বায়ুদূষণ এড়াতে দরকার ব্যাপক সতর্কতা

সংগৃহীত ছবি

বায়ুদূষণ এড়াতে দরকার ব্যাপক সতর্কতা

অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের রিপোর্ট অনুসারে বছরে প্রায় সাত মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয় বায়ুদূষণ সৃষ্ট ধোঁয়ার কারণে। চীনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ অনিরাপদ বায়ুদূষণের মধ্যে বাস করছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৭’ প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ুদূষণে বাংলাদেশে বছরে এক লাখ ২২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।  

দেশের বড় শহরগুলো, বিশেষত রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ রাজশাহী, খুলনা, বগুড়া প্রভৃতি শহরে বায়ুদূষণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।

গ্রামাঞ্চলে তুলনামূলকভাবে মিল-কারখানা ও যান্ত্রিক যানবাহন অনেক কম থাকায় গ্রামাঞ্চলে বায়ুদূষণ এখনো সে রকম সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়নি। তবে নানা অসুখের জন্য ঋতু পরিবর্তন ও পরিবেশকেই দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।  

কারণ
বিষাক্ত ও ক্ষতিকর পদার্থ বাতাসের সঙ্গে মিশে গিয়ে বায়ুদূষণ ঘটায়। বিষয়টি মানবসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক—এই দুই প্রকারেরই হতে পারে।

বায়ুদূষণের উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো:

► বিভিন্ন যানবাহন ও কলকারখানা থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া।
► যানবাহন, শিল্প-কারখানা ও বর্জ্য পোড়ানোর ফলে উৎপন্ন বিষাক্ত কালো ধোঁয়া।
► উন্নয়ন, মেরামত ও সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় অপরিকল্পিতভাবে রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ি।
► রাস্তার পাশে মাটি, বালু, ইটসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী ও আবর্জনার স্তূপ।
► মেশিনে ইট, পাথর ভাঙা, কর্ষিত জমির ধুলাবালি।
► অবৈজ্ঞানিক চুলা (বিশেষত মাটির তৈরি চুলা খড়ি দিয়ে যাতে রান্না হয়)।
►ইটভাটা, নিম্নমানের কয়লা পোড়ানো।
► সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে লবণের কণা।
► জীবকুল এবং পশু-পাখির বর্জ্য ও পালক মিশ্রিত ক্ষুদ্র কণা।
► ট্যানারি থেকে হাইড্রোজেন সালফাযেড, অ্যামোনিয়া, ক্লোরিনসহ নানাবিধ রাসায়নিক নিঃসরণ।
► ট্রাফিক জ্যাম।
► দ্রুত নগরায়ণ।
► কঠিন শিল্প উত্তোলনের খনি ও অন্যান্য খনি এলাকার ক্ষুদ্র ধুলি কণা ইত্যাদি।

প্রতিক্রিয়া বা ঝুঁকি
► বায়ুদূষণের ফলে প্রতিনিয়ত নানাবিধ সমস্যার শিকার হচ্ছে মানুষ। এসব দূষণের ফলে সর্দি, কাশি, মাথাব্যথা থেকে শুরু করে ফুসফুসের ক্যান্সার পর্যন্ত হচ্ছে।
► বায়ুর ক্ষতিকারক কণিকাগুলোর গ্রহণকারী সর্বোচ্চ মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৪০০ মাইক্রোগ্রাম। সেখানে ঢাকা শহরের কোনো কোনো স্থানে (হাটখোলা, মানিক মিয়া এভিনিউ, মতিঝিল, মহাখালী) এই দূষণ কণার পরিমাণ ৩০০০ মাইক্রোগ্রামের বেশি। বায়ুমণ্ডলে সালফার ডাই-অক্সাইড (SO2)-এর গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা ১০০ মাইক্রোগ্রাম, যেখানে ফার্মগেট অঞ্চলে প্রতি ঘনমিটারে এর পরিমাণ ৩৮৫ মাইক্রোগ্রাম। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের মতে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে নগরবাসী যে পরিমাণ সিসা গ্রহণ করছে তা সহনীয় মাত্রার চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বেশি। ঢাকা শহরে প্রতি ঘনমিটারে সিসার পরিমাণ ৪৬৩ ন্যানোগ্রাম, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ।  
► বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। অতিরিক্ত সিসা শিশুর মানসিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। ঢাকা শিশু হাসপাতালে শিশুদের রক্ত পরীক্ষায় 80mg/dl থেকে 180mg/dl সিসা পাওয়া গেছে, যা গ্রহণযোগ্য মাত্রার সাত থেকে ১৬ গুণ বেশি। ক্রমবর্ধমান সিসাদূষণ মানবদেহের কেন্দ্রীয় দের রক্তে প্রায় 200mg/dl সিসার উপস্থিতি বিদ্যমান, যা সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক গুণ বেশি। স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করা ছাড়াও কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্ট করে। সিসাদূষণের কারণে শিশুরা বড়দের তুলনায় তিন গুণ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঢাকা শহরে পরিবহন খাতে কর্মরত ব্যক্তি।
► ধূলিকণা থেকে সৃষ্ট বায়ুদূষণে হাঁপানিসহ শ্বাসযন্ত্রের অন্যান্য রোগ সৃষ্টি হয়। ঢাকা শহরের কিছু স্থানে নমুনা বিশ্লেষণে ২০০ প্রকার জৈব যৌগ শনাক্ত করা গেছে।  
► ভূ-পৃষ্ঠে এবং খনির অভ্যন্তরে জ্বালানি ও লুব্রিকেন্টের দহনের ফলে সৃষ্ট গ্যাস বিশেষত মিথেন গ্যাস বিস্ফোরণের আশঙ্কা রয়েছে, যা পরিবেশের ওপর অত্যন্ত বিরূপ প্রভাব ফেলে।

বায়ুদূষণ রোধে করণীয়
► নতুন রাস্তাঘাট, ব্রিজ, ড্রেন নির্মাণ ও মেরামতকালে নিয়মিত পানি স্প্রে করতে হবে।
► সম্পূর্ণরূপে আচ্ছাদিত অবস্থায় সব ধরনের নির্মাণকাজ করতে হবে।
► বর্জ্য ও ক্ষতিকর পদার্থ সব সময় ঢেকে পরিবহন করতে হবে।
► ক্লোরোফ্লারো কার্বন (সিএফসি) যন্ত্রপাতি ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
► পলিথিন ব্যবহার ও পোড়ানো বন্ধ করতে হবে।
► পরিবেশবান্ধব শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে হবে।
► ইটভাটাসংক্রান্ত আইন সম্পূর্ণরূপে অনুসরণ করতে হবে।
► ফিটনেসবিহীন ক্ষতিকর ধোঁয়া নির্গমনকারী যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে।
► বেশি করে গাছ লাগাতে হবে।
► শিল্পকারখানা, খাদ্যশষ্য প্রক্রিয়াকরণ, রাসায়নিক পণ্য উৎপাদন এলাকায় কর্মরত শ্রমিক ও অন্যান্যদের মাস্কসহ ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) ব্যবহার করতে হবে ইত্যাদি।

রোগীদের জন্য পরামর্শ
► ঋতু পরিবর্তনের এই সময়ে বাতাসের আর্দ্রতা কমে বাতাস শুষ্ক হয়, বাতাসে ধূলিকণার মাত্রা বেড়ে যায়, নানা জীবাণু ভেসে বেড়ায়। এই সময় হাঁচি, কাশিসহ শ্বাসযন্ত্রের নানা রোগ তথা অ্যাজমা, সিওপিডির মাত্রাও বেড়ে যায় বলে একটু সতর্কতার সঙ্গে চলতে হয়। শিশু ও শ্বাসকষ্টের রোগীদের বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হতে দেওয়া উচিত নয়। এই সময়টাতে মাস্ক ব্যবহার করা উচিত।
► অ্যাজমা ও সিওপিডির রোগীরা ছাড়াও যে কেউ সিজনাল বিভিন্ন ভ্যাকসিন যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা ও নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন নিতে পারেন। ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন দুই বছর বয়স থেকে নেওয়া যায়। আর নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন রয়েছে দুই ধরনের। প্রতি পাঁচ বছর পর পর এই ভ্যাকসিন নেওয়া যায়। আর একটা ভ্যাকসিন রয়েছে, যা জীবনে একবার নিলেও চলে।
► অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্টের রোগীরা বেশি করে খাবার পানি পান করবেন। কেননা বেশি করে পানি দেহে প্রবেশ করলে পানিশূন্যতা রোধের পাশাপাশি তা শ্বাসযন্ত্রের জন্যও ভালো। আর একটি বিষয় হলো, কফ, সর্দি আটকিয়ে বেশিক্ষণ জমিয়ে না রাখা।
► সাধারণ চিকিৎসায় সর্দি, কাশি ভালো হয়। কিন্তু এর সঙ্গে জ্বর, বুক ব্যথা ইত্যাদি সমস্যা অনুভব করলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে বা হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
► ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কর্মরত ও সেবারত সকলকে শ্বাসতন্ত্রের রোগের উপসর্গের দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

news24bd.tv/health