কোরআনের বর্ণনায় মহানবী (সা.)-এর সাহাবিদের বিশেষ মর্যাদা

কোরআনের বর্ণনায় মহানবী (সা.)-এর সাহাবিদের বিশেষ মর্যাদা

কাসেম শরীফ

সাহাবায়ে কেরাম মহানবী (সা.)-এর একনিষ্ঠ অনুসারী ও সহচর ছিলেন। তাঁরা ইসলামের বিধি-বিধান যথাযথভাবে বুঝেছেন এবং তা নিজেদের সার্বিক জীবনে বাস্তবায়ন করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম এই উম্মতের শ্রেষ্ঠতম মুসলমান। তাঁরা নিষ্পাপ নন, তবে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ ক্ষমাপ্রাপ্ত।

সাহাবায়ে কেরামের বিষয়ে কোরআনের মূল্যায়ন এখানে তুলে ধরা হলো—

১. জান্নাতের প্রতিশ্রুতি : সাহাবাদের প্রতি মহান আল্লাহ গণসন্তুষ্টির ঘোষণা দিয়েছেন। এবং তাঁদের জন্য জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যেসব মুহাজির ও আনসার (ঈমান আনয়নে) প্রথম অগ্রগামী এবং যেসব লোক একান্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের অনুগামী, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর আল্লাহ তাদের জন্য এমন জান্নাত প্রস্তুত করে রেখেছেন, যার তলদেশ দিয়ে বহু নদী বইতে থাকবে, যার মধ্যে তারা চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করবে।


আর এটা মহাসাফল্য। ’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১০০)

২. সাধারণ মুসলমানের জন্য ঈমানের মানদণ্ড : কোনো মুমিনের ঈমান তখনই গ্রহণযোগ্য হবে, যখন তা সাহাবায়ে কিরামের ঈমানের মতো হবে। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আর যখন তাদের (মুনাফিকদের) বলা হয়, ঈমান আনো যেমন লোকেরা (সাহাবায়ে কিরাম) ঈমান এনেছে, তারা বলে, আমরা কি ঈমান আনব যেমন নির্বোধরা ঈমান এনেছে? জেনে রেখো, নিশ্চয়ই তারাই নির্বোধ; কিন্তু তারা জানে না। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৩)

৩. ঘরবাড়ি ছেড়ে সব কষ্ট সয়ে নবীকে সাহায্য : সাহাবায়ে কেরাম রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে দ্বিন প্রতিষ্ঠা করার জন্য ঘরবাড়ি ছেড়ে সব কষ্ট-ক্লেশ ধৈর্যের সঙ্গে মাথা পেতে মেনে নিয়েছেন, তাঁদের প্রতি আল্লাহ নিজেই খুশি হয়েছেন, তাঁরাও আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘এই সম্পদ অভাবগ্রস্ত মুহাজিরদের জন্য, যারা নিজেদের ঘরবাড়ি ও সম্পত্তি থেকে উত্খাত হয়েছে। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে সাহায্য করে। তারাই তো সত্যবাদী। ’ (সুরা : হাশর, আয়াত : ৮)

৪. আল্লাহর বিশেষ ক্ষমা : সাহাবায়ে কেরামের জন্য আল্লাহর ক্ষমার ঘোষণা আছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ অনুগ্রহপরায়ণ হয়েছেন (তাওবা কবুল করেছেন) নবীর প্রতি এবং মুহাজির ও আনসারদের প্রতি, যারা সংকটকালে তাকে অনুসরণ করেছিল।

এমনকি তাদের মধ্যে কিছু লোকের অন্তর বেঁকে যাওয়ার উপক্রম হওয়ার পরও আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তিনি তাদের প্রতি বড়ই স্নেহশীল, বড়ই দয়ালু। ’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১১৭)
৫. আগের আসমানি কিতাবে সাহাবাদের প্রসঙ্গ : কোরআনে সাহাবায়ে কেরামের উপমা হলো, তাঁরা ইসলামের চারাগাছতুল্য। আর সাহাবাবিদ্বেষ কুফরির আলামত। ইরশাদ হয়েছে, ‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল এবং তার সঙ্গে যারা আছে তারা কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর; পরস্পরের প্রতি সদয়। তুমি তাদের রুকুকারী, সিজদাকারী অবস্থায় দেখতে পাবে। তারা আল্লাহর করুণা ও সন্তুষ্টি অনুসন্ধান করছে। তাদের আলামত হচ্ছে, তাদের চেহারায় সিজদার চি‎হ্ন থাকে। এটাই তাওরাতে তাদের দৃষ্টান্ত। আর ইনজিলে তাদের দৃষ্টান্ত হলো একটি চারাগাছের মতো, যে তার কচি পাতা উদগত করেছে ও শক্ত করেছে, অতঃপর তা পুষ্ট হয়েছে ও স্বীয় কাণ্ডের ওপর মজবুতভাবে দাঁড়িয়েছে, যা চাষিকে আনন্দ দেয়। যাতে তিনি তাদের দ্বারা কাফিরদের ক্রোধান্বিত করতে পারেন। তাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের জন্য ক্ষমা ও মহা প্রতিদানের ওয়াদা করেছেন। ’ (সুরা : ফাতহ, আয়াত : ২৯)

৬. সাহাবা-বিরোধিতা জাহান্নামের পথ : আল্লাহ, তাঁর রাসুল (সা.) এবং সাহাবায়ে কিরামের পথ ভিন্ন অন্য যেকোনো পথ জাহান্নামের পথ। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি সত্য পথ প্রকাশিত হওয়ার পরও রাসুলের বিরোধিতা করে এবং মুমিনদের (সাহাবাদের) পথ বাদ দিয়ে ভিন্ন পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে সে পথেই ফিরাব যে পথে সে ফিরে যায়, আর তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করব, কত মন্দ না সে আবাস!’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১১৫)

৭. সাহাবাদের হেফাজতের দায়িত্ব নিয়েছেন মহান আল্লাহ : রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং সাহাবায়ে কিরামের হেফাজতের বিশেষ দায়িত্ব মহান আল্লাহ নিজেই নিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে নবী! আল্লাহই তোমার আর তোমার অনুসারী ঈমানদারদের (সাহাবাদের) জন্য যথেষ্ট। ’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ৬৪)

৮. সাহাবাদের ঈমান প্রশ্নাতীত : সাহাবায়ে কিরাম প্রকৃত মুমিন। তাঁদের ঈমান প্রশ্নাতীত। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে এবং যারা আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে, তারাই প্রকৃত মুমিন, তাদের জন্য আছে ক্ষমা ও সম্মানজনক রিজিক। ’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ৭৪)

৯. দুনিয়া ও আখিরাতে সফল : সাহাবায়ে কিরাম দুনিয়া ও আখিরাতে সফল। ইরশাদ হয়েছে, ‘...কিন্তু রাসুল ও তার সঙ্গে মুমিনরা তাদের জীবন ও সম্পদ দিয়ে জিহাদ করে, আর সেসব মানুষের জন্য যাবতীয় কল্যাণ। আর তারাই সফল। ’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৮৮)

১০. আল্লাহর সন্তুষ্টির ঘোষণা : সাহাবাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট। ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিনদের (সাহাবাদের) প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হলেন যখন তারা (হুদাইবিয়ায়) গাছের তলে তোমার কাছে বায়াত নিল। আল্লাহ জানতেন তাদের অন্তরে কী আছে, এ জন্য তিনি তাদের ওপর প্রশান্তি অবতীর্ণ করলেন আর পুরস্কার হিসেবে তাদের দিলেন আসন্ন বিজয়। ’ (সুরা : আল-ফাতহ, আয়াত : ১৮)

১১. কিয়ামতের ময়দায়ে আলোকিত : সাহাবায়ে কিরাম কিয়ামতের দিন লজ্জিত হবেন না। ইরশাদ হয়েছে, ‘...সেদিন আল্লাহ নবীকে আর তার সঙ্গে যারা ঈমান এনেছিল (সাহাবায়ে কিরাম), তাদের লজ্জিত করবেন না। (সেদিনের ভয়াবহ অন্ধকার থেকে মুমিনদের রক্ষার ব্যবস্থা হিসেবে) তাদের নূর দৌড়াতে থাকবে তাদের সামনে আর তাদের ডান পাশে। তারা বলবে, হে আমাদের রব! আমাদের নূর আমাদের জন্য পরিপূর্ণ করে দাও আর আমাদের ক্ষমা করো; তুমি সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান। ’ (সুরা : তাহরিম, আয়াত : ৮)

১২. পাপাচার ও কুফরি অপছন্দনীয় : সাহাবাদের অন্তরে কুফরি, পাপাচার ও অবাধ্যতা অপছন্দনীয় করে দেওয়া হয়েছে। কোরআনে এসেছে, ‘...কিন্তু আল্লাহ তোমাদের কাছে ঈমানকে প্রিয় করে দিয়েছেন এবং তা তোমাদের অন্তরে সুশোভিত করেছেন। আর তোমাদের কাছে কুফরি, পাপাচার ও অবাধ্যতা অপছন্দনীয় করে দিয়েছেন। এরাই তো সত্য পথপ্রাপ্ত। ’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ৭)

১৩. প্রত্যেক সাহাবি মুুত্তাকি : সাহাবাদের অন্তরে তাকওয়ার বাণী অপরিহার্য করে দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন কাফিররা তাদের অন্তরে আত্ম-অহমিকা পোষণ করেছিল—জাহিলি যুগের অহমিকা। তখন আল্লাহ তাঁর রাসুলের ওপর ও মুমিনদের ওপর স্বীয় প্রশান্তি নাজিল করলেন এবং তাকওয়ার বাণী তাদের জন্য অপরিহার্য করলেন, আর তারাই ছিল এর সর্বাধিক উপযুক্ত ও এর অধিকারী। আর আল্লাহ হলেন প্রত্যেক বিষয়ে সর্বজ্ঞ। ’ (সুরা : আল-ফাতহ, আয়াত : ২৬)

১৪. সাধারণ কোনো সাহাবিকেও অবজ্ঞা করা নিষিদ্ধ : যে কোনো গরিব সাহাবিও মহান আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদাবান। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা তাদের রবের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সকাল-সন্ধ্যায় তাঁকে ডাকে তাদের (গরিব সাহাবাদের) তুমি দূরে সরিয়ে দিয়ো না। তাদের কোনো আমলের জন্য তোমাকে কোনো জবাবদিহি করতে হবে না, আর তোমার কোনো আমলের জন্যও তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হবে না, কাজেই তুমি যদি তাদের (গরিব মুমিনদের) দূরে সরিয়ে দাও, তাহলে তুমি জালিমদের মধ্যে গণ্য হবে। ’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ৫২)

১৫. সাহাবাদের জন্য দোয়া করা পরবর্তীদের দায়িত্ব : সাহাবা-পরবর্তী সব মুমিনের করণীয় হলো, সাহাবাদের জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করা। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা তাদের পরে এসেছে, তারা বলে, হে আমাদের রব! আমাদের এবং ঈমানে অগ্রণী আমাদের ভাইদের ক্ষমা করুন এবং মুমিনদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের রব! আপনি তো দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু। ’ (সুরা : হাশর, আয়াত : ১০)

১৬. সাহাবাদের ব্যক্তিগত ত্রুটি-বিচ্যুতি প্রকাশ করা পাপ : সাহাবাদের ব্যক্তিগত জীবনে ঘটে যাওয়া যেকোনো অপছন্দনীয় বিষয় জনসমক্ষে প্রকাশ করা দুনিয়া ও আখিরাতে শাস্তির কারণ। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা পছন্দ করে যে মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার বিস্তৃতি ঘটুক তাদের জন্য আছে ভয়াবহ শাস্তি দুনিয়া ও আখিরাতে। আল্লাহ জানেন আর তোমরা জানো না। ’ (সুরা : নূর, আয়াত : ১৯)

উল্লিখিত আয়াত একটি ঘটনা কেন্দ্র করে নাজিল হয়েছে, যা আয়েশা (রা.) ও কয়েকজন সাহাবি সংশ্লিষ্ট।

১৭. সাহাবাদের সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু বানানো যাবে না : নবী যুগের পর সাহাবাদের কারো কারো কোনো কোনো ঘটনা, যা মানবরচিত ইতিহাস আশ্রিত, তা আলোচনা ও সমালোচনার বিষয়বস্তু বানানো উচিত হয়। সেসব ঘটনার বিষয়ে মুমিনের দৃষ্টিভঙ্গি এমন : ‘তারা এমন এক একটি দল (উম্মত), যারা বিগত হয়েছে। তারা যা অর্জন করেছে তা তাদের জন্যই, আর তোমরা যা অর্জন করেছ তা তোমাদের জন্যই। আর তারা যা করত সে সম্পর্কে তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে না। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৩৪)

news24bd.tv/আইএএম

এই রকম আরও টপিক