অনির্বচনীয় বার্তা যত

অলংকরণ:কামরুল

মুক্তগদ্য

অনির্বচনীয় বার্তা যত

অনলাইন ডেস্ক

একেকজন মানুষ আসেন জীবিত কিংবা মৃত যিনি আমূল-পরিবর্তন প্রয়াসী হয়ে আগ্রাসন চালান আমার ভেতর। অথবা আমিই চাই তেমন কিছু হোক। এইবছর প্রথম পড়া উপন্যাস  শহীদুল জহিরের - আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু। এমন সহজ সরল ভাবে যেন হাতের কড়ে আঙুল ধরে আমাকে তিনি ধীরে ধীরে এ বলয়, ও মহল্লা, সে অফিস ঘুরিয়ে নিতে নিতে শেষ পর্যন্ত যে দৃশ্যের সামনে এনে ছেড়ে দিলেন তখন আমার অবস্থা সত্যিই বেদিশা! 
কিন্তু ঘোর এমনই জিনিস যার নাগাল একবার পেলে মন কেবলই ছুটতে থাকে।

কাজে দেরি হয়ে যায়। আনমনা মন কেবলই ভাবাতে থাকে আমাকে - এভাবেও বলা যায়! মজার ব্যাপার হলো শহীদুল জহিরের জন্ম ১১ই সেপ্টেম্বর, আমারও! 
দেরি - শব্দটাকে আজকাল আমি গোনায় ধরি না। হয়তো কোনো কালেই ধরতাম না। যেমন ধরি না 'তাড়াতাড়ি' শব্দটাকেও।
যা ভালো, তা দেরি করে এলেও ক্ষতি নেই। এলেই হলো।  
ভালোর জন্য তাড়াহুড়োও কিছু নেই।
মূল কথা হলো যা আসবে তা যেহেতু আবার নিজ নিয়মে থেমেও যাবে। তাই যতটা সম্ভব গ্রহণে সমর্থ হতে হবে।  
ভালো  ব্যাপারগুলো এমনই যা মনকে পুরা বর্ষার আমেজ দিয়ে আর্দ্র করে রাখে। সেখানে সবুজ কচি চারার মত সুন্দর সুজলা সুফলা ভাবনারা অঙ্কুরিত হতে থাকে। মন থেকে কেবল সুবাসিত নির্যাস ছড়িয়ে দেয় সবখানে, সবার কাছে।  

মনে পড়ে কথা বলাও একটা আর্ট তা শিখেছিলাম শানুর কাছে। হাইস্কুলে সবে উঠেছি। বয়ঃসন্ধিকালে একরকম কথা বলাই প্রায় যখন বন্ধ হয়ে গেছিলো। যখন কথা বললে প্রচন্ড কর্কশ শোনাতো নিজের কানেই। যখন মনে হতো কেউ কেন বুঝছে না আমাকে?  কেন সব আমার মতের উল্টো মতে চলে? তখন জীবনে এলো শানু।

বাড়ি পালটে এক রকম বোবা জীবন যাপন করছি। তখন একদিন আম্মার সাথে নিচ তলায় গেছি। শানু, ঢাবির ছাত্রী, আমাকে বলেছিল পিয়া আজকে চৈত্র সংক্রান্তি, যাবা আমাদের সাথে?  আম্মার দিকে তাকালাম। কারণ উত্তর দেবার নিয়ম ছিল না আমার। আম্মা বলল, 'আচ্ছা যা'। তখনও জানি না চৈত্র সংক্রান্তি কী। পহেলা বৈশাখেও ও-ই প্রথম শানু নিয়ে গেছিলো নিজের সাদা লাল পাড় জামদানী শাড়ি পরিয়ে। মৃদুস্বরে সব সময় হাসি মাখা মুখে গুছিয়ে কথা বলত শানু। আমাকে একদিন বলেছিল, 'আমাকে নাম ধরে 'তুমি' করে বলতে পারো। ' খুব লজ্জা পেলেও আমার থেকে চৌদ্দ বছরের বড় মানুষটার বন্ধু হয়ে গেলাম। সে কেন আমাকে অমন আপন করেছিল জানি না। পূর্ণেন্দু পত্রির কবিতার বই, 'কথোপকথন' উপহার দিয়েছিল আমাকে। ও-ই প্রথম আমার আধুনিক কবিতা পড়া। ওর বইয়ের আলমারিতে ছিল আমার অবাধ বিচরণ। শাড়ির আলমারিও আমার জন্য খোলা ছিল। কিন্তু আম্মা পছন্দ করত না অন্যের শাড়ি পরা।   সে জীবন আজ অতীত। শানুও চলে গেছে অসময়ে। জীবনকে বিদায় জানিয়ে। বুকের ভেতর রেখে গেছে গুচ্ছ গুচ্ছ স্মৃতি। আর কথা। পদে পদে তাঁকে মনে পড়ে।  

আজকাল জীবন এতো কঠিন হয়ে উঠেছে যে মনে হয় শুষ্ক  মরুর মতো আমরা । আমাদের যেন মরুভূমিতে আগন্ত্তুকের মতো নিছক ঘুরে বেড়ানোই কাজ। যেন মানুষ না একেকটা মরুভূমি! ঘুরেফিরে কাছে আসে, দূরে চলে যায়। আমিও তেমন এক খরখরে উষর-মরু। বা দ্বীপ। মানুষগুলো দুরে দুরে একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। জ্বলে । নিভে । একা একা।
মনে হয়, কারো কিছু পাবার নেই আমার কাছে। কারো কাছে কিছু নেবার মতোও যেন নেই আর! এ কেমন জীবন! 

যদি  তেমন কোনো বিপদ আপদ না ঘটে তাহলে একজন মানুষ এখন কত বছর বাঁচে? গড় আয়ু আমাদের সত্তর বা তার কিছু বেশি বা কম। এই লম্বা সময় ধরে ফলনশীলতা'র বদলে যদি ধ্বংসের দিকে ধাবিত হতে থাকি তাহলে আমরা মনে মনে মরে যাই প্রকৃত মৃত্যুর বহু আগে!

শুরু হয়েছে নতুন বছর। আরও একটা কঠিন বছর। কঠিন শব্দটা বা বিষয়টা  জীবনে ওতপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে গেছে দুই হাজার বিশ সাল থেকে। কোভিডের করাল থাবার ভয় উৎরানোর আগেই শুরু হয়ে গেলো যুদ্ধ। ইউক্রেন -রাশিয়া। তারপর ইজরাইল ফিলস্তিন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, রাজনৈতিক অস্থিরতা আমার এই ক্ষুদ্র জীবনেও প্রচন্ডরকম প্রভাব ফেলে বীর দর্পে তা বেড়েই চলছে। সংসার খরচ বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। ওদিকে আয় ক্রমহ্রাসমান।   সরকারি নিয়ম নীতি সকল কিছু সরকারের সাথে জড়িতদের জন্য সুফল দিয়ে চলেছে। ছাপোষা মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ীর কাছে জীবন এখন অনেকটা বোঝার মত।

প্রতিনিয়ত তিক্ততার স্বাদ প্রবেশ করছে দৈনিক যাপনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এর মধ্যে একটা ভোট কার্য সম্পাদন হয়ে গেলো ৭ই জানুয়ারি।   দ্বাদশ জাতীয়  সংসদ নির্বাচনে ভোট দিইনি। যেই লোকটার পোস্টার দেখেছি এলাকা জুড়ে তিনি আসলে কোন এলাকার, কী পরিচয়  তা-ই বলতে পারেনি কেউ।   অথচ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই এলাকায় সম্ভবত তিন জন দাঁড়িয়েছিলেন। কয়েক বার বাসায় এসে তাদের দলীয় কর্মীরা ভোট চেয়ে গেছেন। ১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে শুনি ভোট নেয়া শেষ! মানে কী?  আমি তো অবাক! বাজে মাত্র বেলা একটা। একদল এসে বললো, আপা ভোট শেষ। আরেক দল বলে ভাবী বাসায় চলে যান।  

এই এলাকায় বড় হয়েছি এলাকার মেয়ে হিসেবে ভাইয়ের বন্ধুরা ডাকে, আপা। আর বরের বন্ধুরা ডাকে ভাবি। কিন্তু যে যা-ই বলুক আমি ভোট দিতে গেছি, ভোট দিয়েই ফিরব। শ্যামল, বর তখন বেচারা বনে গেছে। কিছুতেই যখন আমি বাসায় ফিরব না গোঁ ধরে আছি তখন কেন্দ্রে এসেছিলেন এলাকার কমিশনার। শ্যামল যেন হালে পানি পেলো। তাড়াতাড়ি কমিশনার মামাকে গিয়ে ধরলো। মামা, আমার বউ তো আপনাদের দলে ভোট দিতে আসছিলো। এখন সে ভোট না দিয়ে যাবে না বাসায়। কমিশনার মামা আর তাদের সাথের লোকজন একটু তাকায়া থাকলো আমার দিকে। একটু বিরক্ত হইলো কিনা জানি না। একটু হাসলো। তারপর কয়েকটা ভলান্টিয়ার ডেকে বললো ভোটের ব্যবস্থা করে দিতে। ভলান্টিয়ার বলে কেন্দ্রে ব্যালট প্যাপার নাকি নাই। তারপর পাওয়ার হাউজে গেলো। আমিও শ্যামলকে সাথে নিয়ে তাদের সাথে গেলাম। কেন্দ্রে ফিরলাম। ভোট দিলাম। বাসায় আসলাম। সেই আমি ২৪ সালে ভোট দিতে যাইনি।  
কেন্দ্র থেকে শ্যামলের ফোন থেকে আমাকে ফোন দিয়ে ডেকেছিল, ভাবি আসেন ভোট দিয়া যান।   

ভোট তো গেলো সুন্দর মতো। দেশে শান্তি কী আসবে? নমুনা দেখি না। সকালে ঘুম ভাঙতে না ভাঙতে গ্যাস চলে যায়। শশুর আব্বা ৭৪ সালে এই বাড়ি করেছেন। ২৩ সালের আগে কোনো দিন গ্যাসের সমস্যা হয় নাই। এদিকে বাজারে পাঠাইলে যা আনতে বলি তার অর্ধেক আনে অর্ধেক বাদ দেয়। মাছ কিনলে সবজি কিনতে পারে না। উনি আবার চাষের মাছ খান না। মাছের কানকো নড়তে হবে তা পাঁচ কেজি ওজনের রুই হোক কিংবা এক আঙুলের পুঁটি মাছ হোক। মনকে মন টমেটো আসতো আগে বাসায়। দুইশো কেজি টমেটোর পিউরি করছি নিজের হাতে। কয়েক বছরের ব্যবধানে  তা গল্পের মতো শোনায়। এখন কেনে চার কেজি, পাঁচ কেজি। রাতের খাবারে বাসায় ভাত খাবার চল রাখেনি কর্তা। পিজ্জা, বারগার, পাস্তা, চিজ ব্রেড, চিকেন, প্রন ফ্রাই, স্পেশাল থাই স্যুপ। খাওয়ার অভ্যাস করেছেন বাচ্চাদের। দুনিয়ার ঝামেলা করে  নিজের হাতেই বানাতাম সব। এখন বানাই আলু পুরি, বেগুনি, সয়া কাবাব, সবজি পাকোড়া, ঘুগনি, টমেটো স্যুপ বা কর্নস্যুপ। পরিবর্তনটা খুব দ্রুতই ঘনীভূত হচ্ছে।   

ক্ষুদ্র যাপিত জীবনে পরিবর্তনকে আমি ভয় পাই না। সময়ের সাথে সাথে সকলই পরিবর্তন হয়। চেষ্টা করি সন্তানদেরও বোঝাতে, শেখাতে জীবন যখন তোমাদের যেমন রাখবে সেভাবেই নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখতে হবে।

( চলবে)

লেখক : কবি ও গদ্যকার।

news24bd.tv/ডিডি