ঈদ আনন্দ নেই জিম্মি নাবিকদের পরিবারে

নাবিক আইনুল হকের মা লুৎফে আরা ছেলের জিম্মিদশার কথা বলেন। ছবি: সংগৃহীত

ঈদ আনন্দ নেই জিম্মি নাবিকদের পরিবারে

অনলাইন ডেস্ক

এবারের ঈদ আনন্দ বিষাদে রূপ নিয়েছে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর ২৩ নাবিক ও ক্রুর পরিবারে। আশঙ্কা আর উদ্বেগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে পরিবারগুলো। তাদের চোখে নেই ঘুম। নিদ্রাহীন ও দুশ্চিন্তায় রাত কাটাচ্ছেন তারা।

মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) নাবিক আইনুল হকের মা লুৎফে আরা জানান, ঈদের যে আনন্দ, সেই আনন্দের মন মানসিকতা আমাদের এখন নেই। দুইটা ছেলে ছাড়া আমার আর কেউ নেই।

২০২১ সালে কোভিড মহামারিতে স্বামীকে হারানোর পর দুই ছেলেই তার সবকিছু। বড় ছেলে আইনুল জাহাজের চাকরিতে যোগ দেন ২০১৫ সালে।

বাবার মৃত্যুর পর তিনি একাই ধরেন সংসারের হাল। জলদস্যুদের কবলে জাহাজ এ খবর জানার পর থেকে চোখে ঘুম নেই এই মায়ের। এর মাঝে দুই বার বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।

‘ছেলে জানিয়েছে, তারা খুবই পানির কষ্টে রয়েছে। এখন পর্যন্ত সপ্তাহে কেবল দুবার গোসলের সুযোগ পাচ্ছেন। সামনে হয়তো সপ্তাহে একবারের বেশি সুযোগ নাও পেতে পারে। আমার ছেলে তো ইঞ্জিন রুমে কাজ করে তাই তার কষ্ট অনেক বেশি' কথাগুলো বলছিলেন এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি নাবিক আইনুলের মা লুৎফে আরা।  

জলদস্যুরা গত শুক্রবার নাবিকদের বেশ কয়েকজনকে তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেয়। ওই দিন ইফতারের পর ছেলে আইনুল তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে এসব জানান।

গত ১২ মার্চ সোমালিয়ার দস্যুরা ভারত মহাসাগর থেকে জাহাজটি ছিনতাই করে। তারা আইনুল হকসহ জাহাজের ২৩ নাবিককে জিম্মি করেছে। আজ মঙ্গলবার জিম্মিদশার ২৭ দিন চলছে। এখনো নাবিকদের মুক্তির বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি।

লুৎফে আরা বলেন, ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন, তারপরও ঘুম আসে না। কেবল দুশ্চিন্তা এসে ভর করে। ছোট ছেলেকেও সারাক্ষণ বাসায় থাকতে বলেছি ,একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বেশিক্ষণ বাইরে থেকো না।

দুই সপ্তাহ আগে জাহাজের মালিক প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তারা নাবিকদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ইফতারের আয়োজন করেন। সেখানে তারা পরিবারগুলোকে আশ্বস্ত করেন যে যত দ্রুত সম্ভব জিম্মি নাবিকদের ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা তারা করছেন।

লুৎফে আরও জানান, ওই আশ্বাসের পর আমাদের মনে হয়েছিল হয়তো ঈদের আগেই নাবিকেরা মুক্তি পাবেন। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে আরও সময় লাগবে।

লুৎফে আরা বেগম ছোট ছেলেকে নিয়ে চট্টগ্রামের আসকারদীঘিপাড়ে নিজ বাসায় থাকেন। ছোট ছেলে মাইনুল হক এবার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেছেন। ২০০১ সালে করোনার সময় আইনুল হকের বাবা মারা যান। সে সময় আইনুল ছিলেন জাহাজে। বাবার মৃত্যুর কথা শুনে ছুটি নিয়ে বাবাকে শেষ দেখা দেখতে আসেন।

সরকারি নাবিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০১৬ সালে কবির গ্রুপের জাহাজে যোগ দেন আইনুল হক। ৯ বছরের জাহাজি জীবনে এবারই প্রথম জিম্মিদশার পড়েছেন আইনুল হক। জিম্মি হওয়ার পর এখন সপ্তাহে একবার বাড়িতে যোগাযোগের সুযোগ দেয় দস্যুরা। তবু মায়ের মান মানছে না।

মা বলেন, ‘ছেলে অস্ত্রধারীদের সঙ্গে আছে—ভাবতেও ভয় লাগে। আমাদের সন্তানেরা মায়ের বুকে ফিরে আসুক। দিনগুলো কষ্টে যাচ্ছে। ’

আইনুলের পরিবারের মতো একই অবস্থা জিম্মি আরেক নাবিক মোহাম্মদ নুরুদ্দিনের বাড়িতে। নূরের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, আমাদের জন্য ঈদের আনন্দটা এবার আসে নাই। আমাদের স্বজনদের জন্য আমরা এতটাই দুশ্চিন্তায় আছি যে ঈদের কোনো প্রস্তুতি শপিং কিছুই হয়নি আমার কিংবা আমার শিশু পুত্রের মাঝেও ঈদের কোনো আনন্দ নেই।

জান্নাতুল বলেন, ঈদে জাহাজে থাকলেও আনন্দেই কাটান নাবিকেরা একসাথে পরিবারের মতো উদযাপন করেন। পরিবারের সদস্যদের সাথেও সেই আনন্দ ভাগ করে নেন। কিন্তু এবার তো আর সেটা হচ্ছে না। আমার স্বামী নিরাপদে বাড়ি ফিরে এলেই আমাদের ঈদ।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জিম্মি জাহাজ ও নাবিকদের মুক্তির বিষয়ে জলদস্যুদের সঙ্গে সমঝোতা প্রায় শেষ। জাহাজের মালিক পক্ষ এখন আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিপণ দেওয়ার বিষয়টি সুরাহা করার প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত। অবশ্য জাহাজের মালিক প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে এখনো চূড়ান্তভাবে কিছু জানায়নি।

কেএসআরএম গ্রুপের গণমাধ্যম উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, জলদস্যুদের সাথে আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে। তবে নাবিকদের মুক্তির বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো দিনক্ষণ বলা সম্ভব নয়। তবে তিনি জানান, ঈদের পর দ্রুততম সময়ে জাহাজ ও নাবিকদের মুক্তি এবং ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে মালিক কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

news24bd.tv/DHL