রক্তদানে কোন ভয় নয়

১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবস 

রক্তদানে কোন ভয় নয়

ডা. হাসনাইন নান্না

আজ ১৪ জুন (মঙ্গলবার) বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। ২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য অধিবেশনের পর থেকে প্রতি বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ দিবস পালনের জন্যে তাগিদ দিয়ে আসছে। বিশ্ব রক্তদাতা দিবসের উদ্দেশ্য হলো, স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচাতে যারা ভূমিকা রাখছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, জনগণকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করা, মানুষের মাঝে সংহতি এবং সামাজিক সম্প্রীতি বাড়াতে রক্তদানের গুরুত্ব প্রচার, রক্তদানের ক্ষেত্রে অমূলক ভয় দূর করা, নতুন রক্তদাতা তৈরি করা এবং নিরাপদ রক্ত ব্যবহারে উৎসাহিত করা। সেইসাথে প্রাণঘাতী রক্তবাহিত রোগ হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইসিস সি, এইডস, সিফিলিস এবং ম্যালেরিয়া রোগ থেকে নিরাপদ থাকার জন্যে স্বেচ্ছা রক্তদান ও রক্তের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা।

 

২০২২ সালে বিশ্ব রক্তদাতা দিবসের বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজক দেশ মেক্সিকো। এ দিবসকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হবে মেক্সিকো সিটিতে। প্রতিবছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দিবসটির একটি প্রতিপাদ্য বিষয় ঠিক করে। ২০২২ সালে দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয়- Donating blood is an act of solidarity. Join the effort and save lives.

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালন করা হয় বিশ্ব রক্তদাতা দিবস।

দিনটি এতো গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ হলো, রক্তদাতাদের সহযোগিতায় বিশ্ব জুড়ে বেঁচে যাচ্ছে অসংখ্য প্রাণ। বিশ্বের প্রায় ৬২টি দেশে শতভাগ স্বেচ্ছা রক্তদানের মাধ্যমে রক্ত সংগ্রহ করা হয়। উন্নত বিশ্বে স্বেচ্ছা রক্তদানের হার প্রতি এক হাজারে ৪৫ জন আর বাংলাদেশ তথা উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রতি হাজারে চার জনেরও কম। বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার তুলনায় বছরে প্রায় ১৪ লক্ষ ইউনিট রক্তের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, আমাদের রক্তদাতার সংখ্যা খুব সামান্য। স্বেচ্ছায় রক্তদাতার হার মাত্র ৩১ শতাংশ। বাংলাদেশে ঘাটতি পূরণ ও অনিরাপদ রক্তের ব্যবহার বন্ধ করতে বর্তমানের চেয়ে বছরে মাত্র ৫ লক্ষ ব্যাগ অতিরিক্ত সংগ্রহ করতে হবে। ৬ থেকে ৭ লক্ষ মানুষ যদি বছরে অন্তত দুই বার রক্তদান করে, তাহলেই এ ঘাটতি পূরণ হতে পারে।  

রক্তের প্রয়োজনে মানুষকেই রক্ত দিতে হয়। এখন পর্যন্ত রক্তের বিকল্প তৈরি হয়নি। নিরাপদ রক্ত সরবরাহের মূল ভিত্তি হলো স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রক্তের চাহিদা বেশি হলেও স্বেচ্ছায় রক্তদানকারীর সংখ্যা কম। রক্তদানে প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করে আমাদের মনের ভয় এবং কিছু ভুল ধারণা।  

রক্তদান নিয়ে কিছু ভ্রান্ত ধারণা 
অনেকেই আছেন রক্ত দিতে ভয় পান। কিসের ভয়? আসুন এক এক করে দেখি কোন সেসব ভয়, যা আপনাকে পিছিয়ে রাখে?

১. সুঁইয়ের ভয়
অনেক সামর্থবান পুরুষ বা নারীই রক্ত দিতে চান না সুঁইয়ের ভয়ে। ইনজেকশনের যে সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত নেয়া হয়, তা দেখেই ভড়কে যান অনেকে। অথচ এটি ছোট্ট একটা পিঁপড়ের কামড়ের চেয়ে বেশি কিছু নয়। তাও সেটা হিমোগ্লোবিন চেক করবার উদ্দেশ্যে আঙুলে ফোটাবার মুহূর্তটুকুতেই। রক্ত যখন নেয়া হবে, তখন আপনি টেরই পাবেন না।

২. অসুস্থ হবো, দুর্বল হয়ে পড়ব
কেউ কেউ ভাবেন, রক্ত দিলে অসুস্থ হয়ে যাবেন বা দুর্বল হয়ে পড়বেন। বাস্তব সত্য এর উল্টো। হৃদরোগ, ক্যান্সার বিশেষ করে ফুসফুস, লিভার, কোলন, পাকস্থলী ও গলার ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোসহ ১৭টিরও বেশি রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে রক্তদান। রক্তদানের সাথে সাথে দেহের বোন ম্যারো বা অস্থিমজ্জা নতুন কণিকা তৈরির জন্যে উদ্দীপ্ত হয়। ফলে সুস্থতা, প্রাণবন্ততা আর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
কোয়ান্টাম ল্যাবে রক্ত দিয়ে একজন দাতা তার সার্বিক সুস্থতাকে যাচাই করে নিতে পারেন। ফলে প্রতি চার মাসে এক বার করে বছরে তিন বার হয়ে যাচ্ছে তার ব্লাড প্রেশার, পালস রেট থেকে শুরু করে হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, সিফিলিস, এইডস এবং ম্যালেরিয়া স্ক্রিনিং টেস্ট। নিজের সুস্থতা সম্পর্কে একটি বছরে বিনামূল্যে এতোবার আশ্বস্ত হওয়ার সুযোগ আর কোথায় পাবেন?

৩. মা-বাবার বাধা
রক্ত দেয়ার ক্ষেত্রে তরুণ-তরুণীদের একটা বড় অংশেরই বাধা তাদের মা-বাবা, পরিবার। এটা অবশ্য ঘটছে রক্তদান সম্পর্কিত যেসব ভুল ধারণার কথা যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজে প্রচলিত, তার কারণে। মা-বাবা ভাবেন, রক্ত দিলে সন্তান হয়তো শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে, দুর্বলতায় ভুগবে বা বড় কোনো ক্ষতি হবে তার। তাছাড়া অনেকে ভাবেন, রক্ত যদি দিতেই হয় তো সেটা যেন পরিবারের সদস্য, নিকটাত্মীয় বা বন্ধুর জরুরি প্রয়োজনে দেয়া হয়, গয়রহ মানুষকে নয়। এখন বাস্তবতা হচ্ছে, রক্ত দেয়া হোক না হোক, নির্দিষ্ট একটা সময়ের ব্যবধানে তা এমনিই বদলে যায়। যেমন, রক্তের প্রধান তিন উপাদানের একটি- অনুচক্রিকার আয়ু ৮-৯ দিন, শ্বেতকণিকার আয়ু ১৩-২০ দিন এবং লোহিত কণিকার আয়ু ১২০ দিন। নির্দিষ্ট এ সময় পর কণিকাগুলো নিজে নিজেই ধ্বংস হয়ে যায়। কাজেই আপনি বা আপনার সন্তান যদি রক্ত দেয় তো একজন মুমূর্ষু মানুষের জীবন বাঁচাল। আর না দিলে প্রস্রাব বা পায়খানার সাথে তা বেরিয়ে গেল। আর নিকটাত্মীয় বা বন্ধুর প্রয়োজনে রক্ত জমিয়ে রাখার কিছু নেই। আজ যদি আপনি একজন অচেনা মুমূর্ষের প্রয়োজনে রক্ত দেন, প্রকৃতির প্রতিদান অনুসারেই আপনি তখন দেখবেন অজানা অচেনা সব মানুষ এগিয়ে এসেছেন আপনার যখন আপনার প্রিয়জনকে রক্ত দিতে।

৪. অন্যরা তো দিচ্ছেই
অন্যরা দিচ্ছে বটে! কিন্তু এই অন্যরা কতজন? আপনি কি জানেন, আমাদের দেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ রক্ত লাগে, তার মাত্র ২৫ ভাগ দেন স্বেচ্ছা রক্তদাতারা? বাকি ৭৫ ভাগই দেয়া হয় পেশাদার রক্ত বিক্রেতারা অথবা রোগীর আত্মীয়-পরিজনরা। তার মানে প্রয়োজনীয় রক্তের বড় অংশটাই এখনো মেটাতে হচ্ছে অনিরাপদ উৎস থেকে। রক্তদানের ভীতি কাটিয়ে আপনি কিন্তু এই নিরাপদ উৎসের ভাগটাই বাড়াতে পারেন।

৫. আমার রক্তের গ্রুপ তো কমন, সহজেই পাওয়া যায়
সহজে পাওয়া যায়, এমনকিছুও যখন সময়মতো পাওয়া যায় না, তখন সেটাই দুষ্প্রাপ্য, দুর্মূল্য! আর রক্ত এমন জিনিস যার বিকল্প শুধু রক্তই। আপাতদৃষ্টে যাকে আপনি বলছেন কমন, প্রয়োজনের সময় সেটাই না পেয়ে হয়তো বিপন্ন হতে পারে কোনো মুমূর্ষের জীবন। কাজেই সময়মতো দিলে আপনার এই সহজলভ্য রক্তই হয়তো বাঁচিয়ে দিতে পারে একটি প্রাণ!

৬. আমি তো রক্ত দিতে পারিনি
কোনো এক সময় আপনি হয়তো রক্ত দিতে চেয়েও পারেননি, কারণ আপনার শারীরিক অবস্থা রক্তদানের অনুকূল ছিল না। তার মানে এই নয় যে, এখনও আপনি রক্ত দিতে পারবেন না। কারণ মানুষের দেহের জৈব রাসায়নিক অবস্থা প্রতিনিয়তই বদলায়। পরীক্ষা করে দেখুন, এখন হয়তো আপনি ‘রক্তদানে সমর্থ বিবেচিত হতেও পারেন!

৭. রক্ত দিতে গিয়ে যদি কোনো রোগের সংক্রমণ হয়!
এটা এক অমূলক ভয়! কারণ ডঐঙ রক্ত পরিসঞ্চালনের যে সেফটি স্ট্যান্ডার্ড বেঁধে দিয়েছে সেটা পুরোপুরি মেনে চলে, কোয়ান্টাম ল্যাবের মতো এমন সব ল্যাবে এর কোনো সুযোগই নেই। কারণ রক্ত দেয়ার সময় একজন ডোনারের মিনি মেডিকেল চেক আপ থেকে শুরু করে রক্তদানের পুরো প্রক্রিয়ায় তাকে আলাদাভাবে মনোযোগ দেয়া হয়। রক্তদানের সময় ব্যবহৃত প্রতিটি উপকরণ যাতে জীবাণুমুক্ত হয় এবং একবার ব্যবহার করেই তা ফেলে দেয়া যায়, সেটাকে নিশ্চিত করা হয়। মেডিকেল এসব বর্জ্যকে যাতে যথাযথ স্থানে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে- নিশ্চিত করা হয় সেটাও।

৮. আমার শরীরে তো এমনিই রক্ত নেই
আমি কী রক্ত দেবো? আমার শরীরে তো এমনিই রক্ত নেই! এহেন ভাবনা অনেককে রক্তদানে নিরুৎসাহিত করে। কিন্তু আপনি কি জানেন আপনার দেয়া যে রক্তটুকু আরেকটি মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে, আপনার নিজের জন্যে তা বাড়তি? ৫০ কেজি ওজনের পূর্ণবয়স্ক একটি পুরুষদেহের ১৩০০ মিলিলিটার রক্তই বাড়তি, নারীদের ক্ষেত্রে এটা ৮০০ মিলিলিটার। আর রক্ত দিতে এলে একজন ডোনারের কাছ থেকে নেয়া হয় মাত্র ৩৫০-৪০০ (সর্বোচ্চ ৪৫০) মিলিলিটার রক্ত, যা এই বাড়তি রক্তের অর্ধেকেরও কম। আর এ ক্ষয় পূরণও হয়ে যায় খুব দ্রুত।

৯. আমার রক্তের অবস্থা ভালো না
অনেকের রক্তে, বিশেষত নারীদের- আয়রন বা লৌহের পরিমাণ কম থাকে। আর আয়রন কম মানে হিমোগ্লোবিন কম। রক্ত দেয়ার ক্ষেত্রে এটা একটা বাধা। তবে চেষ্টা করলেই রক্তের এই লৌহ বাড়ানো যায়। বেশকিছু খাবার আছে, যা নিয়মিত খেলে দেহে লৌহের চাহিদা সহজেই পূরণ হতে পারে। আর তাছাড়া ভিটামিন সি লোহাকে ধরে রাখতে সাহায্য করে। তাই আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরে ভিটামিন সি-যুক্ত ফল খেলে এসব খাবারের লোহার পুরোটাই আপনার দেহ গ্রহণ করবে।

১০. এতো বেশি রক্ত নেবে যে অসুস্থ হয়ে পড়ব!
রক্ত দেয়ার সময় একজন ডোনারের দেহ থেকে নেয়া হয় এক পাইন্টেরও কম পরিমাণ রক্ত (৩৫০-৪৫০ মিলি), যা একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরে মোট রক্তের শতকরা ১৩ ভাগেরও কম। আর নতুন রক্তকণিকা ও রক্তরস উৎপাদনের মাধ্যমে রক্তের এ ক্ষয়পূরণ হয়ে যায় খুবই দ্রুত। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই আপনি আগের অবস্থায় ফিরে যাবেন শুধু নয়, পুনরায় রক্ত বা রক্তকণিকা দানও করতে পারবেন। মাত্র দুসপ্তাহের মাথায়ই আপনি প্লাটিলেট দিতে পারবেন। প্লাজমা দিতে পারবেন চার সপ্তাহে। হোল ব্লাড ও রেড সেল দিতে পারবেন তিন থেকে চার মাসের মধ্যে।

১১. আমার সময় নেই
আজ যদি আপনার কোনো বন্ধু, সহকর্মী, পরিজন বা স্বয়ং আপনার নিজেরই রক্তের প্রয়োজন হতো, আপনি কি এ যুক্তি মানতে পারতেন? পারতেন না। কোয়ান্টাম ল্যাবে রক্ত দিতে গড়ে একজন ডোনারের ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় লাগে। এক ব্যাগ এই রক্তকে প্রসেসিং করে চার ব্যাগ রক্ত উপাদানে আলাদা করা যায় কোয়ান্টাম ল্যাবে। বাঁচানো যায় চার জন মুমূর্ষুকে। এতো অল্প কিছু সময় ব্যয়ে এতো বড় উপকার করার সুযোগ আপনি আর কোথায় পাবেন?

আসুন রক্ত দিন। ঠুনকো এসব ভয় যেন রক্তদানের মতো মহৎ কাজে আপনাকে পিছিয়ে না দেয়! 

রক্ত দানের পর করণীয় 
বিশ্রাম নিন :
একটু বিশ্রাম নিন। রক্ত দেয়ার সাথে সাথেই বেরিয়ে যাবেন না বা গাড়ি চালাবেন না

পানি পান করুন প্রচুর : দেহের মোট ওজনের আট ভাগই রক্ত। আর রক্তের ৫৫ ভাগই হলো রক্তরস বা প্লাজমা, যার ৯০ ভাগই আসলে পানি। সুতরাং আপনি যে রক্ত দেন তার ওজন এক পাইন্টের কম হলেও আসলে এর অর্ধেকটাই পানি। এজন্যেই রক্ত দেয়ার আগে এবং পরে আমরা পর্যাপ্ত পানি খেতে বলা হয় (অন্তত ৫০০ মিলিলিটার)। তাহলেই রক্ত দেয়ার পর ক্ষয়টা দ্রুত পুষিয়ে যায়।

প্রোটিন ও শর্করাজাতীয় খাবার : বেশ পরিমাণ প্রোটিন এবং শর্করা আছে এমন খাবার ও পানীয় খেতে পারেন। যেমন, জুস বা শরবত। কোয়ান্টাম ল্যাবে রক্তদানের পরপরই আমরা ডোনারদের গ্লুকোজ  দিয়ে থাকি। এটা খুবই উপযোগী।

ব্যায়াম ও শারীরিক কসরত : রক্তদানের পরপরই যে-কোনো ধরনের ব্যায়াম যেমন, জিমন্যাসিয়াম এবং নাচ বা দৌঁড়ের মতো শারীরিক কসরতের কাজ করবেন না।

জ্ঞান হারিয়ে ফেললে : রক্তদানের পর কাউকে কাউকে অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখি আমরা। এটা হয় সাধারণত লো ব্লাড প্রেশারের কারণে। ঘাড়ের ধমনীতে ব্যারোরিসিপটর নামে বিশেষ একধরনের নার্ভসেলের কারণে রক্ত দেয়ার পর পরই দেহে খবর হয়ে যায় যে, রক্তচাপ কমে গেছে। এই শূন্যতা পূরণের জন্যে রক্তকণিকাগুলো তখন সংকুচিত হয় এবং রক্তচাপকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। আর রক্ত দেয়ার পর পরই কেউ যদি দ্রুত উঠে যান বা হাঁটতে শুরু করেন, তখন আকস্মিক রক্তচাপ নেমে যাওয়ার ফলে কারো কারো শরীরটাকে হালকা মনে হতে পারে, অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে ইত্যাদি। এটাকে এড়ানোর জন্যে যা করতে পারেন তা হলো, রক্ত দেয়ার পর পরই না উঠে কিছুক্ষণ সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে পারেন। খেয়াল রাখতে হবে, এসময় মাথার নিচে যেন কোনো বালিশ বা উঁচু কিছু না থাকে। কারণ মাথাটাকে রাখতে হবে হার্টের লেভেলে, যাতে হার্ট থেকে ব্রেনে পর্যাপ্ত রক্ত যেতে পারে। আর নামার আগে কিছুক্ষণ পা ঝুলিয়ে বিছানায় বসে থাকতে পারেন।  

তাহলে আর অপেক্ষা কেন?
একবার রক্ত দেয়ার পর পরবর্তী ছয় থেকে ১২ সপ্তাহ পর আপনি আবার রক্ত দিতে পারবেন। এ সময়ের মধ্যে সাধারণত হিমোগ্লোবিনের মাত্রা আগের অবস্থায় ফিরে যায়। প্রশ্ন হলো, কেন এ সময়টা লাগে? আসলে শ্বেতকণিকা বা অনুচক্রিকার ক্ষয়টা পূরণ হয়ে গেলেও লোহিতকণিকার ক্ষয় পূরণ হতে কিছুটা সময় লাগে। আর লোহিত কণিকার সাথে সুস্থতার একটা সম্পর্ক আছে। কারণ লোহিত কণিকায় থাকে হিমোগ্লোবিন অণু, যার প্রধান কাজই হলো সারাদেহে অক্সিজেন বয়ে নিয়ে যাওয়া। আর হিমোগ্লোবিনে থাকে আয়রন, রক্ত দেয়ার সময় যা কিছুটা হারায়। এটা পূরণ করার জন্যে তখন একদিকে দেহের লৌহভাণ্ডার বেশি বেশি ব্যবহৃত হয়, অন্যদিকে খাবার এবং পানীয় থেকে তৈরি হতে থাকে বেশি বেশি আয়রন। অতএব রক্ত দিন, বাঁচান প্রাণ।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, হৃদরোগ বিভাগ
খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ, সিরাজগঞ্জ