প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নয়, দেশটা জনপ্রতিনিধিরাই চালাক

ইতিহাস বলে এদেশের সমস্ত অর্জন এসেছে রাজনীতিবিদদের হাত ধরে। একজন বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে এদেশের আপামর জনসাধারণ, কৃষক, শ্রমিক, জনতা, ছাত্র, শিক্ষক, বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ একটি জনযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলো। ছিনিয়ে এনেছিলো স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু ছিলেন আপাদমস্তক রাজনীতিক।

বাংলাদেশের মানুষ সত্যিই এখন একটি যুদ্ধ মোকাবিলা করছে। ’৭১-এর মার্চের মতই বাংলাদেশ এই যুদ্ধ শুরু করেছে মার্চেই, সেবারের যুদ্ধে আমাদের প্রধান সেনাপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর এবারের যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গণমানুষের দল। এদেশের মাটি আর মানুষের প্রতিটা অর্জনের সাথে মিশে আছে এই সংগঠনটি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কোন লিমিটেড কোম্পানি বা সোশ্যাল ক্লাব নয়। লাখো কর্মীর আবেগ আর রক্তের অপর নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

করোনা প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় মাঠ পর্যায়ে জনসচেতনতা সৃষ্টিসহ প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিধিদের নেতৃত্বে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এ কমিটি জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা সৃষ্টি, চিকিৎসা বিষয়ক পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান, ভ্যাকসিন প্রদানে উদ্বুদ্ধকরণ ও সহায়তা প্রদানের জন্য কাজ করবে।

শনিবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কোভিড-১৯ এর ২য় ঢেউ প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় মাঠ পর্যায়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির নিমিত্তে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ এবং দিক নির্দেশনা প্রদান উপলক্ষে এক জুম সভায় এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রস্তাবিত কমিটিতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, স্বাস্থ্য, যুব, কৃষি, আনসার ভিডিপি’র মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা, মসজিদের ইমাম, এনজিও প্রতিনিধি, হাট-বাজার সমিতির নেতৃবৃন্দ-সহ সংশ্লিষ্টরা অন্তর্ভুক্ত হবেন।

আমি খুব বিশ্বাস করি রাজনীতিটা রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকা উচিত। কোন প্রেসক্রিপশন; কোন ফর্মূলায় চলা উচিত না। এদেশের কৃষক, গার্মেন্ট শ্রমিক, রেমিটেন্স যোদ্ধা এরা কিন্তু কেউ চুরি করে না। ২০ কোটি মানুষের মুখের সামনে খাবার তুলে দিচ্ছেন ঐ গরীব কৃষক। বৈদেশিক মুদ্রা এনে দিচ্ছে গরীব গার্মেন্ট শ্রমিক। বিদেশ থেকে রেমিটেন্স আসছে পা ফাটা শ্রমিকের রক্তঘামে। এই ৩ শ্রেণির মানুষ শুধু দিয়েই যাচ্ছে। তবে একটা জায়গায় এরা এক; এরা আসলে সবাই গরীব। আর সেই গরীবের রক্ত পানি করা টাকায় আমরা আরাম আয়েশ করছি; বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ছি। একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখুন। একজন প্রবাসী শ্রমিক তার আয়ের প্রতিটা পাই পয়সা দেশে পাঠাচ্ছেন। পাশাপাশি একজন শিক্ষিত লোক কি করছেন? দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছেন। আসল গরীব তাহলে কে?

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়নে দরকার একটি পুনর্জাগরণ; যা দলের ভিতরে-বাইরে সকল ধরনের দুর্নীতি, অসততা ও অন্যায্যতা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তাই আগামী দিনের সকল চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলায় তারুণ্য ও আগামীর নেতৃত্বকে প্রস্তুত করতে হবে। এজন্য শেখ হাসিনার শুদ্ধতার জাগরণে ফিরে আসুক তারা, যারা জীবনবাজি রেখে গেয়েছিলো শিকল ভাঙার গান। যারা দলের দুঃসময়ে জেল, জুলুম, নির্যাতন সহ্য করেছে, দলের জন্য বিভিন্ন সময়ে ত্যাগ স্বীকার করেছে তাদেরকে সামনে আনা হোক।

নগরে আগুন লাগলে দেবালয় কি অক্ষত থাকে? সংকটের সময় বিশ্বাসযাগ্য নেতার অভাব একটু বেশি করেই চোখে পড়ে। মানুষ শেষপর্যন্ত নেতার উপর ভরসা রাখতে চায়; কোন অভিনেতাকে তারা বিশ্বাস করে না। সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। শুভবোধসম্পন্ন অসংখ্য মানুষ এখনো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দিকে তাকিয়ে আছে। এই দমবন্ধ করা পরিবেশ, অব্যবস্থাপনা তাদের হৃদয়ে রক্ত ঝরায়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের লাখ লাখ নেতাকর্মী একটা ডাক এবং সঠিক নির্দেশনার অপেক্ষায়।

পরিকল্পিতভাবে জনপ্রতিনিধিদের চোর বানানো হচ্ছে অথচ প্রশাসনের সর্বত্রই পুকুর নয় সাগরচুরি চলছে। আমরা উন্নয়নের নামে একটা অন্যায্য সমাজ নির্মাণ করেছি। যেখানে ন্যায্যতা নেই, সেখানে হৃদয় নেই। বাংলাদেশের সামনে কোভিড -১৯ পড়া মাত্রই প্রমাণ হয়ে গেলো, কি ঠুনকো এই দেশের উন্নয়ন! কি ভঙ্গুর এই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা!

এক অপরিকল্পিত, লোভী, দুর্নীতিবান্ধব উন্নয়ননীতির খপ্পরে পড়েছে দেশ। ঘটনা, দুর্ঘটনা, রোগব্যাধির মহামারি চলছে। জনবান্ধব, পরিবেশবান্ধব ও সমবণ্টনের উন্নয়ননীতি কোথাও নেই। প্রশাসন আইনের প্রয়োগ করতে অনেকটাই ব্যর্থ। তথাকথিত এই উন্নয়নের ফল ভোগ করছে কেবল সমাজের অভিজাতরাই। মাঝেমধ্যে যারা ছিটাফোঁটা ভাগ পাচ্ছে, তারাও অভিজাতে পরিণত হচ্ছে। মধ্যবিত্তের অবস্থা খুবই করুণ। মধ্য ও নিম্নবিত্ত বেঘোরে মারা পড়ছে পথেঘাটে, নদীতে, ভবনে। জীবনের দাম লাশ হওয়ার পর কয়েক লাখ টাকায় নেমে এসেছে। একটি দুর্ঘটনামত্ত, রোগব্যাধিগ্রস্ত ও অপরাধী সমাজের বিকাশ ঘটছে।

দেশে অনেক উন্নয়ন হচ্ছে, এর লাভ কি, যদি জীবনেরই নিরাপত্তা না থাকে। যে জীবন পুড়ে যাওয়ার, গাড়িচাপা পড়ার, উন্নয়নের ফল ভোগ করার আগেই অপঘাতে ফুরিয়ে যাওয়ার, সে জীবনের মূল্য কোথায়? প্রশ্ন হচ্ছে, কিসের জন্য এত উন্নয়ন, কার জন্য এই উন্নয়ন? এই ঝাঁ চকচকে সুউচ্চ ভবন, প্রশস্ত তকতকে মহাসড়ক বা বিশাল বিশাল সেতু; অবশ্যই উন্নয়নের মাপকাঠি। অগ্রগতিরই ইঙ্গিত দেয় এসব। কিন্তু সেই ভবনে গিয়ে যদি পুড়ে মরতে হয়, মহাসড়কে গিয়ে যদি দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়, হাসপাতালে চিকিৎসা মেলে না, এই উন্নয়নের মূল্য কোথায় রইলো? অভিশপ্ত এই উন্নয়ন থেকে মেঠো পথ আর কুঁড়েঘরই তো ভালো ছিল।

শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন করলেই হবে না, এর সঙ্গে সুশাসনও জরুরি। তবেই টেকসই উন্নয়ন হবে। নিশ্চিত হবে সামাজিক ন্যায়বিচার। দেশে সুশাসন থাকলে ইউনাইটেড হাসপাতালে অগ্নি নির্বাপনের ব্যবস্থা থাকতো, সেজান জুস কারখানায় পুড়ে ছাই হতে হতো না ৫৩ তাজাপ্রাণকে, সড়কে নিয়ন্ত্রণ থাকতো, খাবারে বিষ থাকতো না। বাতাস থাকতো পরিশুদ্ধ। গায়ে গা ঘেঁষে এতগুলো সুউচ্চ ভবন নির্মাণ হতো না। দেশের অগ্নিনির্বাপক বাহিনী আরও আধুনিক হতো। নতুন নতুন যন্ত্রপাতি থাকতো। সুশাসন না থাকলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন দেখিয়ে অগ্রগতি হয়েছে বলে কৃতিত্ব জাহির করা যাবে, কিন্তু মৃত্যুর মিছিল থামবে না।

গত বছর বনানীতে ফায়ার সার্ভিসের পাইপের ছিদ্র চেপে ধরা সেই বালকের ছবিটা আপনারা দেখেছেন নিশ্চয়ই। এটা একটি প্রতীকী ছবিমাত্র। আসলে আমাদের রাষ্ট্রের বিশাল বিশাল ছিদ্র রয়েছে। সেই সব ছিদ্র সারাতে হবে সবার আগে। কিন্তু সর্বগ্রাসী এক দুর্নীতিবান্ধব প্রশাসন ও উন্নয়ননীতির কারণে সব থমকে আছে। এসব ছিদ্র মেরামত না করলে মানুষ কোন দিনই নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে না। এই সব ছিদ্র মেরামত করা জরুরি এবং সেটা খুব দ্রুতই। মিথ্যা কথার মৃত্যুনগরীর বাতাস থেকে লাশের গন্ধ দূর করতেই হবে।

কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৭৯ সালে লিখেছিলেন, ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’। সে ছিল ভিন্ন সময়, ভিন্ন প্রেক্ষাপট। এখনো বাতাসে লাশের গন্ধ পাওয়া যায়, অন্য কোন প্রেক্ষাপটে। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ লিখেছিলেন, ‘ঘুম আসে না’। এখনো স্বজনহারা অনেকেরই ঘুম আসে না।

শেখ হাসিনা শুধু আওয়ামী লীগের নেত্রী নন, তিনি সাধারণ মানুষের শেষ ঠিকানা। এভাবে আর চলে না। আবারও বলছি, বঙ্গবন্ধুকন্যা সঠিক পথে রয়েছেন। কোন অন্যায় দীর্ঘমেয়াদে চলতে পারে না। ক্ষমতায় থাকতে হয় মানুষের মন জয় করে। উন্নয়ন ব্যাহত হয় আইনের শাসনের অভাবে। সুন্দর আগামীর পথে বাধা সৃষ্টিকারী দানবদের প্রতিরোধ করতে হবে সবাইকে মিলিতভাবেই। কোভিডের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যে অব্যবস্থাপনা এবং সমন্বয়হীনতা তার বড় কারণ জনপ্রতিনিধি এবং রাজনীতিকদের দূরে রাখা। মাঠ পর্যায়ের জরিপ ছাড়া এসিরুমে বসে একের পর এক ভুলভাল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সকালে এক প্রজ্ঞাপন তো বিকেলে আরেক প্রজ্ঞাপন। খেটে খাওয়া মানুষের নাভি:শ্বাস উঠেছে। মাঝখান থেকে সরকার গালি খাচ্ছে। এর একটা সুরাহা হওয়া উচিত। সবার আগে দরকার রাজনীতিটা রাজনীতিবিদদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নয়; দেশটা জনপ্রতিনিধিরাই চালাক।

(মত ভিন্ন মত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

বাণী ইয়াসমিন হাসি, সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট

news24bd.tv/আলী