দুই বছর আগে সামরিক অভ্যত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশটির গণতন্ত্রকামীদের আন্দোলন ও বিদ্রোহী বাহিনীগুলোকে কঠোর হাতে দমন করছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। দেশটির সেনা সদস্যদের দাড় করানো হচ্ছে মিয়ানমারের সাধারণ জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে। তাদের দিয়ে চালানো হচ্ছে নৃশংস হামলা-অত্যাচার। দীর্ঘ লড়াইয়ের চাপে অনেক সেনাসদস্যই এখন পক্ষ ত্যাগ করছেন।
অন্যদিকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে আগ্রহী হচ্ছেন না কেউ।সব মিলিয়ে দুই বছর আগে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা মিয়ানমারের জান্তা সরকার গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনে হিমশিম খাচ্ছে বলে সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন দেশটির পক্ষত্যাগী কয়েকজন সেনা সদস্য।
তেমনই একজন সেনাসদস্য নে অং (ছদ্মনাম)। দুইবারের চেষ্টায় সেনাবাহিনী থেকে পালাতে সক্ষম হন তিনি।
মিয়ানমারের নির্বাসিত ন্যাশনাল ইউনিটি গভার্নমেন্টের (এনইউজি) তথ্যের বরাতে বিবিসি বলছে, ২০২১ সালে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর দেশটির ১৩ হাজার সেনা ও পুলিশ সদস্য দেশত্যাগ করেছেন। আরো সেনা যাতে পক্ষ ত্যাগ করেন, সেজন্য নগদ অর্থের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে।
থাইল্যান্ডের গোপন সেই আশ্রয় শিবিরের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য মাউং সেইন। ১৯ বছর বয়সী এই তরুণ সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন ১৫ বছর বয়সে। বিবিসিকে মাউং বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই সামরিক বাহিনীতে চাকরি করার ইচ্ছা ছিল। এছাড়া আমি চাইতাম, আমার পরিবার যেন আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করে। এ কারণেই সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলাম। ’
একসময় সাধারণ জনগণের মনে সামরিক বাহিনীর প্রতি সম্মান থাকলেও ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর গণতন্ত্রপন্থী সরকারকে ফিরিয়ে আনার দাবিতে যে জনবিক্ষোভ শুরু হয়েছিল—তা নিষ্ঠুরভাবে দমনের পর থেকে মিয়ানমারের সাধারণ জনগণ এখনকার সামরিক বাহিনীকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখছে উল্লেখ করে মাউং বলেন, ‘একদিন অনলাইনে দেখলাম লোকজন আমাদের ‘মিলিটারি কুকুর’ বলে সম্বোধন করছে। এ ব্যাপারটিতে আমি খুব অপমান ও দুঃখ বোধ করলাম এবং ওই দিনই বাহিনী থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। ’ প্রসঙ্গত, কাউকে কুকুর বা এই জাতীয় চতুষ্পদী প্রাণীর নামে সম্বোধন করা মিয়ানমারের সংস্কৃতিতে বড় ধরনের অপমান বলে গণ্য করা হয়।
পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) নামে পরিচিত বেসামরিক মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর একটি নেটওয়ার্কের পাশাপাশি সীমান্ত এলাকায় সক্রিয় জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলো অনেকের ধারণার চেয়ে এখন অনেক বেশি শক্তিশালী বলে প্রমাণিত হচ্ছে। এদের সঙ্গে লড়াইয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী দেশের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণও হারিয়েছে।
দেশটির মাগওয়ে এবং সাগাইং বিভাগ থেকে একসময় সামরিক বাহিনীতে প্রচুর জনবল নিয়োগ করা হলেও এখন এই দুটি স্থানের তরুণরা মিলিশিয়া গ্রুপগুলোতে যোগ দিতে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন।
মং সেইন সেনাবাহিনী থেকে পালানোর আগে, তার ইউনিটকে পিডিএফের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে হামলা এবং ধ্বংসের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে তাদের সেই অভিযানের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর হয়নি। লড়াইয়ে সাত সেনা সদস্য নিহত হন এবং তারা শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য হন। ‘তাদের (পিডিএফ) রণকৌশল ছিল আমাদের চেয়ে ভালো’ বলেন মং।
গ্রামবাসীদের কাছ থেকেও দারুণ সহায়তা পাচ্ছে পিডিএফ। সামরিক বাহিনীর চলাচল সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য পিডিএফের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি তরুণ যোদ্ধাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করছে গ্রামবাসী।
১৮ বছর মিয়ানমার বিমানবাহিনীতে কাজ করা ক্যাপ্টেন জেই থু অং অভ্যুত্থানের এক বছর পর ২০২২ সালে পক্ষ ত্যাগ করে পালিয়ে যান। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বর্তমান অবস্থার বর্ণনায় তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘তারা সারাদেশেই হামলার মুখে রয়েছে। পাল্টা আঘাত করার মত পর্যাপ্ত জনবলও নেই তাদের। ’ এ কারণেই দেশটির সামরিকবাহিনী বিমানশক্তির ব্যবহার ক্রমাগত বাড়াচ্ছে। তার কথার সত্যতাও খুঁজে পেয়েছে বিবিসি। জানুয়ারি থেকে কমপক্ষে ২০০টির বেশি বিমান হামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতি হামলাটি চালানো হয় গত এপ্রিলে সাগাইং অঞ্চলের পা জি গাই গ্রামে। সেখানে বিমান হামলায় নারী ও শিশুসহ ১৭০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়।
মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর দাপটের কথা শোনা গেলেও এর প্রকৃত আকার সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, অভ্যুত্থানের সময় দেশটির সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা তিন লাখের মত থাকলেও এখন অনেকটাই কমে গেছে।
অন্যদিকে সরকারবিরোধীরা ভিডিও গেমসের মত প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি তহবিল বাড়াতে জনগণের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা পাচ্ছে। এই অর্থসহায়তার একটা মোটা অংশের জোগান আসে বিদেশ থেকে। তারা যথেষ্ট তহবিল সংগ্রহ করতে পারলেও তাদের হাতে সামরিক বাহিনীর মত অস্ত্র কিংবা যুদ্ধবিমান নেই।
বিমান কিংবা নৌবাহিনীর কোনো সদস্য যুদ্ধবিমান অথবা যুদ্ধজাহাজ নিয়ে পালাতে পারলে পাঁচ লাখ ডলার করে দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছিল ন্যাশনাল ইউনিটি গভার্নমেন্ট-এনইউজি। কিন্তু এখনো কেউ সেটা করে দেখাতে পারেননি ।
news24bd/ARH