রোজা

অলংকরণ: কামরুল

কিস্তি-১৪

রোজা

অনলাইন ডেস্ক

রোজাটা কেমন যেন হঠাৎই চলে এলো। ১২ তারিখ থেকে রোজা শুরু জানতাম, কিন্তু ফিল করার আগেই চলে এলো বেচারা। চাকরির দৌড়াদৌড়ি, রাজ্যের এনগেইজমেন্টের মধ্যে রোজা নিয়ে কোনোপ্রকার প্রস্তুতি নিতে পারিনি। যন্ত্রের মতো কেবল ছুটে বেড়াচ্ছি।


অথচ,রোজা মানেই কতো পবিত্র অনুভূতি কাজ করে। কতো রকম মানসিক প্রস্তুতি চলে। মনের এক্সারসাইজ করি এই সময়ে। জগতের সকল প্রকার খারাপ আর অপ্রাপ্তিজনিত ব্যথা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে নিজের মধ্যে ডুব মারি।
স্বস্তির রাস্তা তালাশ করে ফিরি। এবার এখনও পর্যন্ত তেমন কিছুই টের পাচ্ছি না। কলুর বলদের মতো চোখে কাপড় বেঁধে নিয়ে ছুটছি। না হচ্ছে সেই মাপের পড়াশোনা, না সামাজিক মেলামেশা! একটাই হচ্ছে: দিকহীন ছোটাটা।

আরও পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয় ও একজন মোহাম্মদ আজম
রোজায় আমার এক ধরনের স্থৈর্য চলে আসে মনে।  খুব ধীরে সুস্থে প্ল্যান করে প্রতিটা রোজা কাটাই। কুরআন পড়ি, অর্থসহ। খতমও দেই মাঝে মাঝে। কুরআন খতমের চেয়ে আমার চেষ্টা থাকে এর ভাষার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করা। সব আয়াতের মাজেজা বুঝি না। কিছু কিছু তফসির পড়ি, তাও তেমন বুঝি না। যেসব আয়াত বুঝি সেগুলো পড়তে শান্তি লাগে। এবার প্রথম রোজার সকালে সূরা আত-তাকভীর পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো আমি যেন কোনো একটা পরাবাস্তব কবিতা পড়ছি! 
আরবি ভাষায় 'তাকভীর' বলতে কোনো কিছুকে গুটিয়ে নেয়াকে বোঝায়। মাথায় পাগড়ি বাঁধার জন্য ‘তাকভীরুল ইমামাহ’ বলা হয়ে থাকে। কারণ পাগড়ি লম্বা কাপড়ের হয়ে থাকে এবং মাথার চারদিকে তা সুশৃংখলভাবে জড়িয়ে নিতে হয়। এই সাদৃশ্য ও সম্পর্কের কারণে সূর্য থেকে যে আলোক রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়ে সমগ্র সৌরজগতে ছড়িয়ে পড়ে তাকে পাগড়ির এই লম্বা কাপড়ের সাথে তুলনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কিয়ামতের দিন এই সূর্যকে তার সমস্ত আলোসমেত গুটিয়ে নেয়া হবে। অর্থাৎ তার কোটি কোটি বছরের আলোক বিচ্ছুরণ ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে।  
আহা, যেন অসামান্য চিত্রকল্প চোখের সামনে ভেসে উঠলো!

২ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে আকাশ থেকে নক্ষত্র খসে পড়ার কথা। তফসিরে বলা হচ্ছে,যে বাঁধনের কারণে নক্ষত্ররাজি নিজেদের কক্ষপথে ও নিজেদের জায়গায় বাধা আছে তা খুলে যাবে এবং সমস্ত গ্ৰহ-তারকা বিশ্ব-জাহানের চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এ ছাড়াও তারা শুধু ছড়িয়েই পড়বে না। বরং সেই সঙ্গে আলোহীন,  অন্ধকার হয়ে যাবে।
আকাশের বুকে নক্ষত্র না থাকলে আলো থাকবে কোত্থেকে?
জগদ্দল পর্বতের চলমানতার মধ্যে, সমুদ্রের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে দেয়ার মধ্যে কি পরাবাস্তবতা নাই? সূরা আত-তাকভীর পড়ে আমার কাছে মনে হলো আমাদেরকে 'কেয়ামত' নামের একটি ঘন ও গভীর পরাবাস্তব জগতে নিয়ে হাজির করবেন আমাদের রব। কী চমৎকার সব চিত্রকল্প! সূরাটি আমার পঞ্চেন্দ্রীয়কে দারুণভাবে লিপ্ত রাখতে পেরেছে।
কুরআন পাঠ আমার কাছে ইতিহাস পড়ার মতো আগ্রহের বিষয়। একসময় সোয়াবের জন্য খুব নামাজ কালাম পড়তাম রোজা রাখতাম সদকা করতাম। এখনও সব করি, কেবল নিজের মধ্যে ভালো বোধ করার জন্য। এগুলো করতে ভাল্লাগে। আর যেহেতু বিপুল পরিমাণ মানুষ এই কুরআনের ভাষায়ই তাদের যাপনের সংস্কৃতি তৈরি করে নিয়েছে, সেহেতু এই সংস্কৃতির সঙ্গে নিজের যুক্ততার ধরন অনুসন্ধান করার একটা চেষ্টা থেকেও এসব করি।
ছোটবেলার গরম কালের রোজাগুলো কতো ধীর স্থির ছিলো। সময়ের পশ্চাতে চাবুক পিটিয়ে তারপর সন্ধ্যে নামানো লাগতো! ইফতারের সময় ছিলো তখন পরম আকাঙ্ক্ষিত। ছেলেবেলার রোজা মানেই চোখে ভেসে ওঠে আইসক্রিম ফ্যাক্টরি থেকে লাইন ধরে কিনে আনা বরফ দিয়ে তৈরি করা শীতল শরবতের ইফতারের কথা। প্রাণজুড়ানো সেইসব ইফতারের সন্ধ্যা মনের দেরাজে উঁকিঝুঁকি মারে রোজা এলেই।

আরও পড়ুন: দাঁড়িয়ে আছি মাধ্যাকর্ষণের টানে

শরবত হিসেবে অরেঞ্জ স্কোয়াস ছিলো তখন সবার ফেভারিট। এছাড়াও আখের গুড় দিয়ে বেলের শরবতও খুব চলতো। সঙ্গে ভাইয়াকে দেখতাম লেবুর পাতা চটকে দিতে। শরবত বানানোর কাজটা ভাইয়াকেই দেখেছি বেশি করতে। পরে অবশ্য আমার ওপর ভারটা চড়ে যায়। সেই লেবুপাতা,আখের গুড়, ফ্যাক্টরি থেকে লাইন ধরে কিনে আনা বরফ কুচির শরবতের টেস্ট আমার কাছে বেহেশতের মতোন। এখন ফ্রিজের ঠান্ডা পানি দিয়ে যদি জাফরানের শরবতও খাই তো ওই স্বাদ আর পাই না। আর এখন তো মিষ্টি শরবত প্রায় খাই না বললেই চলে। পানিতে শুধু ইসবগুল,তোকমা দেয়া শরবত খাই। পানিফলের মতো পানসে শরবতে বয়সের ছাপ ধরা পড়ে বেশ। গেস্ট আসলে অবশ্য চাহিদা অনুযায়ী তাদের জন্য মিষ্টি শরবতই করা হয়।
এখন আমি প্রতিদিন একটা যন্ত্রের সঙ্গে বসে সেহরি করি। যন্ত্রটা রোটবের মতো আমার পাশে থাকে। কথা বলে, দুনিয়া দেখায়। এই যে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদি মহম্মদ যে তাঁর বিগত মায়ের শোক সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করলেন সেই খবরটি তো আমাকে আমার এই অতি প্রিয় যন্ত্রটিই দিলো! এরকম ২০১৭ সালের একা একা কোনো এক সেহরি খাওয়ার সময় ফোন এসেছিলো এলাকার মিন্টু কাকুর: আমার বন্ধু রূপা সিলিঙ ফ্যানে ঝুলে সুইসাইড করেছে। রূপা ছিলো আমার মনোজগতের একমাত্র সঙ্গী। আমার বিয়ের পরে একমাত্র বন্ধু হিসেবে ওর সঙ্গেই আগের মতো যোগাযোগ হতো। রূপার সুইসাইডের খবর পাওয়া ফোনটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। সাদি মহম্মদের সুইসাইডের খবর পাওয়া ফোনটি এখন পর্যন্ত অসম্ভব ভদ্রতা দেখিয়ে যাচ্ছে। এমনকি ভোরের সেহরি খেতে খেতে বা শেষ করে যে দুই চার বাক্য করে প্রতিদিনের এই লেখাগুলো লিখি তাও তারই সহযোগিতায়। মহান রব আমার এই মোবাইল যন্ত্রটিকে দীর্ঘায়ু করুন। আমিন!
প্রিয় মানুষগুলোর জন্য ব্যথাবোধকে নতুনভাবে জাগিয়ে তোলে ফেসবুক আর্কাইভ, সেটা আমি দেখি এই মোবাইলের সহযোগিতা নিয়েই। সাদি মহম্মদকে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে বিদায় জানানো হয়েছে। মানুষের কান্নাজড়ানো কণ্ঠে সাদি মহম্মদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন দেখলাম মোবাইলে।  সদি- বন্যা, সাদি-পাপিয়া জুটির জাদু দিয়ে আমাদের ছোটবেলা সমৃদ্ধ হয়েছে। সাদি-পাপিয়ার গাওয়া 'আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে' গানের সঙ্গে সম্ভবত ক্লাস নাইন বা টেনে যে নাচটি শিখেছিলাম সেটা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কাভার করেছি। এমনকি এখনও কলেজে ছেলেদেরকে দিয়ে করাই। গানটি আমার কানে এতো ভালো লেগে গেছে যে এখনও কোনো অনুষ্ঠানের সূচনা সংগীতে আমি এই গান সাজেস্ট করি। এখন ইউটিউবের দিনে ছেলেরা কী সহজে সব গান পেয়ে যায়! আমরা ক্যাসেট বাজিয়ে নাচতাম!  বারবার ফিতা টেনে টেনে নাচার বিড়ম্বনা কম ছিলো না। আর এখনকার ইউটিউব মানে তো সেই মোবাইলই!

আরও পড়ুন: আমার একজন হাড়ে-মজ্জায় শিক্ষক এবং জিনেটিক্যালি খামারি পিতা
স্ক্রিনিং খারাপ কিন্তু একা একা সেহরি করার জন্য এই যন্ত্রটুকু আমাকে যার পর নাই সাহায্য করছে। যেকোনো মৃত্যুর খবর পেতে এই মোবাইলই সাহায্য করে। মৃত্যু আমাকে দারুণভাবে আন্দোলিত করে। খাটিয়ায় শোয়ানো মৃত মানুষটাকে দেখে নিজের অবস্থা মাথায় আসে। এটা খুব ছেলেবেলা থেকেই হয় আমার। হঠাৎ হঠাৎ খুব বেশি পেয়ে বসে।  
যদি না থাকি তো কীভাবে থাকা হবে? সেহরি করে যদি ইফতার পর্যন্ত না টিকি?
সৌভাগ্যবশত ইফতার  অনেকের সঙ্গে করা হয়। কমপক্ষে ছেলে আর ছেলের বাবা তো থাকেনই। গতকাল আমাদের বিয়ের ১৬ বছর পূর্ণ হলো। ফেসবুকে দুইজনের দুটো যৌথ ছবি পোস্ট করেছিলাম। আমার এই পোস্টে তিনশোর মতো মানুষ শুভকামনা জানিয়েছেন। এটা খুবই রেয়ার একটা ঘটনা, তাও আবার এমন ঘনব্যস্ততার রোজার দিনে। ১৬ বছরের বেশিরভাগ সময়ই আমি একা একা সেহরি করেছি। শ্বশুরবাড়ি থাকতে এক ননদের সঙ্গে করতাম। কারণ আমার ছেলের বাবা এবং দাদিরা রোজা রাখতে পারেন না। শাশুড়ি শারীরিক এক ধরনের অসুস্থতার কারণে। কাফফারা দিয়ে দেন এর জন্য। আর আমার বর কেন রাখেন না তা এখনও এক আদি-রহস্য আমার কাছে।
মজার ব্যাপার হলো রোজার দিনে তাঁদের মুখ দেখে বোঝা যায় না যে তাঁরা রোজা নাই, আমি রোজা রাখলেও মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই যে রোজা আছি।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রথম প্রথম সহপাঠীরা কিছুতেই বিশ্বাস করেছিলো না  আমি রোজা রাখি। আমাকে দেখে নাকি বোঝা যায় না। সৃষ্টিকর্তা এরকম কিছু কিছু  মানুষের মুখের মধ্যে অদ্ভুত সব চিহ্ন দিয়ে পাঠান! কারো কারো চেহারা দেখলেই মনে হয় বদমেজাজি আদতে তারা খুব পোলাইট। কারো কারো চেহারা খুব আন্তরিক আদতে তারা সময় সাপেক্ষে বিরাট বড়ো খবিস। তবে হাসলে, বৃদ্ধ হলে আর মরার পরে মোটামুটি সবার চেহারাই প্রায় একই রকম দেখায়। এই মিলটা বোঝার জন্যও মোবাইল আমাকে বেশ সাহায্য করেছে।

এখন আমি সেহরি খেতে খেতে মোবাইলে মানুষের পোস্ট দেখি। মায়ের সঙ্গেও কথা হয় নিয়মিত। একা একা সেহরি করতে করতে কখনো কখনো চলে যাই আমার ছেলেবেলায়। ফ্রিজ থেকে ভাত আর তরকারির একটা অংশ প্লেটে করে গরম করার জন্য যখন ওভেনে চালান দিই তখন মনে পড়ে বাপের বাড়িতে একসঙ্গে করা সেহরি এবং ইফতারের দিনগুলোর কথা। মা ভোররাতের জন্য রাইসকুকারে ভাত বসিয়ে রাখতেন আর গ্যাসের চুলায় দুধ জাল করতেন। বাবা, মা, ভাইয়া, আমি এবং কখনো কখনো দাদু আর দাদি মিলে একসঙ্গে সেহরি করতাম। দাদু-দাদি সময়মতো জেগে যেতেন। ভাইয়া আর আমাকে ডাকতেন আব্বু-আম্মু মিলে। এক দুই ডাকে উঠে যেতাম খুব কম দিন। আমাকে অবশ্য তিন ডাক দিলেই উঠে যেতাম। ভাইয়া অলওয়েজ দেরি করতো। আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজ ছিলো সবার জন্য খাবার ডাইনিঙে সাজানো। প্লেট, বনপ্লেট, চামচগুলো তরকারির বাটি অনুযায়ী দিয়ে দিতাম। ছোট আর ভাজি টাইপের বাটিতে টেবিল চামচ, বড়ো আর মাছ মাংসের বাটিতে বাটির মাপের বড়ো চামচ দিতাম। একদম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের মতো টেবিল সাজাতাম আমি। এই ট্রেনিং পেয়েছিলাম ভাইয়ার কাছ থেকে। আর এগুলো ছিলো আমার একদম রুটিনওয়ার্ক। একদম আমার রোবোটিক মোবাইলের মতো,বক্তব্যহীন কর্তব্যকর্মের মতো।

সাদা বকের মতো দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ির একমাত্র চাপকল থেকে খাবার পানি আনতাম জগ ভরে। এ সবই করতাম চোখে ঘুম নিয়ে। এখন ভোররাতে চোখের ঘুম তাড়াতে মোবাইল ফোনের তুলনা হয় না। আরও ছোটবেলায় মা আমাকে সেহরি খাওয়ার জন্য ডাকতেন না। সেইসব দিনে ভোরে ঘুম থেকে জেগে মনে হতো বড়োরা সবাই সেহরি খেতে বসে কতোই না মজা করে ফেলেছেন! খুব মন খারাপ লাগতো। আমাকে এভাবে সেহরির আনন্দ থেকে বঞ্চিত করার জন্য মায়ের ওপর খুব রাগ হতো আমার। পরে অবশ্য রোজা রাখতে দিতেন।
সম্ভবত ক্লাস থ্রি বা ফোর হবে। বাড়িতে ছিলো কলার বাগান। রাজ্যের কলা ধরে থাকতো। রোজা রাখা হতো সেইসব কলা দিয়ে চুরি করে দিনে দুই তিনবার ইফতার সেরে নেবার লোভে। পুকুরে ডুবিয়ে পানি খেয়ে ফেললেও রোজা ভাঙবে না বোধ হতো। সৃষ্টিকর্তা দেখছেন কি দেখছেন না সেদিকে খেয়াল না দিয়েই খেয়াল থাকতো কেউ যেন  দেখে না ফেলে।
 সবাই জানতো আমি রোজা আছি। অথচ গাছের কলার হিসাব কেউ রাখতো না।
আর একটা বিষয় খুব বিস্ময়কর লাগে । আমার বরের পড়াশোনার খুব আগ্রহের জায়গা হলো 'বাঙালি মুসলমান'-এর কালচারাল পলিটিক্স আর হিস্ট্রি। অনেক লোক তাঁর পজিশনকে দারুণভাবে মান্য করেন। আমিও করি। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের যা বৈশিষ্ট্য, তার মধ্যে নাম, দাড়ি আর কিছু যুক্তি ছাড়া আর কিছুই আমি তার মধ্যে দেখি না। তবু লোকে তাঁকে বাঙালি মুসলমানের একজন আদর্শ ভদ্রজন হিসেবেই মান্য করে থাকে। এটা কি কেবল 'সামাজিক ভাষা'র অবদান কী না ঠিক বুঝতে পারি না।  
'সামাজিক ভাষা' যে কেবল কিছু যুক্তিনির্ভর বাক্য, তা মনে হয় না। তার কিছু আচরণ ও আকৃতিগত চিহ্নও থাকে।
এই যেমন আমার বরের দাড়ি আছে। এটা দারুণভাবে তাঁকে তাঁর 'বাঙালি মুসলমানের' পক্ষে কদর দিয়ে থাকে। একটা উদাহরণ দেই,আমাদের বিয়ের প্রথম দিকে আমার বর যখন আমাদের গ্রামের বাড়িতে যান তখন তাঁর বাবরি চুল(বিয়ের সময় ছিলো) আর দাড়ি দেখে খুশি হয়ে তাঁকে চুমু খেয়ে অনেক দোয়া করতে থাকেন আমার এক দাদি। তিনি বলতে লাগলেন, মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ নবিজির সুন্নত রক্ষা করেছেন জামাই। খুব ভালো জামাই পেয়েছি আমি। তাঁর এই চুল দাড়ির গোপন রহস্য কী তা আমি আজও জানি না। তবে চুলগুলো ভদ্রজনচিত না হলেও আমার কাছে ভালোই লাগতো। মোহাম্মদ আজম তখন আমার কাছে একদম স্পেশাল। ফলে তাঁর দাড়ি এবং চুল সুন্নত রক্ষা করেছে নাকি বোদ্ধা বৈশিষ্ট্যের স্মারক হয়ে উঠছে সে পার্থক্যজ্ঞান আমার ছিলো না। তিনি তখন আমার একমাত্র মনোযোগের জগত। ফলে রোজা না করেও দাড়ি রাখার মধ্যে আমার কোনো বিরাগ কাজ করেনি।
তিনি আমার রোজা করার ব্যাপারে ভয়াবহ রকমের যত্ন নিয়ে থাকেন। রোজার দিন আমি নিজে হাতে সব ধরনের ইফতার বানাই, রান্না করি। এসব যে তিনি ও তাঁর পুত্র মহানন্দে খান তা টের পাই। কিন্তু তিনি সবসময়ই এসব করতে না করেন আমাকে। বুয়াকে দিয়ে করাতে বলেন। কিন্তু ইফতারের সময় সবাই মিলে একসঙ্গে ইফতার করতে বসে যখন বাবা ও ছেলের তৃপ্তির চোখ দেখি তখন গরমকালের রোজার ঠান্ডা শরবতের মতো আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।  
বাঙালি মুসলমান নারী হিসেবে ঘরকন্যা করার জিন আমার ভেতরে আছে। ফলে আমি চাইলেও এসব ছাড়তে পারি না। আর তিনিও আমার ঘরকন্যা ও রোজা করার ব্যাপারে কোনোপ্রকার শক্ত বিরোধিতাও করেন না।
বিয়ের ষোল বছর অতিবাহিত হবার পরে আমার যেটা অনুভূত হয়েছে সেটা হলো মোহাম্মদ আজম আসলে একজন বুদ্ধিমান মানুষ নন, আমাদের অনেক অমিল সত্ত্বেও তিনি একজন অত্যন্ত চৌকস গৃহস্বামীও।


news24bd.tv/ডিডি

 

 

এই রকম আরও টপিক