আগুনে পোড়া : প্রতিরোধ ও করণীয়

অসচেতনতায় হোক বা দৈব-দুর্বিপাকে হোক আগুনে পুড়ে প্রাণহানিসহ সর্বস্বান্ত হয় মানুষ; কিন্তু আগুনে পুড়লে কী করা দরকার কিংবা আগুন থেকে বাঁচতেই বা কী করা উচিত—তা জানেন না অনেকেই। এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক  ডা. সামন্ত লাল সেন

আমাদের দেশে বিভিন্ন অগ্নিদুর্ঘটনায় আগুনে পুড়ে মারা যায় বহু মানুষ। অনেকে মারাত্মক আহত হয়ে দুর্বিষহ, এমনকি পঙ্গুজীবন বরণ করে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের ১ শতাংশের ওপর মানুষ প্রতিবছর আগুনে পোড়ে। এর মধ্যে অসাবধানতার কারণে আগুনে পুড়ে ৮০ শতাংশ মানুষ। সরকারি ব্যবস্থাপনায় দেশের একমাত্র চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে। দূর-দূরান্ত থেকে অনেক রোগী আসছে বিধায় এই বার্ন ইনস্টিটিউটটি এখন রোগীর ভারে ন্যুব্জ।

কারণ সাধারণত কয়েক ধরনের আগুনে পোড়াজনিত দুর্ঘটনা ঘটে। তার মধ্যে— ফ্লেইম বার্ন : এ ধরনের আগুনের সূত্রপাত ঘটে সাধারণত হারিকেন, কুপি বাতি বা রান্নার চুলা থেকে। বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা : বিভিন্ন বাড়ির ছাদে কিংবা বাসায় যত্রতত্র বৈদ্যুতিক তারের অব্যবস্থাপনা অনেক সময় এ ধরনের দুর্ঘটনা ডেকে আনে। এ ছাড়া তড়িতাহত হয়ে অনেকে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় পড়ে। এসিড বার্ন : এসিড নিক্ষেপ ঘটনাটি আগে শুধু প্রেমের ক্ষেত্রে ঘটলেও এখন যেকোনো বিরোধে জড়িয়ে এসিড সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে মানুষ। জাতীয় এসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল করা হলেও থেমে নেই এসিড নিক্ষেপের ঘটনা। এসব ঘটনায় মহিলারাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এতে শরীরের বড় অংশ ঝলসে যায়। রেডিয়েশন বার্ন : রেডিয়েশনের কারণে বিভিন্নভাবে মানুষ দগ্ধ হয়। যদিও এ ধরনের আগুনে পোড়া রোগীর সংখ্যা অনেক কম।

আগুনে পুড়লে করণীয় ♦  শরীরে আগুন লাগলে, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দৌড়াদৌড়ি করা উচিত নয়। ♦   আশপাশের লোকজনের উচিত হবে, অগ্নিদগ্ধ ব্যক্তির শরীর থেকে পোশাক খুলে প্রথম ১০ মিনিট এবং কিছুটা বিশ্রাম দিয়ে আধা ঘণ্টা অনবরত ঠাণ্ডা পানি ঢালা। এতে অগ্নিদগ্ধ ত্বক ঠাণ্ডা হবে, ত্বকের অতিরিক্ত দগ্ধতা বন্ধ হয়ে ত্বকের যন্ত্রণাও কমে যাবে। ♦  এ অবস্থায় কোনো মলম লাগানো যাবে না। ♦  ত্বকে ফোসকা পরা ভালো লক্ষণ। ফোসকা মানে ত্বকের জীবকোষ জীবিত আছে। এ জাতীয় ত্বক সেরে ওঠে। ♦  ত্বকের গভীর স্তর পর্যন্ত দগ্ধ হলে সাধারণত ফোসকা পড়ে না। এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি। ♦  পেট্রল বা তৈল জাতীয় পদার্থে আগুন ধরলে বালু বা মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি দিলে আগুন নিভে যায়। ♦  কখনো কম্বল জড়িয়ে আগুন নেভাতে যাবেন না বা রোগীর গায়ে কম্বল জড়িয়ে দেবেন না। কারণ কম্বলে আগুনের তাপ দেহের মধ্যে আটকে যায় এবং তাতে ত্বকের দগ্ধতা বৃদ্ধি পায়। এতে অনেক সময় জীবননাশের ঘটনাও ঘটে। ♦  যেকোনোভাবেই আগুন লাগুক না কেন, ত্বকে ডিমের কুসুম বা টুথপেস্ট লাগাবেন না। এসবে বরং ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা বেশি। ♦  শরীরে পানি ঢালার পর যতটা সম্ভব পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত কাপড় দিয়ে মুছে দিন। ♦  এরপর দেরি না করে রোগীকে নিকটস্থ হাসপাতালে স্থানান্তরের ব্যবস্থা নিন।

রাসায়নিক বার্ন বা এসিডদগ্ধ হলে এসিড নিক্ষেপ একটি গুরুতর দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও দেশে এসিড-সন্ত্রাস থেমে নেই। যে ব্যক্তি এসিডে দগ্ধ হয়, তার শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক যে ক্ষতি হয় তা অপূরণীয়। তবুও এসিডে বা রাসায়নিক কোনো পদার্থের কারণে কেউ দগ্ধ হলে কিছু বিষয় মেনে চলা জরুরি। যেমন :

♦  এসিড দেখতে পানির মতো, কিন্তু শরীর স্পর্শ করা মাত্রই চামড়া পুড়ে যায় এবং জ্বলতে থাকে। এসিড চামড়া ভেদ করে পেশিতে প্রবেশ করে এবং ক্ষতি সাধন করতে থাকে। তাই এসিড নিক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের পোড়া অংশ বেশি পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। যত বেশি পানি ঢালা যাবে এসিডের শক্তি তত বেশি কমে যাবে এবং শরীরের ক্ষতি সাধন তুলনামূলকভাবে কম হবে। ♦  বাংলাদেশে সরকারিভাবে এসিড দগ্ধে চিকিৎসা অপ্রতুল। যত শিগগির সম্ভব এসিডদগ্ধ ব্যক্তিকে ঢাকাস্থ শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নিতে হবে। ♦  মনে রাখা দরকার, এসিডে পোড়া ব্যক্তির দ্রুত সেরে ওঠার জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও আলো-বাতাসসম্পন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। যেহেতু এসিড নিক্ষেপে ত্বকের ক্ষতি হয় বেশি, সেহেতু ইনফেকশন প্রতিরোধেও কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য— ♦  পরিষ্কার মশারি টাঙিয়ে রাখুন, যাতে রোগীর গায়ে কোনো মশা-মাছি বা ময়লা না লাগে। ♦  নিয়মিত বাতাস করুন। ♦  প্রতিদিন পরিষ্কার পানি দিয়ে পোড়া ঘা পরিষ্কার করুন। ♦  প্রচুর পানি ও পুষ্টিকর খাদ্য, যেমন প্রচুর শর্করা ও আমিষ জাতীয় খাবারের ব্যবস্থা করুন। ♦  এসিডে মুখমণ্ডল বা চোখ আক্রান্ত হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। সে জন্য সাধারণ পানি বা নরমাল স্যালাইন দিয়ে চোখ ভালোভাবে ধৌত করুন। প্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক লাগাতে হবে এবং চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

মৃত্যুঝুঁকি কতটুকু? শিশুদের শরীরের ১০ শতাংশ ও প্রাপ্তবয়স্কদের শরীরের ১৫ শতাংশের মতো পুড়ে গেলে এবং এ অবস্থায় তাদের সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা দিতে না পারলে মৃত্যুঝুঁকি থাকে। অবশ্য উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থায় সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডের মতো দেশে শরীরের ৮০ শতাংশ দগ্ধ হলেও বাঁচিয়ে তোলা সম্ভ্ভব হচ্ছে। ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইনস্টিটিউটে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ দেহ ভস্মীভূত হলেও মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে বর্তমান চিকিৎসা পদ্ধতিতে।

চিকিৎসকদের প্রতি পরামর্শ ♦  কোনো চিকিৎসক যখনই আগুনে পোড়া কোনো রোগী পাবেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি ক্যালকুলেশন করবেন যে রোগীর শরীরের কত শতাংশ পুড়ে গেছে। ♦  যদি শিশুদের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়ে যায়, তবে জরুরি ভিত্তিতে ফ্লুইড স্টার্ট করা উচিত। অর্থাৎ এ অবস্থায় দ্রুত রোগীর শরীরে প্রয়োজনীয় স্যালাইন পুশ করতে হবে। ♦  মনে রাখবেন, এ অবস্থায় রোগীকে নরমাল স্যালাইন কিংবা ‘হার্ট ম্যান সলিউশন’ দেওয়া যাবে; কিন্তু কোনো অবস্থায়ই ‘অ্যাকুয়া স্যালাইন’ দেওয়া যাবে না। ♦  এরপর বাকি চিকিৎসা হিসেবে ড্রেসিং করে ‘সিলভার সালফা ডিয়াজাইন’ ক্রিম লাগিয়ে অবস্থাভেদে উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগীকে দ্রুত বার্ন হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে।

রক্ষার উপায় ♦  নারীরা সাধারণত ঢিলেঢালা জামা পরিধান করে আগুনের কাছে থাকে বলে তাদের অসাবধানতায় অনেক সময় আগুন লেগে যায়। এ জন্য পোশাক পরিধান বিষয়ে একটু সতর্ক হওয়া উচিত। ♦  শিশুরা অসাবধানতাবশত গরম পানি, ডাল, চা অথবা চুলায় হাত ঢুকিয়ে দেয়। এতে তারা আগুনে পুড়ে যায়। ♦  চুলায় রান্নার সময় অনেকে অসাবধানতাবশত আগুনে পোড়ার শিকার হয়। ♦  রান্নার চুলা ঘরের মেঝেতে না বসিয়ে কোনো উঁচু স্থানে বসান এবং দাঁড়িয়ে রান্না করুন। ♦  শিশুদের রান্নাঘরে খেলাধুলা করতে দেওয়া উচিত নয়। ♦  যেকোনো চুলা সর্বক্ষণ জ্বালিয়ে না রেখে নিভিয়ে রাখুন। ♦  রান্নার সামগ্রী চুলার ওপর বা কোনো তাকের ওপর রাখবেন না। এতে পোশাকে আগুন লাগার আশঙ্কা বেশি থাকে। ♦  এসিডের সহজলভ্যতা ও যত্রতত্র ব্যবহার রোধ করা উচিত।

news24bd.tv/desk