ক্লাব ফুট বা শিশুর জন্মগত বাঁকা পা

সংগৃহীত ছবি

ক্লাব ফুট বা শিশুর জন্মগত বাঁকা পা

অধ্যাপক ডা. এম আমজাদ হোসেন

জন্মগত বাঁকা পা নিয়ে অনেক শিশু জন্মায়। অজ্ঞানতার কারণে অনেকে একে চিকিৎসার অযোগ্য ও ভাগ্যের পরিহাস বলে মনে করে। অথচ শিশুদের জন্মগত বাঁকা পা বা ক্লাব ফুট এখন আর কোনো সমস্যা নয়। জন্মগত এই বিকলাঙ্গতার ভালো এমনকি বিনা মূল্যের চিকিৎসাও রয়েছে দেশে।

জন্মগত বিকলাঙ্গতা নিয়ে অনেক শিশু ভুমিষ্ঠ হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে কমন হলো বাঁকা পা, যাকে বলে ‘ক্লাব ফুট’। ফলে পায়ের একটি বা দুটি পাতা গোড়ালির অস্থিসন্ধির হাড়ের অবস্থাগত তারতম্যের জন্য ভেতরের দিকে ভাঁজ হয়ে থাকে, যা গলফ খেলার স্টিক বা ক্লাবের মতো দেখায়। তাই এর নামকরণ হয়েছে ক্লাব ফুট।

রোগটি মুগুর পা বা জন্মগত পায়ের পাতা বাঁকা নামেও বিভিন্ন এলাকায় পরিচিত।

ইংরেজিতে এই রোগটিকে কনজেনিটাল টেলিপেস ইকুইনো ভেরাস (সিটিইভি) বলে। গ্লোবাল ক্লাব ফুট ইনিশিয়েটিভের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর পাঁচ হাজারের মতো শিশু ক্লাব ফুট (বাঁকা পা) নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের এ সমস্যা বেশি দেখা যায়। ৫০ ভাগ শিশুর উভয় পায়েই এ সমস্যা হতে পারে।

কারণ
জন্মগত বাঁকা পা নিয়ে শিশু ভুমিষ্ঠ হওয়ার নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। তবে কিছু বিষয়তে দায়ী করা হয়। যেমন—

গর্ভকালীন রোগ ও সংক্রমণ : গর্ভকালীন বিভিন্ন সংক্রমণ, বিশেষ করে রুবেলা বা জার্মান মিজলস, সাইটোমেগালো ভাইরাস, টক্সোপ্লাজমা ইত্যাদি জীবাণুর সংক্রমণ হলে অনাগত শিশুটি বাঁকা পা নিয়ে জন্ম নিতে পারে। শুধু তা-ই নয়, সাধারণ জলবসন্তও বাড়িয়ে দিতে পারে ঝুঁকি। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়ের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, থাইরয়েডের সমস্যা বা অন্য কোনো জটিল রোগ থাকলে ক্লাব ফুট শিশু হতে পারে।

বংশগত : মা-বাবা বা তাদের নিকটাত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কেউ বাঁকা পা নিয়ে জন্মালে অথবা খুব নিকটাত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিয়ে হলে ওই শিশুটির ক্লাব ফুট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

অন্যান্য জন্মগত ত্রুটি : শিশুটি অন্যান্য জন্মগত ত্রুটি থাকলে যেমন সে ডাউন সিনড্রোম শিশু হলে ক্লাব ফুট হতে পারে।

গর্ভকালীন জটিলতা : গর্ভকালীন অ্যামনোয়েটিক ফ্লুইড বা পানি কম থাকলে এ সমস্যা হতে পারে।
পুষ্টিহীনতা : মায়ের অপুষ্টি, বিশেষ করে ফলিক এসিড বা আয়োডিনের অভাব হলেও হতে পারে।

নেশার প্রভাব : মা-বাবা ধূমপায়ী হলে, অ্যালকোহল ও নেশাদ্রব্য সেবনকারী হলে অনাগত শিশুটি ক্লাব ফুট নিয়ে জন্মাতে পারে।

ক্ষতিকর রাসায়নিক : পরিবেশগত কিছু কারণেও এ সমস্যা হতে পারে। বিশেষভাবে ক্ষতিকর রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসা, তেজস্ক্রিয়তাও ক্লাব ফুটের জন্য দায়ী।

লক্ষণ ও জটিলতা
ক্লাব ফুট শিশুদের পায়ের পাতা ও হিলও সামনের দিক থেকে ভেতরের দিকে বেঁকে যায়। চারটি লক্ষণ দ্বারা ক্লাব ফুট বোঝা যায়, যাকে সংক্ষেপে CAVE বলে। C = cavus, A = Adductus, V = Varus, E = Equinus.
পায়ের ব্যথার কারণে ক্লাব ফুট শিশুরা বেশিক্ষণ হাঁটতে পারে না। চিকিৎসা না করালে তারা বিকলাঙ্গতা নিয়ে বেড়ে ওঠে এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবে চাকরি কিংবা জীবিকা উপার্জনের সম্মানজনক কোনো পেশায় যেতে পারে না।

পরীক্ষা
গর্ভাবস্থার ২২ থেকে ২৪ সপ্তাহের মধ্যে আলট্রাসনোগ্রাম, এনোমলি স্ক্যানের মাধ্যমে ক্লাব ফুট শনাক্ত করা যায়।

চিকিৎসা
আগে জন্মগত বাঁকা পায়ের তেমন কোনো চিকিৎসা ছিল না, মানুষও তেমন গুরুত্ব দিত না। তবে এখন এই সমস্যার উন্নত চিকিৎসা রয়েছে। এই চিকিৎসা শুরু করা উচিত জন্মের এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যেই। মনে রাখতে হবে, যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু হবে সফলতার হার তত বেশি হবে।
কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি হলো—

পনসেটি মেথড
জন্মের দুই সপ্তাহের মধ্যে প্লাস্টার করে পা সোজা করা যায়, যাকে বলে ‘পনসেটি মেথড’। এই পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়, যা ক্লাব পায়ের আন্তর্জাতিক মানের বা স্ট্যান্ডার্ড চিকিৎসা। এটি এমন এক কৌশল, যা শল্যচিকিৎসা ছাড়াই জন্মগত ক্লাব পা ঠিক করে। আমেরিকান অর্থোপেডিক সার্জন ‘ডা. ইগনেসিও ভি পনসেটি’ বহু গবেষণার মাধ্যমে এ পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেন বলে ‘পনসেটি মেথড’ বলা হয়।

পনসেটি পদ্ধতিতে লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে তিন সপ্তাহের জন্য পায়ে পাঁচ-সাতটি প্লাস্টার করে দেওয়া হয়। প্রতি সপ্তাহে প্লাস্টার পরিবর্তন ও ফলোআপ করা হয়। পা ভালো হয়ে যাওয়ার পর সেই ভালো অবস্থান ধরে রাখার জন্য প্রথম তিন মাস ২৩ ঘণ্টা এবং পরবর্তী সময়ে শুধু রাতে ১২ ঘণ্টা করে পা ঢেকে রাখার জন্য Foot Abduction Brace (FAB) বা বিশেষ জুতা পরিধান করতে হয়। তবে নিয়ম মেনে চললে চার বছরের পর আর সেই বিশেষ জুতা পরতে হয় না। নিয়ম না মানলে বা সেই বিশেষ জুতা না পরলে পা আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসার আশঙ্কা থাকে। এটা দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা বিধায় অভিভাবকের উচিত ধৈর্য ধরে চালিয়ে নেওয়া।

টেপ ও স্প্লিন্ট লাগানো
এই পদ্ধতিতে চিকিৎসকরা শিশুর পা স্বাভাবিক পজিশনের কাছাকাছি এনে বিশেষ টেপ ও স্প্লিন্টের মাধ্যমে বেঁধে রাখেন। একে ফ্রেঞ্চ মেথডও বলে, যা শিশুর জন্মের পরপরই শুরু করা হয়। দুই মাস বয়স পর্যন্ত প্রতিদিন এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং মাঝে দুই-তিন দিন বিরতি দিয়ে ছয় মাস পর্যন্ত এই চিকিৎসা চালু রাখতে হয়। এরপর শিশুকে নিয়মিত স্ট্রেচিং অনুশীলন ও রাতে স্প্লিন্ট পরিয়ে রাখার মাধ্যমে পা সঠিক পজিশনে রাখা হয়, যত দিন পর্যন্ত না শিশুটি হাঁটতে শেখে।

শল্যচিকিৎসা
পনসেটি পদ্ধতি ও টেনে সোজা করার চিকিৎসায় ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে পা ভালো হয়ে যায়, সার্জারির দরকার হয় না। কোনো কারণে ভালো না হলে বা সঠিক নিয়ম না মানলে রোগী আগের অবস্থায় ফিরে যায়। সে ক্ষেত্রে শিশুর বয়স তিন বছর হওয়ার পর টেন্ডন ট্রান্সফার করার প্রয়োজন হয়, যাকে বলে Anterior Tibialis Tendon Transfer সার্জারি। অর্থোপেডিক সার্জনরা এই অপারেশন করে থাকেন।

প্রতিরোধে করণীয়
► শিশুটি গর্ভস্থ থাকার সময় অভিজ্ঞ গাইনোকোলজিস্টের ফলোআপে থাকুন এবং ব্যবস্থাপত্র সঠিকভাবে মেনে চলুন। গর্ভের ২০ থেকে ২৪ সপ্তাহে একটি অ্যানোমেলি স্ক্যান করে চিকিৎসককে দেখিয়ে নিন।
► বাবা, মায়ের ধূমপান বা মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে তা পরিত্যাগ করুন।
► গর্ভকালে শিশুর জন্য ক্ষতিকর—এমন ওষুধ সেবন করবেন না। এ সময় যেকোনো রেডিয়েশন থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন।
► পরিবারে একান্তই ক্লাব ফুট শিশু বা বাঁকা পা নিয়ে শিশু জন্মগ্রহণ করলে ঘাবড়াবেন না বা নবজাতককে আড়াল করবেন না। কেননা এর জন্য কেউ দায়ী নয়। বরং জন্মের পরপরই কোনো অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞকে দেখালে তিনি চামড়ার অবস্থা দেখে পরামর্শ দেবেন কখন চিকিৎসা শুরু করতে হবে।

সফলতা
ক্লাব ফুট শিশুরা এখন আর বোঝা নয়। বরং সুচিকিৎসার পর ক্লাব ফুট শিশুরা স্কুলে যেতে পারে, খেলাধুলা করতে পারে, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে, বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে অর্থাৎ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। সুতরাং জন্মগত বাঁকা পা—এমন শিশু হলে দ্রুত চিকিৎসা নিন ও প্রতিরোধে এগিয়ে আসুন। আশার কথা যে ২০১০ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শিশুদের জন্মগত বাঁকা পায়ের জন্য প্রয়োজনীয় প্লাস্টার, জুতা বিনা মূল্যে প্রদানসহ চার বছর পর্যন্ত বিনা মূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে।

লেখক : অধ্যাপক ডা. এম আমজাদ হোসেন, চিফ কনসালট্যান্ট, অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগ, ল্যাবএইড হাসপাতাল।

news24bd.tv/health