এই শীতে অ্যাজমা রোগীদের করণীয়

শিশু থেকে বয়স্ক সব ধরনের লোকজনই অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টে ভোগেন। শীতকালে অ্যাজমার প্রকোপ অনেকটাই বাড়ে এবং সুচিকিৎসার অভাবে ভোগান্তিও বাড়ে। তাই প্রয়োজন বিশেষ সতর্কতা।

বাংলায় প্রচলিত হাঁপানি রোগই অ্যাজমা। এটি শ্বাসনালির একটি দীর্ঘস্থায়ী বা ক্রনিক প্রদাহজনিত সমস্যা। অ্যাজমার কারণে শ্বাসনালিতে বিভিন্ন কোষ বিশেষত ইয়োসিনোফিল ও অন্যান্য কোষের উপাদান জমা হয় এবং শ্বাসনালিকে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলে। পরিবেশের সাধারণ বস্তুগুলোর প্রতি অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীল হয় বলে অ্যাজমা রোগীর শ্বাসনালির পথও সংকীর্ণ হয়। তখন রোগী শ্বাসকষ্ট, শুকনা কাশি, বুক জ্যাম হওয়া, বুকে বাঁশির মতো শব্দ ইত্যাদি সমস্যায় ভুগতে থাকে।

কারণ অ্যাজমার কারণ এখনো অজানা। দেখা গেছে, কিছু উপাদান অ্যাজমা রোগের উৎপত্তি, আক্রমণ, স্থায়িত্বকে বেশ প্রভাবিত করে, যাদের বলে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ উপাদান। এসব কারণ বংশগত ও পরিবেশগত—এই দুই ধরনের হয়।

বংশগত : অ্যাজমা রোগটি অনেকটা জেনেটিক বা বংশগত। যদি বংশে কারো অ্যাজমা থাকে, তবে আরেকজনের থাকার আশঙ্কা বেশি।

পরিবেশগত : কিছু পরিবেশগত কারণে অ্যাজমার প্রকোপ বাড়ে। যেমন—অ্যালার্জি, শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়ামজনিত, ভাইরাস সংক্রমণ, পেশাগত কারণ বা ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত থাকা, আবহাওয়া, আবেগপ্রবণতা, দীর্ঘদিন ধরে অপরিকল্পিত বা অনিয়মিতভাবে অপর্যাপ্ত ওষুধ সেবন ইত্যাদি।

লক্ষণ কারো অ্যাজমা হয়েছে কি না তা কিছু লক্ষণ দেখে বোঝা যায়। যেমন— ♦ অ্যাজমা হলে রোগীর শ্বাসনালি সংকুচিত হয়ে শ্বাসকষ্ট হয়। ♦ বুকে চাপ অনুভূত হয়। ♦ কাশি থাকে, বুকে বাঁশির মতো শব্দ হয় ইত্যাদি।

তবে এই লক্ষণগুলো সব রোগীর ক্ষেত্রে একইভাবে থাকে না। কারোর ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট বেশি হয়, কারোর বুকে চাপ লাগা বেশি হয়। আবার অনেকের শুধু শুকনা কাশি হয়। তবে নিচের লক্ষণগুলো কারোর থাকলে কালক্ষেপণ না করে চিকিৎসক দেখানো উচিত। যেমন—

♦ রোগীর বুকে বাঁশির মতো শব্দ। ♦ রাতে তীব্র কাশি থাকা। ♦ ব্যায়ামের পর কাশি বা শ্বাসকষ্ট। ♦ বায়ুবাহিত অ্যালার্জেন বা উত্তেজকের সংস্পর্শে কাশি বা শাসকষ্ট অনুভব করলে। ♦ রোগীর কখনো ঠাণ্ডা লাগলে এবং তা ভালো হতে ১০ দিনের বেশি সময় লাগলে। ♦ অ্যাজমার ওষুধে রোগীর লক্ষণ ভালো হয়ে গেলে ইত্যাদি।

পরীক্ষা বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই অ্যাজমা নির্ণয়ে তেমন কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। তবে অ্যাজমা রোগের তীব্রতা জেনে তার যথাযথ চিকিৎসার জন্য কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন আছে বৈকি। যেমন— ♦ অ্যাজমা রোগীর শ্বাসনালির বাধা পরীক্ষায় স্পাইরোমেট্রি বা পিক ফ্লো পরীক্ষার কথা বলা হয়। ♦ ‘কফ ভ্যারিয়ান্ট’ অ্যাজমার ক্ষেত্রে ‘মেথাকলিন চ্যালেঞ্জ টেস্ট’ করা হয়, যাতে শ্বাসনালির অতি প্রতিক্রিয়াশীলতা দেখা যায়। ♦ ‘কাশি প্রধান’ অ্যাজমার ক্ষেত্রে কফ পরীক্ষায় ইয়োসিনোফিল পাওয়া যায়। ♦ সিরাম IgE পরীক্ষা দিয়ে এটোপি নির্ণয় করা যায় ইত্যাদি।

চিকিৎসা ওষুধবিহীন ও ওষুধ ব্যবহার করে—এই দুই ধরনের অ্যাজমার চিকিৎসা রয়েছে। ওষুধবিহীন চিকিৎসার ক্ষেত্রে সতর্কতাই মূল উপায়। ওষুধবিহীন চিকিৎসা : ♦ অ্যাজমার অন্যতম প্রধান কারণ অ্যালার্জি। কোন জিনিসে বা খাদ্যে কার অ্যালার্জি হয়, তা জেনে যথাসম্ভব পরিহার করা উচিত। ♦ ধূমপান পরিহার। ♦ অ্যালার্জেন নয়, অথচ শ্বাসকষ্ট বাড়ায় এমন জিনিস পরিহার। ♦ ধুলাবালু, ময়লা, গন্ধ ইত্যাদি এড়িয়ে চলা। ♦ যথা সম্ভব মানসিক চাপ কমানো। ♦ ঘুমের ওষুধ, তীব্র ব্যথানাশক পরিহার করা।

ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা : ওষুধের মাধ্যমে অ্যাজমা নির্মূল করা যায় না, তবে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। অ্যাজমার ওষুধ এই দুই ধরনের—উপশমকারী ও প্রতিরোধককারী। সালবিউটামলজাতীয় ওষুধ উপশমকারী ওষুধ, যা তাৎক্ষণিকভাবে শ্বাসনালির ছিদ্রপথকে প্রসারিত করে শ্বাস-প্রশ্বাসের বাধা কমিয়ে দেয়। তবে এর কার্যকাল খুবই কম। আবার ইনহেল স্টেরয়েড, ক্রোমোগ্লাইকেট, মন্টিলুকাস্ট ইত্যাদি হলো প্রতিরোধক ওষুধ, যা ধীরে ধীরে কাজ করে। অ্যাজমার এসব ওষুধ নানাভাবে প্রয়োগ করা যায়। যেমন—

ইনহেলার পদ্ধতি : এটি সবচেয়ে উপকারী এবং আধুনিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ওষুধ    নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে প্রবেশ করে শ্বাসনালিতে কাজ করে।

ট্যাবলেট অথবা সিরাপ : এ পদ্ধতিতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি। কারণ অধিক মাত্রার ওষুধ  রোগীর রক্তে প্রবেশ করে।

নেবুলাইজার : তীব্র অ্যাজমার আক্রমণে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।

ইনজেকশন : অ্যাজমার মারাত্মক আক্রমণে স্টেরয়েড ইনজেকশন শিরায় দেওয়া হয়।

জটিলতা অ্যাজমা কোনো কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে কি না তা কিছু লক্ষণ দেখে বোঝা যায়। এ সময়     উপশমকারী ওষুধের পরিমাণ বেশি লাগে এবং ইনহেলার দ্বারা ৩-৪ ঘণ্টার বেশি শ্বাসকষ্টের উপশম  থাকে না। তা ছাড়া রাতে শ্বাসকষ্টে ঘুম ভেঙে যাওয়া, স্বাভাবিক কাজকর্মে শ্বাসকষ্ট হওয়া, পিক ফ্লো ধীরে ধীরে কমাও জটিলতার লক্ষণ। তখন বিশেষ সতর্ক হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।

অ্যাজমা প্রতিরোধে করণীয় ♦ সব রকমের ধুলাবালি এড়িয়ে চলতে হবে। বিশেষ করে অ্যাজমা আক্রান্ত রোগীর শোবার ঘরটি সব সময় শুষ্ক, ধুলা ও মাইটমুক্ত হতে হবে। ♦ ঘরে যাতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস থাকে সে ব্যবস্থা করুন। রাতে ঘুমানোর সময় পর্যাপ্ত উষ্ণতায় থাকুন। ♦ সকালে প্রস্রাব-পায়খানার সময় মুখে কাপড় বা মাস্ক ব্যবহার করুন। ♦ সকালে ও রাতে চলাফেরার সময় নাকে কাপড় বা মাস্ক ব্যবহার করা। ♦ দিনে বা রাতে কুয়াশায় চলাফেরার সময় নাক ঢেকে রাখুন (গায়ে পর্যাপ্ত শীতের কাপড় থাকলেও)। ♦ ঠাণ্ডা বাতাস, ঠাণ্ডা পানি ও ঠাণ্ডা খাবার এড়িয়ে চলুন। ♦ স্যাঁতসেঁতে বা ঘিঞ্জি পরিবেশ এড়িয়ে চলুন। অতিরিক্ত গরম বা ঠাণ্ডা পরিবেশ নয়। ♦ পুরনো জামাকাপড় ধুয়ে ভালো করে রোদে শুকিয়ে ব্যবহার করুন। ♦ ডাস্ট মাইট কমানোর জন্য ব্যবহৃত বালিশ, তোশক, ম্যাট্রেস ইত্যাদির ধুলাবালু নিয়মিত পরিষ্কার করুন এবং রোদে দিন। ♦ মশার কয়েল বা স্প্রে, চুলার আগুনের ধোঁয়া থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন। ♦ হাত-মুখ নিয়মিত ধৌত করুন। কারোর সঙ্গে করমর্দন করলেও হাত ধুয়ে ফেলুন। নচেৎ চোখ, নাক বা মুখ স্পর্শ করার সময় শরীরে নানা জীবাণু ঢুকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ♦ রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় সম্ভব হলে মুখে মাস্ক ব্যবহার করুন। ♦ ঠাণ্ডার সময় খালি পায়ে হাঁটবেন না, সব সময় জুতা-মোজা ব্যবহার করুন। ♦ বাড়িতে থাকা পোষা প্রাণী বিশেষ করে কুকুর, বিড়াল থেকে দূরে থাকুন। শোবার ঘর থেকে তাদের নিরাপদ দূরত্বে রাখুন। ♦ অন্যান্য অসুস্থ মানুষ থেকে দূরে থাকুন। ♦ অগ্নিকুণ্ড থেকে যথা সম্ভব দূরে থাকুন। ♦ ঘরের ভেতর কয়েল, ধূপ, আতর, সেন্ট, পারফিউম ব্যবহার করবেন না। ♦ কাশি, শ্বাসকষ্ট, বুকে টান, বুকে শব্দ বোধ হলে চিকিৎসকের পরামর্শে উপশমকারী ওষুধ ব্যবহার করুন। ♦ সতর্কতা হিসেবে সব সময় হাতের কাছেই ইনহেলার রাখুন। একটু ভালো মনে করলে নিজে নিজেই ওষুধ কমিয়ে দিতে পারবেন, তবে একেবারে বন্ধ করা যাবে না।

লেখক : ডা. এস এম রওশন আলম কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান  রংপুর মেডিক্যাল কলেজ।

news24bd.tv/health