বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নিম্নগতি, বাড়ছে ঋণ পরিশোধের চাপ

সংগৃহীত ছবি

বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নিম্নগতি, বাড়ছে ঋণ পরিশোধের চাপ

দেলোয়ার হোসেন লিটু

বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির গতি কমলেও দিন দিন বাড়ছে ঋণের পরিমাণ। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি ও ঋণের অর্থছাড় বেড়েছে। একইসঙ্গে বেড়েছে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নিম্নগতি হলেও ঋণের চাপে কোন কমতি দেখা যায়নি।

উল্টো রেকর্ড গড়েছে বৈশ্বিক ঋণ।

ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সের (আইআইএফ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক ঋণের পরিমাণ গত বছর রেকর্ড ৩১৩ ট্রিলিয়ন বা ৩১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারে উঠেছে। অর্থাৎ বৈশ্বিক ঋণ এর আগে কখনো এই উচ্চতায় ওঠেনি।

গতকাল (২৫ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত ইআরডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে উন্নয়ন সহায়তা প্রতিশ্রুতি বেড়েছে ৩০৬.১ শতাংশ, ঋণের অর্থছাড় বেড়েছে ৩.২৬ শতাংশ।

একইসঙ্গে সরকারের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে ৪৪.৫২ শতাংশ।

অর্থবছরের প্রথম সাত উন্নয়ন সহযোগীরা প্রতিমাসে নতুন ৭.১৭ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের প্রতিশ্রুত ১.৭৬ বিলিয়ন ডলার থেকে অনেকটাই বেশি।

আইআইএফের আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর বৈশ্বিক ঋণের ভান্ডারে অন্তত ১৫ ট্রিলিয়ন বা ১৫ লাখ কোটি ডলারের বেশি অর্থ যোগ হয়েছে। ফলে মোট বৈশ্বিক ঋণ ৩১৩ ট্রিলিয়ন ডলারের নতুন রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে। তবে জিডিপির অনুপাতে বিভিন্ন দেশের সরকারের ঋণ টানা তৃতীয় বছরে কমেছে। শক্তিশালী বাজার অর্থনীতির কারণে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বৈশ্বিক ঋণ ২০২২ সালে প্রায় ৭ ট্রিলিয়ন বা ৭ লাখ কোটি ডলার কমেছিল। পরিসংখ্যান অনুসারে, বৈশ্বিক ঋণ ২০২৩ সালে ১৫ ট্রিলিয়ন বা ১৫ লাখ ডলারের বেশি বেড়েছে। আইআইএফ জানিয়েছে, এক দশক আগে মোট বৈশ্বিক ঋণ ছিল ২১০ ট্রিলিয়ন ডলার।

আরও পড়ুন: মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ: বিশ্বব্যাংক

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি আগারগাঁয়ে পরিকল্পনা কমিশনে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠক শেষে বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আ্যানা ব্যাজার্ড মূল্যস্ফীতিকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের আর্থিক খাতে চলমান সংস্থারের প্রশংসা করে তা অব্যাহত রাখার তাগিদ দেন বিশ্বব্যাংক এমডি। এসময় তিনি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতারও আশ্বাস দেন।

এর পর এক বিবৃতিতে আনা বিয়ার্ড বলেন, মুদ্রা ও রাজস্ব নীতিতে দ্রুত এবং সাহসী সংস্কার বাংলাদেশকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে, আর্থিক খাতের ঝুঁকি কমাতে এবং বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে সক্ষম করবে। বাংলাদেশকে ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ় সমর্থনের কথাও এসময় পুনর্ব্যক্ত করেন বিশ্বব্যাংকের এমডি।

ইআরডির তথ্য অনুসারে, দেশে বেশিরভাগ ঋণের প্রতিশ্রুতি এসেছে প্রধান তিন উন্নয়ন সহযোগী এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), বিশ্বব্যাংক ও জাপান থেকে। তিন উন্নয়ন সহযোগী সম্মিলিতভাবে ৬.০৫ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে মোট ২.৬২ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি এসেছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) থেকে। পাশাপাশি এই সময়ে জাপান থেকে ২.০২ বিলিয়ন এবং বিশ্বব্যাংক থেকে ১.৪১ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে।

চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়কালে উন্নয়ন সহায়তা সংস্থাগুলো মোট ৪.৩৯ বিলিয়ন ডলার অর্থছাড় করেছে, আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ৪.২৫ বিলিয়ন ডলার ছিল। এদিকে বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বাজারভিত্তিক ঋণের সুদহার বেড়েছে, যা বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়িয়েছে।

ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, সরকার অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি মেয়াদে উন্নয়ন অংশীদারদের সুদ ও আসল পরিশোধে ১.৮৫ বিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়কালে ১.২৮ বিলিয়ন ডলার ছিল। অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে শুধু সুদের অর্থ পরিশোধ বেড়েছে ১০৭.৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সুদ পরিশোধের জন্য ৭৬০.৭৪ মিলিয়ন ডলার ছাড় করা হয়েছে। এই সময়ে সরকার বিভিন্ন ঋণের আসলের ১.০৯ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে।

আরও পড়ুন: দেশে ডলারের কোনো সংকট নেই: সালমান এফ রহমান 

ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান আন্তর্জাতিক সুদের হার অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশ ১.১৯ বিলিয়ন ডলার সুদ পরিশোধ করবে বলে প্রক্ষেপণ হয়েছে। গত অর্থবছরে (২০২২-২৩), বাংলাদেশের সুদ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৯৪৪ মিলিয়ন ডলার, এর আগের অর্থবছরে যা ছিল ৪৬৯ মিলিয়ন ডলার।

ইআরডি কর্মকর্তারা বলেন, সুদ পরিশোধের পাশাপাশি আসল পরিশোধের চাপও বাড়বে। বিভিন্ন বাজার সহায়তা ঋণ এবং কর্ণফুলী টানেল ও পদ্মা রেল লিঙ্কের মতো মেগা প্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ার পর এখন এসব ঋণের আসলের অর্থ পরিশোধ করতে হবে।

মোট ঋণের অন্তত ৫৫ শতাংশ তৈরি হয়েছে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে। এর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জার্মানি। অন্যদিকে চীন, ভারত ও ব্রাজিলের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও ঋণ বৃদ্ধির ধারা দেখা গেছে।

উন্নত দেশগুলোর মোট ঋণ গত বছর ২০৮ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন বা ২০ হাজার ৮৩০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মোট ঋণ ১০৪ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন বা ১০ হাজার ৪৬০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে।

২০২৩ সালে বৈশ্বিক পারিবারিক ঋণের পরিমাণ ৫৯ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন বা ৫ হাজার ৯৩০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে বিভিন্ন দেশের সরকারি ঋণ—গত বছর যা ৮৯ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন বা ৮ হাজার ৯৯০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে।

এক প্রতিবেদনে উঠে আসে, করোনা মহামারির সময় বিশ্বব্যাপী পণ্য সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটে। ফলে বিভিন্ন দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যায়। মহামারির প্রভাব কাটতে না কাটতে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধ এখনও চলছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এই যুদ্ধের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হবে। মহামারির সময় থেকে দেশে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে উদার হস্তে ঋণ ও প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এ কারণে ২০২০ সালের পর থেকে বৈশ্বিক ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।

news24bd.tv/DHL