যেসব কারণে হারলেন মাহিয়া মাহি

যেসব কারণে হারলেন মাহিয়া মাহি

অনলাইন ডেস্ক

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-১ আসনে ‘চৌধুরী সাহেবের’ কাছে বিপুল ভোটে হেরেছেন ঢাকাই সিনেমার চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি (শারমিন আক্তার নিপা)। তিনি রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ট্রাক প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন।

মাহির নির্বাচনী আসনে ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৪০ হাজার ২১৮ জন। ১৫৮টি কেন্দ্রের ফলাফল গণনা শেষে দেখা গেছে, মাহিয়া মাহি এই আসন থেকে মোট ভোটের মধ্যে মাত্র ৯,০০৯ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন।

আর আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী টানা তিনবারের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী পেয়েছেন ১ লাখ ৩ হাজার ৫৯২ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কাঁচি প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম রাব্বানী পেয়েছেন ৯২ হাজার ৪১৯ ভোট।

তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী জামাল খান দুদু সোনালী আঁশ প্রতীকে ২৭৩ ভোট, বিএনএমের প্রার্থী মো. শামসুজ্জোহা নোঙ্গর প্রতীকে ১ হাজার ৯১১ ভোট, জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. শামসুদ্দিন লাঙ্গল প্রতীকে ৯৩৮ ভোট, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সহধর্মিণী আয়েশা আক্তার জাহান ডালিয়া বেলুন প্রতীকে ২ হাজার ৭১৮ ভোট, এনপিপির প্রার্থী নুরুন্নেসা আম প্রতীকে ২৯৬ ভোট, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের বশির আহমেদ ছড়ি প্রতীকে ৩৩৫ ও বিএনএফের প্রার্থী মো. আল সাআদ টেলিভিশন প্রতীকে ৬০৩ ভোট পেয়েছেন।  

এ ছাড়া প্রতীক বরাদ্দের পর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে গোলাম রব্বানীকে সমর্থন দেওয়া আওয়ামী লীগ নেতা মো. আখতারুজ্জামানের ঈগল প্রতীকে পড়েছে ২০২ ভোট।

মাহির এই ভোটের সংখ্যা রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনে বাতিল হওয়া ভোটের চেয়ে কিছুটা বেশি। তবে শুধু তানোর উপজেলায় তিনি বাতিল হওয়া ভোটের চেয়েও কম ভোট পেয়েছেন। তানোরের মুণ্ডুমালা উত্তরপাড়া গ্রাম মাহির জন্মস্থান। তার বাড়িও রয়েছে সেখানে। জেলার ছয়টি আসনের মধ্যে রাজশাহী-১ আসনে প্রার্থীর সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি।

মাহিয়া মাহি বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। গত ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচনী প্রতীক পাওয়ার পর থেকে নির্বাচনের প্রচারণায় ঝড় তুলেছিলেন মাহি।  প্রচারণায় বক্তব্যে টানা তিনবারের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীকে কখনো ‘জমিদার সাহেব’, কখনো ‘চৌধুরী সাহেব’ সম্বোধন করে বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন। বক্তব্যে বারবার তিনি ‘অত্যাচারী জমিদার’ উল্লেখ করেছেন। সিনেমা স্টাইলে বক্তব্য দিয়ে বলেছেন, ‘চৌধুরী সাহেবের টাকা আছে কিন্তু মন নেই। ’ প্রচারণায় এমন জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে ঝড় তুললেও আশানুরূপ ভোট পাননি তিনি।

বিনোদন জগতে মাহির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। তবে ভোটে কেন এমন ভরাডুবি হলো নায়িকার!

চিত্রনায়িকা মাহির হারের পর এলাকাবাসী তাকে নিয়ে নানান কথা বলেছেন। তাদের অনেকের মতে, এলাকার উন্নয়নে প্রচারণার মাঠে কিংবা নির্বাচনী ইশতেহারে নানান প্রতিশ্রুতি দিলেও মাহির প্রতি আস্থা নেই এলাকাবাসীর। ভোটের মাঠেও তিনি নবীন।  

ভোটাররা জানান, মাহি ছাড়াও রাজশাহী-১ আসনে আরও দুইজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। বর্তমান সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে কাঁচি প্রতীকের প্রার্থী গোলাম রাব্বানীর জয়ের সম্ভাবনা থাকায় সবাই তাকে ভোট দিয়েছে। এছাড়া স্থানীয় রাজনীতিবিদরাও মাহির সাথে না থাকায় মাহি ভোট টানতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি।

ভোটাররা আরও জানান, মাহি প্রার্থী হিসেবে একেবারেই নতুন হওয়ায় আস্থার জায়গাতেও সংকট রয়েছে। এছাড়া মাহি নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও ভোটারদের মধ্যে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।

আরও পড়ুন: নৌকা পেয়েও যেসব কারণে হারলেন মমতাজ  

এর আগে ভোটের প্রচারণায় আওয়ামী লীগের নেতারাও মাহিয়া মাহিকে নির্বাচন থেকে চলে গিয়ে সিনেমায় মনোযোগ দিতে পরামর্শ দিতে দেখা গেছে।  

এদিকে পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ না হওয়ায় নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ উল্লেখ করেন মাহিয়া মাহি। বলেন, ফলাফল যা হওয়ার হয়েছে, হেরে গেলেও সবাইকে জানাচ্ছি, আমি এলাকাবাসীর সঙ্গে আছি। এটা আমার প্রথম নির্বাচন। অন্যদের মতো আমি একদম পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ নয়। অনেকেই আমার বয়সের আগে থেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাদের কার্যক্রম যতটা মসৃণ হবে, সেখানে আমার তো একটু ঘাটতি থাকবেই। তবে ওভারঅল সবকিছু ভালোই আছে। নির্বাচনে ফেল করেছি এখন এটা আমার কাছে বড় বিষয় নয়। আমি মানুষের এত কাছাকাছি গিয়েছি, এত বয়স্ক মানুষের দোয়া পেয়েছি যা বলার মতো নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়েছি এবং অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। মানুষের কষ্টের কথাগুলো শুনেছি। এর থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। তাদের জন্য আমার অনেক করণীয় আছে।

নির্বাচনের পরদিন সোমবার রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক লাইভে এসে মাহি বলেন, ‘সবাই নিশ্চয়ই ভাবছেন আমার প্রচন্ড মন খারাপ, হ্যাঁ কিছুটা তো মন খারাপ হবেই। নির্বাচন তো একটা গেইম। আর সেই গেইমে আমি হেরে গিয়েছি। তবে আমি যেকোনো অবস্থায় নেতিবাচক চিন্তাভাবনা করে রাখি। আমি এই অবস্থার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। ’ 

নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করবেন জানিয়ে মাহি বলেন, ‘আমার ইশতিহারে যে কথাগুলো বলেছিলাম নারীদের প্রত্যেকটা ঘর হবে একেকটা কর্মসংস্থান। তরুণরা হবে উদ্যোক্তা।

এটা আমি বড় পরিসরে কতটা করতে পারব ঠিক জানি না। কারণ কর্মসংস্থান করার ব্যাপারে সরকারিভাবে যে উদ্যোগ নেওয়া হয় সেটা ব্যক্তিগতভাবে একটু চ্যালেঞ্জিং। তবু আমি আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগে করার চেষ্টা করব। ’ 

জয়ী ওমর ফারুক চৌধুরীর উদ্দেশ্য মাহি বলেন, ‘তানোর গোদাগাড়ী বাসীর রাস্তার যে বেহাল দশা, বাংলাদেশের রাস্তাঘাট এত উন্নত সেখানে আমার এই এলাকায় এখনো গরুর গাড়ি চলার মতো অবস্থা। বর্ষার দিনে হাঁটু পরিমাণ কাদা হয়। বরেন্দ্রভূমিতে যে পানির সমস্যা এই দুইটা জিনিসের প্রতি নজর দেওয়ার অনুরোধ করব নতুন যিনি নির্বাচিত হয়েছেন তাঁকে। ১৫ বছর ধরে যে উন্নয়নমূলক কাজ করেননি তা যেন এই পাঁচ বছরে করেন। ’ 

মাহি আরো বলেন, ‘আমি কিন্তু মাঠে আছি। আগামী পাঁচ বছর পর আবারও নির্বাচনের মাঠে দেখা হবে আপনাদের সঙ্গে। ’

প্রতিপক্ষকে উদ্দেশ্য করে মাহি বলেন, ‘আগামী পাঁচ বছরে আমার জন্য যারা মাঠপর্যায়ে কাজ করবে সেসব কর্মীদের কোনো রকম হয়রানি যদি আপনারা করেন তাহলে মনে রাখবেন আমি কিন্তু অন্যান্য প্রার্থীদের মতো এত দুর্বল না। আমি মানসিকভাবে যতটা শক্তিশালী, আমার কর্মীদের যদি একটু অপমানও আপনারা করেন সেটাও প্রতিহত করার জন্য আমি লড়ব। আমি তাঁদের জন্য জানও দিয়ে দিতে পারি। ’

নির্বাচন অনেক সুষ্ঠু হয়েছে জানিয়ে মাহি বলেন, ‘যে যার যোগ্যতা অনুযায়ী ভোট পেয়েছে। যদিও আমি কম ভোট পেয়েছি। কিন্তু মেয়ে মানুষ হয়ে যে আমি নির্বাচন করেছি এটাই সকলের প্রশংসা করা উচিত। প্রশাসনও খুব সাহায্য করেছে। ’

উল্লেখ্য, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শুরুতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন মাহিয়া মাহি। কিন্তু দল তাকে মনোনয়ন না দেওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের লড়াইয়ে মাঠে নামেন নায়িকা।

news24bd.tv/TR