দিন দিন ডলারের ওপর আস্থা হারাচ্ছে মানুষ, ভরসা স্বর্ণে

স্বর্ণই কী ডলারের আধিপত্যের বিকল্প?

দিন দিন ডলারের ওপর আস্থা হারাচ্ছে মানুষ, ভরসা স্বর্ণে

বিশ্ব মুদ্রা ব্যবস্থায় ডলারের ওপর আস্থা হারাচ্ছে বিশ্ব। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর থেকে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে রুশ কূটনৈতিক সংকটের কারণে ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে চাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। এক্ষেত্রে ডলারের বিকল্প হিসেবে স্বর্ণ আবারও তার আগের জায়গায় ফিরে পেতে পারে বলে ধারণা করছে গোল্ড কাউন্সিল ও ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্টের মতো বিভিন্ন সংস্থা।

অনেক আগে থেকেই ডলারের এ একাধিপত্য ভাঙার চেষ্টা করে আসছিল বেশ কয়েকটি দেশ।

অনেকেই এগিয়ে গেছে বহুদূর, আছে ভালো অবস্থানে। অনেককেই আবার দিতে হয়েছে চরম মূল্য। তবে সম্প্রতি রাশিয়া-চীনের সৌহার্দ্য ও ডলারের বিপরীতে বিশ্বের অন্যান্য মুদ্রার অবনমনের পর দিনকে দিন ডলারের ওপর মানুষ আস্থা হারাচ্ছে।

সম্প্রতি ব্রিকসভিত্তিক নিউ ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডলারের বিপরীতে একক মুদ্রা চালু করা সহজ না হলেও, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও জোটভিত্তিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ডলারের দৌরাত্ম্য কমিয়ে আনা সম্ভব।

এরমধ্যেই ব্রিকসভিত্তিক দেশগুলো নিজেদের মধ্যে আন্তঃমুদ্রা সম্পর্কে ব্যবসা শুরু করেছে। শুধু ব্রিকস না ব্রিকসের বাইরের দেশগুলোও ব্রিকসভুক্ত দেশের সঙ্গে আঞ্চলিক মুদ্রায় ব্যবসা শুরু করেছে। বিশেষ করে আঞ্চলিক মুদ্রা হিসেবে ইউয়ান, রুপি, রুবল এবং রিয়ালের জনপ্রিয়তা আগের থেকে অনেক বেশি বেড়েছিল। যেহেতু একক মুদ্রার দৌরাত্ম্য থেকে বিশ্ব বের হয়ে যেতে চাচ্ছে, সেক্ষেত্রে মুদ্রা বাজারে ডলারের বদলে অন্য কোনো মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে মুদ্রামান নির্ণয় হবে বলে ধারণা অর্থনীতিবিদদের।
 
ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ডলারের পরিবর্তে রফতানিতে স্বর্ণভিত্তিক মুদ্রাব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিলেন। মার্কিনীদের ক্ষেপানোর কারণে ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রবাহিনী ইরাক আক্রমণ করে এবং সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করে। একই চেষ্টা করেছিলেন লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফি, যার ভাগ্য ঘটেছিল একই ঘটনা। ২০১৩ সালে তেল আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে যায় চীন। এরপর থেকেই কথা উঠেছে বিশ্ববাজারে পেট্রোডলারের ধারণা বদলে পেট্রোইউয়ানের ধারণা উন্মোচিত হবে কী না এ নিয়ে।
 
বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে, রাশিয়াকে সুইফট মুদ্রাব্যবস্থা থেকে বের করে দেয়া ও রুশ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার পদক্ষেপকে ভালোভাবে নেয়নি বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লিপানার কারণে দেশটির ওপর থেকে আস্থা হারাচ্ছেন বাকি অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশগুলো। ডলার যখন শুধু অর্থনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, সেখানে ডলার বিকল্পে খুঁজছে পশ্চিমা বিশ্বের বাইরের দেশগুলো।
 
সম্প্রতি রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বায়নের বাঁধ দিনকে দিন ভেঙে যাচ্ছে। রাশিয়া তেল-গ্যাসের ব্যবসা করছে রুবলের মাধ্যমে। চীন ইউয়ানকে শক্তিশালী করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি ভারত রুপিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রায় পরিণত করতে চায় বলে জানিয়েছে দেশটির রিজার্ভ ব্যাংক। এ অবস্থায় দিন যত যাচ্ছে 'জি-টু-জি' চুক্তিগুলো তত বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছে। দেশগুলো ডলার বাদ দিয়ে নিজেদের মুদ্রায় ব্যবসা করতে আগ্রহী হচ্ছে। সম্প্রতি ইরান-রাশিয়া এমনই একটি চুক্তি করেছে যেখানে ডলার নয়, ব্যবসা হবে রিয়াল-রুবলের মাধ্যমে।

যেভাবে বাজারে ডলারকে বাদ দিয়ে আঞ্চলিক মুদ্রার বিনিময় বাড়ছে, তাতে করে মুদ্রার মান নির্ণয়ে আবারও স্বর্ণের ব্যবহার প্রতিষ্ঠা পেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে র‍্যাংকিংভিত্তিক ওয়েবসাইট ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট। বিশেষ করে বিগত কয়েক বছরে যে হারে স্বর্ণের মজুত বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো, তাতে করে সহজেই বোঝা যায়, ডলার বাদ দিয়ে স্বর্ণকে এবার মুদ্রা মানের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করতে যাচ্ছেন তারা।
 
কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর স্বর্ণ কেনা প্রসঙ্গে বার্তাসংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডলারের দাম যে হারে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাতে করে অনেকেই এ মুদ্রাটির ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। এ ছাড়া ডলারকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে বারবার ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র পুরো মানদণ্ড ব্যবস্থার ওপরে এক ধরনের অসামঞ্জস্যতার জন্ম দিয়েছে। এতে করে স্বর্ণকে বিনিময়ের এবং মানদণ্ডের সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হিসেবে দেখছে দেশগুলো।
 
বিশ্ব গোল্ড কাউন্সিলের সবশেষ হিসাব থেকে দেখা যায়, ২০২৩ সালে যে হারে চীন এবং রাশিয়া স্বর্ণের মজুত বাড়িয়েছে তা থেকে স্পষ্ট দেশ দুটি আর কোনোভাবেই ডলারের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। মজুত বাড়িয়ে রাশিয়ার রিজার্ভের বর্তমানে ২ হাজার ৩৩৩ টন স্বর্ণ আছে। চীনের মজুতে স্বর্ণ আছে ২ হাজার ১৯২ টন। গত বছর চীন একাই স্বর্ণ কিনেছে ২২৫ টন।
 
চীন ও রাশিয়ার মতো দেশগুলোর রিজার্ভে স্বর্ণের মজুত বাড়ানো প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রুমানা হক বলেন, ডিডলারাইজেশনের দিকে এটি বড় একটি ইঙ্গিত দেয়। বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলো বুঝে গেছে এক পাত্রে সব ডিম রাখা যাবে না। অর্থাৎ শুধু ডলারের ওপরে মুদ্রা ব্যবস্থা নির্ভরশীল রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোর বিপক্ষে যেভাবে ডলারকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে মনে করছে, তাতে করে এসব দেশ ডলারের ওপর ভরসা না রেখে সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা স্বর্ণের ওপর ভরসা রাখছে।
 
শুধু চীন ও রাশিয়া না, যুক্তরাষ্ট্রের এক সময়ের মিত্র সৌদি আরবও দেশটির ওপর ভরসা রাখতে পারছে না।  ইয়েমেন যুদ্ধে সহায়তা না করা, খাশোগি হত্যা মামলায় যুবরাজকে দায় দেয়া ও আনুষঙ্গিক অনেক কারণে সৌদি-যুক্তরাষ্ট্রের আগেকার দিনের সোনালী সম্পর্ক ফিকে হয়ে গেছে।  

জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান-সৌদির সমঝোতায় চীনের মধ্যস্থতা এবং ইউয়ানের মাধ্যমে জ্বালানি তেল কেনা ডলারের দিন ফুরিয়ে আসার ইঙ্গিত দেয়। তবে ইউয়ান যে ডলারের জায়গা নেবে তা হলফ করে বলা না গেলেও, এক্ষেত্রে স্বর্ণের মান অনেক বেশি এগিয়ে থাকবে।
 
কেননা যেখানে তেলের দাম নির্ধারণে দিনকে দিন ডলারের গ্রহণযোগ্যতা ঠেকছে তলানিতে গিয়ে, একইভাবে ব্যস্তানুপাতিক হারে বাড়ছে ডলারের বিপরীতে মুদ্রার অবনমন। ডলারের বাজারে এমন অস্থিরতার বিপরীতে স্বর্ণের বাজার অনেক বেশি স্থিতিশীল এবং ভরসাযোগ্য। এজন্য অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো এখন ডলারের বদলে রিজার্ভে স্বর্ণের পরিমাণ বাড়াচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, মুদ্রা মানদণ্ডের বিচারে স্বর্ণের এই মজুত ডলারের যুগ শেষ হওয়াকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
 
এদিকে স্বর্ণের চাহিদা বাড়তে থাকায় বাজারে এর দামও বাড়ছে। এতদিন ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার টানা বাড়লেও এবার কমাতে পারে বলে অনেক মহল থেকে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। ইনভেস্টোপেডিয়ার হিসাব অনুযায়ী, সুদের হারের সঙ্গে স্বর্ণের দামের সম্পর্ক কিছুটা বিপরীতমুখী। সুদের হার কমলে বন্ডের মতো বিনিয়োগের বিভিন্ন মাধ্যমের অন্যতম বিকল্প হিসেবে মানুষের আগ্রহ বাড়ে স্বর্ণের প্রতি। আবার সুদের স্বল্প হারে মুদ্রাবাজারে ডলারের বিনিময়মূল্য দুর্বল হয়ে যায়, ফলে তাৎক্ষণিকভাবে স্বর্ণের দাম কমে যায় বিশ্ববাজারে। সব মিলিয়ে বেড়ে যায় স্বর্ণের চাহিদা। আর এতে ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে দামও।
 
এ অবস্থায় আদৌ ডিডলারাইজেশন সম্ভব কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, যদি আগামীতে কোনো দেশ অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলতে পারে তখন ডলারের বাজার ধসে পড়বে। তবে যতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বহাল তবিয়তে থাকবে ততদিন এ প্রক্রিয়া সহজ হবে না। তবে সহজ বিনিময়যোগ্য পণ্য হিসেবে স্বর্ণ এ মাধ্যমে তার পুরানো সম্মান ফিরে পেতে পারে।
 
তবে স্বর্ণের দাম ঊর্ধ্বমুখী হলেও ডলারের চেয়ে বর্তমানে এটি অনেক বেশি নিরাপদ বিনিয়োগ। বিশেষ করে রাশিয়া ও চীনের ওপর লাগাতার যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও সম্পদ বাজেয়াপ্তকে ভালোভাবে নিচ্ছে না বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিধর দেশগুলো। এসব দেশের ভরসার জায়গা দিনকে দিন ঝুকছে স্বর্ণের দিকে।  

news24bd.tv/aa

এই রকম আরও টপিক