দেখে আমার মাথায় এই কথাগুলো গেঁথে যায়। তাঁর সাথে নিজের ভাবনা যোগ করে গত কয়েক বছর ধরে লিখছি। আচ্ছা শিশু-কিশোরদের কী করে বোধসম্পন্ন লড়াকু মানুষ বানাবো আমরা? পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্র কী শিশুদের বড় হওয়ার উপযোগী?

চারপাশে তাকান। উন্নয়নের জোয়ার। আকাশচুম্বি সব ভবন উঠছে। কিন্তু খেলার ব্যবস্থা নেই। আমি ঢাকার একটা আবাসিক এলাকায় থাকি অথচ একটা খেলার মাঠ নেই। স্কুলগুলোতেও একই দশা। শিক্ষা যেন পণ্য। স্কুল আছে খেলার মাঠ নেই।   বাচ্চাদের দৌড়ানোর জায়গা নেই। নিজের ছায়া দেখেও বাচ্চারা ভয় পায়।   

সংকট সমাধানে আজকাল অনেক বাবা মায়েরা  তাদের সন্তানের জন্য অনেক টাকা পয়সা রেখে যেতে চান। দেশে-বিদেশে বাড়ি, গাড়ি ফ্ল্যাট বা  সেভিংস। উদ্দেশ্য ছেলে- মেয়েরা যেন আরামে বসে খেতে পারে। অনেক সময় অসৎ আয়ে এসব হয়। আর এভাবেই একটা সন্তানরে ভবিষ্যত নষ্ট হয়। তৃতীয় জেনারেশনের ক্ষতি হয়ে যায়। কারন আপনার কষ্টের টাকায় বাচ্চা আরাম করে যখন খাবে, তখন সে আর কষ্ট করে আয় করা শিখবে না।  

ঢাকা শহরের বাড়িওয়ালদের সন্তান দেখুন। কয়জন তারা লেখাপড়া শিখে সেই শিক্ষায় মানুষ হচ্ছ? আবার উল্টো করে দেখুন এই রাষ্ট্রের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-আমলা-কবি প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত থেকে আসা যাদের জীবনটা লড়াই করে কেটেছে। প্রায়ই দেখবেন, কমপ্ল্যান- হরলিক্স আর পিৎজা খাওয়া বাচ্চাদের বদলে লড়াই করে বড় হওয়া নিম্নবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত-মধ্যবিত্তের সন্তানরা লড়াই করে এগিয়ে যাচ্ছে। ‌ কাজেই সন্তানদের লড়াই করা শেখান।  

আমার বাবা শৈশব কৈশোরে একটা কথা সবসময় বলতেন। তিনি আমাদের শেখাতেন, এই যে বাড়ি, গাড়ি,‌ সম্পদ যেগুলো দেখা যায় সেগুলো আসলে সম্পদ না। কিন্তু যেগুলো দেখা যায় না শিক্ষা, জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক, সততা মানবিকতা এগুলিই আসল সম্পদ। ‌ কাজেই সন্তানদের জন্য সম্পদ যতো কম রাখতে পারবেন ততো ভালো।  

এর চেয়ে বরং বাচ্চাকে সময় দিয়ে সুশিক্ষিত ও কর্মঠ করে যান। নিজের আয় নিজে খেয়ে যান। বংশসূত্রেই সুখী হবেন। আপনারা সন্তানটাও লড়াই করা শিখবে। আর সেই সাথে মূল্যবোধ শেখাতে হবে। আর এই মূল্যবোধ শেখার সবচেয়ে বড় জায়গা পরিবার। কিন্তু বাবা-মারা সন্তানদের বললেই কী তারা শিখে যাবে? 

মনে রাখবেন, সন্তানকে যতোই ভালো উপদেশ দেই না কেন, ওরা কিন্তু আমাদের জীবনকে অনুসরণ করবে, উপদেশকে নয়। উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। আপনি অসৎ পথে আয় করবেন, হারাম খাবেন আর সন্তানকে সততার কথা বলবেন তাতে কাজ হবে না। আপনার সন্তান যখন দেখবে আপনি একটা চাকুরি করেন কিন্তু বেতনের চেয়ে আপনার খরচ বেশি, ঘুষের আয়, আপনার সন্তান কিন্তু আপনাকে শ্রদ্ধা করবে না। তার মধ্যে মূল্যবোধ তৈরি হবে না।  

পাশাপাশি শিশুরা দেখে আপনারা কী নিয়ে কথা বলছেন। আগেও লিখেছি। দেখেন, ১৫ বছর বয়সী সুইডিশ কিশোরি গ্রেটা থুনবার্গের কথা জানি যে সারা বিশ্বের পরিবেশ নিয়ে ভাবছে। পৃথিবীকে বাঁচাবার জন্য লড়ছে। এটা কিন্তু এক দিনে হয়নি। সে তার চারপাশ থেকে শিখেছে কেন পরিবেশের যত্ন নেয়া জরুরী।  

কিন্তু আমাদের এখানে আমরা কী করি? কী নিয়ে আলোচনা করি? কী দেখে আমাদের সন্তানরা চারপাশে? কয়জন আমরা আরেকজনের বিপদে দাঁড়াই আমরা? আমাদের সমাজ আমাদের কী শেখাচ্ছে? এলাকায় কাদের দাপট?  আচ্ছা বলেন তো আমাদের শিশু-কিশোররা কাদের দেখে শিখবে? তাদের সামনে আইকন কে? আমাদের সবার মনে রাখা উচিত, আমরা নিজেরা ভালো না হলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে ভালো করা কঠিন।  

কাজেই চলুন সন্তানদের ভালো মানুষ বানাই। শিক্ষা, সততা, বিনয়, মানবিকতা শেখাই। জীবন বোধ শেখাই। রোদ বৃষ্টি উপভোগ করতে শেখাই। লড়াই করতে শেখাই। ভালোবাসা পৃথিবীর সব শিশুদের জন্য। সব বাবা-মায়েদের জন্য। ‌ শুভ সকাল সবাইকে। শুভ সকাল বাংলাদেশ!

শরিফুল হাসান, সিনিয়র সাংবাদিক ও উন্নয়ন কর্মী

(মত ভিন্ন মত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv/আলী