"একজন প্রধানমন্ত্রীর ছেলের ব্যাংক ডাকাতির দরকার কি? টাকা চাইলে তো ব্যাংক ম্যানেজাররাই টাকা এনে পৌঁছে দেবেন" উপর্যুক্ত মন্তব্যটি বিশ্ববিখ্যাত পত্রিকা লন্ডনের "ডেইলী টেলিগ্রাফের স্বনামধন্য সাংবাদিক পিটার হেজেল হার্স্টের।
একটি স্বার্থান্বেষী মহল "বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে শেখ কামাল ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত" মর্মে একটি রিপোর্ট প্রকাশের অনুরোধ করলে এভাবেই জবাব দেন বিদেশি সাংবাদিক পিটার।
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী নামধারী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদের মুখপাত্র কবি আল মাহমুদ সম্পাদিত দৈনিক গণকন্ঠের ১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বরের সংখ্যাটিতে ব্যানার লিড করা হয়েছিল "প্রধানমন্ত্রীর ছেলে শেখ কামাল ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত" শিরোনামে। মওলানা ভাসানী ও স্বাধীনতা বিরোধী মশিউর রহমান যাদু মিয়ার দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মুখপাত্র "হক কথা" একই শিরোনামে ওই মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে বঙ্গবন্ধু সরকারকে চরম বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল।
এই দুটি সরকার বিরোধী পত্রিকা
জঘন্য এক মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চেয়েছিল। অসাধারণ ক্রীড়া অনুরাগী আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা ও ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রাণপুরুষ সংস্কৃতিমনা শেখ কামাল এরকম কাজ করতে পারেন, তা কেবল বিকৃত মস্তিষ্কের লোকেরাই চিন্তা করতে পারেন।
সেদিনের প্রকৃত ঘটনার দিকে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-উপাত্ত দিয়ে মানুষের দৃষ্টি ফেরাতে চাই।
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭৩ সাল।
ঢাকার তৎকালীন পুলিশ সুপার মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম এর ভাষ্যমতে, রাজধানীতে তখন মোটে আটটি থানা। প্রতিটি থানায় ২৪ জন করে পুলিশ সদস্য ছিল। পুলিশ লাইনেও অস্ত্রধারী পুলিশের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন দুরূহ বিষয় ছিল। "কালো দিবস" এর লিফলেট প্রচারের পর পুলিশকে সাহায্য করতে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও লাল বাহিনীসহ আওয়ামী লীগের কর্মীরা মাঠে নামে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে গাড়ির রেজিষ্ট্রেশন নম্বর ও স্ব স্ব নাম লিপিবদ্ধ করে পুলিশের সঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশের সঙ্গে অবস্থান নেয় তারা। ১৫ ডিসেম্বর বিকাল থেকে এ তৎপরতা জোরেশোরে চলতে থাকে। সেদিন রাতে ঢাকা কলেজের সামনে অবস্থিত ছাত্রলীগের কার্যালয়ে ছিলেন। সর্বহারা পার্টির অপতৎপরতা রোধে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার পর একটি মাইক্রোবাসে ওঠেন।
সহকর্মীরা হলেন, কাজী সিরাজ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সাহেদ রেজা, আনোয়ারুল হক তারেক, রুহুল আমিন খোকা, শাহীন চৌধুরী, রেজাউল কবির, বরকত-ই-খোদা, তারেক, শাহান, সানি, বরকত, মনির প্রমুখ।
আরেকটি জিপ গাড়িতে ছিলেন শেখ রফিকসহ আরও কয়েকজন। শেখ কামালকে নিয়ে মাইক্রোবাসটি মতিঝিলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় এবং এক পর্যায়ে কমলাপুর রেলস্টেশন সংলগ্ন চিটাগং হোটেল থেকে খাওয়ার জন্য বিরিয়ানি নিয়ে নেয়। বের হওয়ার আগে শেখ কামাল ও তার সঙ্গীরা পুলিশ কন্ট্রোল রুমের খাতায় তাদের নাম ও গাড়ির রেজিষ্ট্রেশন নম্বর লিখে না রাখায় বিপত্তির আশঙ্কা দেখা দেয়। টহলরত পুলিশের ম্যাসেজ চলে যায় কন্ট্রোল রুমে। পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে ওয়ারলেসের মাধ্যমে সংবাদ প্রেরণ করতে থাকে যে, লোকজন ভরা একটি মাইক্রোবাস সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করছে।
এদিকে জাসদ ও সর্বহারা পার্টি বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান পণ্ড করার জন্য দুদিনই ১৪ ডিসেম্বর ভারতীয় এয়ারলাইনস অফিস ও দৈনিক বাংলার অফিসে শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জনমনে ত্রাস ও আতঙ্কের সৃষ্টি করে রেখেছিল। যাহোক শেখ কামাল তার সহকর্মীদের নিয়ে যখন ঘুরাঘুরি করছিল, তখন রাত ১০ টা হবে। পুলিশের একটি বিশেষ টিমে ছিল এসআই মতিন, আতিক ও হালিম টহল দিচ্ছিলো মিরপুর রোডে, অপরদিকে সার্জেন্ট কিবরিয়া, এসআই নিয়ামত আলী ও রফিকউল্লাহর দলটি দায়িত্বে ছিল মতিঝিল এলাকায়। রাত আনুমানিক ১১ টায় পুলিশ "কন্ট্রোল রুম" থেকে বেতারে সংবাদ আসতে থাকে যে, মতিঝিল পুলিশ ফাঁড়ি এলাকায় সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করেছে। এ খবর শুনে মতিনের একটি পুলিশ দল ফাঁড়ির কাছে পৌঁছে যায়। সার্জেন্ট কিবরিয়া ও এসআই নিয়ামতের দলটি মতিঝিল হোটেল আল হেলালের সামনে রওয়ানা হলে দেখতে পায় যে, একটি মাইক্রোবাস ও একটি জিপে আনুমানিক ১৪/১৫ জন যুবক তাদের গাড়ির পিছু নিয়েছে এবং খুব দ্রুত তাদের দিকে ধেয়ে আসছে।
সার্জেন্ট কিবরিয়া ও এসআই নিয়ামত ধারণা করেন, এরা সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির সদস্য এবং তাদের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি। সাহায্য নেয়ার জন্য তারা দ্রুত মতিঝিল পুলিশ ফাঁড়ি পৌঁছাতেই ফাঁড়ির প্রহরী অপ্রস্তুত ও হতভম্ব হয়ে যায়। এসআই আবদুল হাই এর আগ্নেয়াস্ত্র থেকে একটি "মিস ফায়ার" হয় এবং একই সময় পেছনের মাইক্রোবাস ও জিপটি ফাঁড়ির সামনে থাকা সার্জেন্ট কিবরিয়া ও এসআই নিয়ামতের গাড়ির পেছনে পৌঁছে যায়। মিস ফায়ারের বিকট শব্দে পুলিশ ফাঁড়ির সব সদস্যরা মনে করে, সন্ত্রাসীরা ফাঁড়ি আক্রমণ করেছে। এ অবস্থায় বেশিরভাগ পুলিশ গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে এবং একটি গুলি পুলিশের গাড়ি ভেদ করে বেতারযন্ত্র বিনষ্ট করে দেয়।
উল্লেখ্য, আবাহনী ক্লাবের সাদা রঙের ফোকসওয়াগন মাইক্রোবাসটিই মূলত শেখ কামাল চালাতেন। দলবল নিয়ে সেটা নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। ওদিন শেখ কামালের সঙ্গে গাড়িতে ছিলেন দশ জন। শেখ কামাল বসেছিলেন সর্ব ডানে। সামনের সারির মাঝখানে বসেছিলেন আনোয়ারুল হক তারেক। দ্বিতীয় সারিতে চালকের আসনের বামদিকে বসেছিলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র রুহুল আমিন খোকা। ডানে বসেছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মনির, তৃতীয় সারিতে বসে ছিলেন ইকবাল হাসান মাহমুদ, মাঝখানে বসেছিলেন বরকত-ই খোদা এবং ডানে বসেছিলেন চুয়াডাঙ্গার কাজী সিরাজ। মাইক্রোবাসটি ছিল ৯ সিটের। খোকা নামক আরেক জন আকারে ছোটখাটো ছিল বিধায় পেছনের লাগেজের পাশে বসেছিলেন। অপর সারিতে ছিলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র রেজাউল করিম, সাহেদ রেজা, শেখ রফিক, আক্কাস ও মিন্টু, হান্নান, রুবেল আহমেদ বাবু ও তার ভাগ্নে শাহান চৌধুরী। তো দুটো গাড়ি ভরা ছিল, একটায় দশজন আরেকটায় পাঁচজন।
মতিঝিল আল হেলাল হোটেলের সামনে দেখতে পেলেন একটি লাল রঙের গাড়ি পার্ক করা। তখন সেই গাড়িটা তাদের দেখেই চলা আরম্ভ করলো সামনের দিকে। তারা পিছে পিছে যাচ্ছে কিন্তু শাহান দেখতে পেলেন গাড়ি থেকে অ্যান্টেনা বের হয়ে আছে। ওয়াকিটকি। আগের ওয়াকিটকর বেশ লম্বা অ্যান্টেনা ছিল। তারা জানে এটা পুলিশের গাড়ি এবং সেই গাড়ির পিছে পিছেই যাচ্ছিলো যে, পুলিশের সঙ্গে দেখা হলে, পুলিশ থেকে ঘটনাটি কি জানা যাবে। এদিকে পুলিশের গাড়ির আরোহীরা জানেন না, পিছের গাড়িতে শেখ কামালরা আছেন। পুলিশের পিছে লোক ভর্তি একটা মাইক্রোবাস। তার পিছে একটা জীপ। এটা দেখে পুলিশ হয়তো কভার নিতে চাচ্ছিল, পুলিশ একটু জোরেশোরে গাড়ি চালিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশের গলি, যে কালভার্টের গলিটা,সেটা মুসলিম লীগ নেতা আইয়ুব খানের মন্ত্রী অহিদুজ্জামানের বাসা। স্বাধীনতার পর সরকার সেটি দখলে নেয়। বাড়িটিকে স্পেশাল ব্রাঞ্চের দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখান থেকে একটি টয়োটা গাড়ি করে যাচ্ছিলেন সার্জেন্ট শামীম কিবরিয়া। তিনি ফাঁড়িতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সব আলো নিভিয়ে দেয়া হয়। সবাইকে পজিশন নিতে নির্দেশ দিলেন ওয়াকিটকির মাধ্যমে। পুলিশ একটু ভড়কে গিয়ে ফাঁড়ির দিকে ছুটে। শেখ কামালের গাড়িও পিছে পিছে যাচ্ছিল।
হঠাৎ সামনের গাড়িটা স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে ওয়াকিটকির মাধ্যমে সবাইকে জানায় যে, পেছনে দুটো গাড়ি আছে এবং নিশ্চয়ই সেই গাড়ি দুটো সন্ত্রাসীদের হবে। অথবা সর্বহারা পার্টির হবে। হঠাৎ লাইট বন্ধ করে এলোপাতাড়ি গুলি করা শুরু করে। চারদিক থেকে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেলের গুলি। অজস্র ধারায় গুলি। পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়। একজনের তিনটি আঙুল উড়ে যায়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দরজা খুলে শেখ কামাল দৌড়ে ভেতরে চিৎকার করে বলতে থাকে, "আমি শেখ কামাল, আমি শেখ কামাল। " সার্জেন্ট শামীম কিবরিয়া ও এসআই নিয়ামত আলী গুলি করা বন্ধ করে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। , স্যার ভুল হয়ে গেছে, আমরা ভেবেছি সন্ত্রাসীদের গাড়ি। শেখ কামালের কাঁধ থেকে দুটি গুলিই বের করা সম্ভব হয়। আরেকটা গুলি মস্কোতে গিয়ে বের করা হয়।
সার্জেন্ট কিবরিয়া দ্রুত ফাঁড়িতে ঢুকে চিৎকার করে বলে ওঠেন, "পেছনের দুটো গাড়ির সন্ত্রাসীরা আমাদের আক্রমণ করেছে। " সঙ্গে সঙ্গে ফাঁড়ির একজন এসআই সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য করে বার্স্ট-ফায়ার করেন। গুলিতে মাইক্রোবাসের ভেতরেই পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন। মাইক্রোবাস থেকে শেখ কামাল চিৎকার করে বলতে থাকেন, "পুলিশ ভাইয়েরা, আমি শেখ কামাল। "
এ কথা শুনে এসআই নিয়ামত বলেন, "আপনি শেখ কামাল হলে সামনে লাইটপোস্টের সামনে আসেন। " গুরুতর জখম অবস্থায় শেখ কামাল ও একে একে সবাইকে মাইক্রোবাস থেকে নামিয়ে পুলিশ তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। এসআই মতিন ও তার সহকর্মীরাও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হাজির হয়।
শেখ কামালের গুলিবিদ্ধ হওয়ায় স্থানটি ছিল মতিঝিল শাপলা চত্বরের উত্তর দিকে জনতা ব্যাংক ও পেট্রোল পাম্পের বিপরীত দিকে জেনারেল আইয়ুব খানের বানিজ্য মন্ত্রী ওহিদুজ্জামানের বাড়ি হতে একশ' গজ উত্তরে কালভার্টের ওপরে (৫৪ এর নির্বাচনে এই ওহিদুজ্জামানই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পরাজিত হন। )
প্রসঙ্গত, শেখ কামালের সঙ্গীরা কমলাপুর রেলস্টেশন সংলগ্ন চিটাগং হোটেল থেকে যখন বিরিয়ানি নিচ্ছিলো তখন, আজম খান (পপ সম্রাট), মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল মেসবাহউদ্দিন সাবু, বরিশালের বাহাউদ্দীন, হিলু, ইকবাল, জহুর ও মুসলেউদ্দীন ও সরফুদ্দিন সান্টুসহ ৭/৮ জন যুবক আড্ডা দিচ্ছিল। ওদিন আজম খান ও বাহাউদ্দীন পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে গালগল্প করছিলেন। তারা শেখ কামালের চিৎকার শুনে মাইক্রোবাসের দিকে এগিয়ে গিয়ে যান। মতিঝিল ফাঁড়ির ইনচার্জ সার্জেন্ট রউফ ও কন্ট্রোল রুমের সার্জেন্ট সুলতানও তখন উপস্থিত ছিলেন।
স্পেশাল টিমের পুলিশ সদস্যরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে রমনা থানায় হাজির হয়ে প্রাণভিক্ষা প্রার্থনা করেন। তাদের তাৎক্ষণিক ক্লোজ করা হয়। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার এবং ডিএসপি মোল্লা তৈয়বুর রহমান তাদের থানাতেই আটকে রাখেন।
এ বিষয়ে ঢাকার তৎকালীন পুলিশ সুপার মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম আমাকে বলেছেন, "সেদিন শেখ কামালের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবেই পুলিশ সদস্যদের রমনা থানায় ক্লোজ করি এবং হাসপাতালে ছুটে যাই। ততক্ষণে শেখ কামালকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়েছে।
কর্তব্যরত চিকিৎসক বলেন, " আউট অব ডেঞ্জার, ভয় নেই, গুলি ভাইটাল অর্গানে বিদ্ধ হয়নি। " মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম বলেন, সেদিন আমি রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে শেখ কামালের সুচিকিৎসা ও অপারেশনের ব্যবস্থা করে বাসায় ফিরি, তখন প্রায় রাত ভোর হয়ে গেছে। শেখ কামালের চিকিৎসার খোঁজখবর নেই এবং পরদিন সাতসকালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে বলি চিকিৎসকরা জানিয়েছেন জীবনাশঙ্কা নেই।
বঙ্গবন্ধুকে বলি, আমার পুলিশ অফিসাররা কামালকে গুলি ছুঁড়ে আহত করেছে বিধায় দায় আমার। এ ঘটনা ভুল বোঝাবুঝির জন্য হয়েছে। যদি দোষ হয়ে থাকে সবটাই আমার, যদি শাস্তি কাউকে দিতে হয়, সবার আগে আমাকে দেবেন। "
বঙ্গবন্ধু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, "তুই যা, ভালো মতো খোঁজখবর নে। যদি কোনো ষড়যন্ত্র থাকে আমাকে বলবি। "
এসপি মাহবুব বললেন, বঙ্গবন্ধু প্যারেড গ্রাউন্ডে নিয়ে গেলেন আমাকে। কুচকাওয়াজের ফাঁকে কানে কানে বললেন,"তোর ভাবী শুনলে ভীষণ চটে যাবে। যারা গুলি করেছে তাদের আপাতত ক্লোজ করে রাখ। ছাত্রলীগের কাছ থেকে যেনো ওরা দূরে থাকে। কটা দিন গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। "
এরপর আইজিপি নূরুল ইসলামের পরামর্শে আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম মনসুর আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধুকে তুমি যখন বলেছো, তখন চিন্তা বেশি করো না। আমি দেখব।
পরের দিন বঙ্গবন্ধু আমায় ডেকে পাঠালেন। বললেন "হাসপাতালে যাব গোপনে, তুই সঙ্গে যাবি। " আমি সন্ধ্যার পর গাড়ি নিয়ে বাড়ির পেছনে উপস্থিত হলাম। বঙ্গবন্ধু গাড়িতে বসলেন। বললেন, "চালা, দেখিস তোর ভাবি তোর ওপর রাগ করতে পারে, কিছু মনে করিস না। কেবিনে ঢুকলেন বঙ্গবন্ধু, আমি সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ভাবী বেদনা ভারাক্রান্ত কন্ঠে বেশ
জোরেশোরে বললেন, "তোমার রাজত্বে তোমার ছেলে তোমার পুলিশের গুলি খায়। আমি আর এ দেশে থাকব না। আমার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বিদেশ চলে যাব। "
বঙ্গবন্ধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা আইজিপি কাউকেই কোনো নির্দেশনা দেননি। ফলে পুলিশ ও প্রশাসনের কোনো তেমন তৎপরতা ছিল না। মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম বলেন, তৎকালীন সিটি এডিশনাল এসপি আব্দুস সালাম এবং আমি উভয়ই তদন্ত করেছি।
"বাংলাদেশ ব্যাংকে ডাকাতি? "
মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে ডাকাতি করতে হলে হাজার টন বোমা ফেলে ব্যাংকের ভল্টে ঢোকা যাবে না। রাস্তা হতে ব্যাংকের ভল্টে পৌঁছতে হলে অনেকগুলো দরজা ভাঙতে হবে, বড় বড় তালা খুলতে হবে এবং শক্তিশালী দরজা ভাঙতে হলে হেভি মর্টার ফায়ার করতে হবে।
সুতরাং ব্যাংক ডাকাতির প্রপাগাণ্ডা যারা ছড়িয়েছে তারা জ্ঞানপাপী, অপশক্তি। ডাকাতি করতে হলে ডাকাতির সরঞ্জাম কই? নিদেনপক্ষে তালা ভাঙার যন্ত্র কিংবা গুচ্ছ গুচ্ছ চাবি! অথবা লোহার শিকের দরজা ভাঙা শাবল কিংবা গাইত! বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান ফটকে গার্ড পাহারাদার? কই কারো আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার খবর তো ছিল না।
শেখ কামাল ছিলেন দীর্ঘ ও ঋজু দেহের অধিকারী এক শৌর্যবীর্যে ঠাসা এক সুপুরুষ। ঠোঁটের ওপর ঘনগোঁফ, চোখে কালো ফ্রেমের মোটা কাঁচের চশমা শেখ কামালকে পরিণত করেছিলো ছাত্র যুবসমাজের আইকন রূপে। আগস্টেই তার জন্মমৃত্যু, ১৯৪৯ এর ৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট এই ছাব্বিসটি বছর তার জীবনকাল।
একুশ বছর বয়সেই মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানীর এডিসি হিসাবে দায়িত্বশীল ভূমিকার স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে কমিশনপ্রাপ্ত হন এবং ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার সামরিক কর্মকর্তার পদ ছেড়ে দেন। নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায়।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সক্রিয় সংগঠক শেখ কামাল বাকশাল ভুক্ত জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। স্বাধীনচেতা মুক্তবুদ্ধি ও প্রতিভা উদীপ্ত এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বাবা-মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে নিহত হওয়া শেখ কামালের আজ জন্মদিন। জন্মদিনে অনিঃশেষ ভালোবাসা বিদেহী আত্মার প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক।
news24bd.tv/কামরুল