নারীরা হয়ে উঠছেন যেন একেকটা বাতিঘর

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পূর্ণ হচ্ছে আগামী ২৬ মার্চ। স্বাধীনতার শুরুতে পশ্চাৎপদ নারীরা ৫৩ বছরে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছে। লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ সূচকে বাংলাদেশের স্থান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার শীর্ষে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নীতিনির্ধারণ, রাজনৈতিক তৎপরতা, প্রশাসন, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, মহাকাশ গবেষণা, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে এমনকি একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ডিজিটাল বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে নারীকে।  

প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগেও নারীর পদচারণা গত ৫৩ বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।  সহস্রাধিক নারী সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে দায়িত্ব পালন করেছেন।  নারীরা প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিচারপতি, সচিব, ডেপুটি গভর্নর, রাষ্ট্রদূত, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপারসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন।  নিজেদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে এই নারীরা তাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।  পুরুষের পাশাপাশি এই নারীরাই ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে নেতৃত্বে দেবে।

রাজনীতিতে নারী নেতৃত্ব 

নব্বইয়ের দশক থেকে নারী প্রধানমন্ত্রীরাই দেশ শাসন করে চলেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের স্পিকার, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ অনেকেই নারী। সংসদে নারীদের জন্য ৫০টি সংরক্ষিত আসন রয়েছে। আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারী নেতৃত্ব ২৬ শতাংশ। ২০৩০ সালের মধ্যে নারী নেতৃত্ব ৩৩ শতাংশ পূরণের লক্ষ্যে কাজ করছে দেলটি। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এ দেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ উপমহাদেশের রাজনীতিতে অনেকটা বিস্ময়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী

নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্লোবাল উইমেন্স লিডারশিপ, প্লানেট ফিফটি ফিফটি চ্যাম্পিয়ন, এজেন্ট অব চেঞ্জ, ইউনেস্কোর শান্তি বৃক্ষ পুরস্কার, জাতিসংঘের সাউথ সাউথ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন অফ স্কিল ডেভেলপমেন্ট’, ‘এসডিজি প্রোগ্রেস অ্যাওয়ার্ড ২০২১’, ‘মুকুটমণি ২০২১’ এবং তথ্যপ্রযুক্তির অলিম্পিক খ্যাত উইটসা ২০২১ -সহ নানা সম্মাননা অর্জন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, দর্শন, মানবিকতা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত ও সমাদৃত হচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে একজন সফল নারী রাষ্ট্রনায়কের নেতৃত্বে ‘সরকার প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১’ প্রণয়ন করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভীঘাত থেকে প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে জাতি যেন সুরক্ষা লাভ করে এবং উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারে, সেজন্য ‘ডেল্টা-প্ল্যান- ২১০০’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ দেশের সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্নদ্রষ্টা প্রধানমন্ত্রীর সঠিক দিকনির্দেশনায় অর্থনৈতিক সূচকে দেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।

পুলিশে নারী

১৯৭৪ সালে মাত্র ১৪ জন কনস্টেবল ও উপ-পরিদর্শক (এসআই) নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশে নারীর যাত্রা শুরু। সময়ের পরিবর্তনে ২০২৩ সালে এসে সেই সংখ্যা ১৮ হাজারের বেশি। নারী পুলিশ সদস্যরা এখন দায়িত্ব পালন করছেন উচ্চ পর্যায়েও। এই মুহূর্তে উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হিসাবে কর্মরত আছেন বেশ কয়েকজন। অতীতে অলংকৃত করেছেন অতিরিক্ত মহাপরিদর্শকের পদও।

দায়িত্ব পালনে কয়েকজন নারী পুলিশ সদস্য

জানা যায়, জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এর কলা সেবা সেন্টারের ৮০ ভাগ সদস্যই নারী পুলিশ। সারা দেশের ৯টি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার এবং ৫৫৯টি থানার বেশিরভাগ নারী ও শিশু ডেস্ক পরিচালনা করছেন পুলিশের নারী সদস্যরা। এপিবিএন-১১-তে কর্মরত পুলিশের সব সদস্যই নারী। এই মুহূর্তে দুটি জেলার এসপি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন নারী। এদের মধ্যে গোপালগঞ্জে আয়েশা সিদ্দিকা এবং নড়াইলে সাদিরা খাতুন দায়িত্ব পালন করছেন। বিভিন্ন থানায় ওসি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন নারী সদস্যরা। ২০১০ সাল থেকে কঙ্গোতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশন পরিচালনা করছেন বাংলাদেশের নারী পুলিশ। এখানে এ পর্যন্ত এক হাজার ৪৫১ জন নারী পুলিশ কাজ করেছেন।  

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানায়, পুলিশে মোট জনবল প্রায় দুই লাখ। এর মধ্যে ডিআইজি থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত ১৮ হাজার ৩৮০ নারী সদস্য রয়েছেন। চারজন ডিআইজি ছাড়াও বর্তমানে অতিরিক্ত ডিআইজি পদে ১৯ জন, পুলিশ সুপার পদে ৬৯ জন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে ১২২ জন, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার পদে ৯৮ জন এবং সহকারী পুলিশ সুপার পদে ১৫৯ জন ক্যাডার কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন।  

ক্রীড়াঙ্গনে নারী

স্বাধীনতার পর সময় যত গড়িয়েছে রক্ষণশীল মনোভাব ভেঙে তত সামনের দিকে এগিয়েছে বাংলাদেশের নারীরা। তারা ক্রীড়াঙ্গনে দেশে বিদেশে নানা প্রতিযোগিতামূলক ইভেন্টে অংশ নিয়ে সফলতার সাক্ষর রেখেছেন। বিশেষ করে ক্রিকেট ও ফুটবলে বাংলাদেশের নারী দলের অবদান চোখে পড়ার মতো।  

এশিয়া কাপ জয়ের পর বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল

২০২২ সালে নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে বিশ্বকাপে প্রথমবার অংশ নেন বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দল। এর আগে ২০১৮ সালে এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা অর্জন করে নারী ক্রিকেট দল। এই আসরে তিন-তিনবার বাংলাদেশ পুরুষ দল অংশ নিলেও শিরোপা অর্জন করতে পারেনি। সেই মুকুট এসেছিল সালমা-রুমানাদের ‘টাইগ্রেস বাহিনীর’ হাত ধরে। ব্যাট-বলের লড়াইয়ে ছেলেদের পারফরমেন্সের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নারী দল।  

১২ বছর আগে ব্যাংককে থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা পড়ে এ দেশের নারী ক্রিকেট দলের। প্রথম দুই ম্যাচেই জয়ের তৃপ্তি নিয়ে টাইগ্রেস বাহিনী সেবছরই এসিসি নারী টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে জিতে নেয় শিরোপা। এরপর ২০১১ সালে কোচ মমতা মাবেনের অধীনে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অর্জন করে টাইগ্রেসরা। সেবার নিজেদের মাটিতে আয়োজিত নারী বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব ৫ম স্থানে থেকে শেষ করলেও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাওয়া ৯ উইকেটের জয়ের মধ্য দিয়ে নেদারল্যান্ডসকে হটিয়ে বাংলাদেশ দল প্রথমবারের মতো লাভ করে ওয়ানডে স্ট্যাটাস।  এশিয়ান গেমসেও সাফল্যের ভারী পাল্লা রয়েছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের। ২০১০ ও ২০১৪ আসরে তাঁদের ঝুলিতে গেছে রৌপ্যপদক।

বাংলাদেশের নারী ফুটবলের অর্জনের তালিকাটা দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে। বয়সভিত্তিক ফুটবলে বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা অপ্রতিরোধ্য।  বাংলাদেশের নারী ফুটবল মানেই যেন ঝুলিভরা অর্জন। এর আগে নেপালকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরে দেশে বীরদর্পে ফেরে জাতীয় নারী ফুটবল দল। দেশের মাটিতে সাফ অনূর্ধ্ব-২০ নারী চ্যাম্পিয়নশিপেও বাংলার বাঘিনীদের জয়জয়কার।  

২০২৩ সালে সাফ অনুর্ধ্ব-২০ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে নেপালকে ৩-০ গোলে হারিয়ে অপরাজিত থেকে শিরোপা জয় করে বাংলাদেশের বয়স ভিত্তিক দলটি। এর আগে নেপালের দশরথ রঙ্গশালায় নেপালকে হারিয়ে সিনিয়র বিভাগের শিরোপা ঘরে তোলে সাবিনা খাতুনের দল।  

২০২৩ সালে সাফ অনুর্ধ্ব-২০ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের পর বাংলাদেশ নারী দল

নারী ফুটবলে অর্জনের শুরুটা হয়েছিল ২০১৫-তে। নেপালে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ নারী রিজিওনাল চ্যাম্পিয়নশিপে সেবার অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। এরপর ২০১৬-তেও একই আসরে তাজিকিস্তানে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় লাল-সবুজের দল।

২০১৭ সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতকে ১-০ গোলে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। এর পরের তিন আসরে অবশ্য ফাইনালে গিয়েও খালিহাতে ফিরে আসতে হয়েছে লাল-সবুজদের। ভারতের কাছে দুবার এবং নেপালের কাছে একবার হেরে শিরোপাবঞ্চিত হয় বাংলাদেশ।

২০১৭-তে ভারতে অনুষ্ঠিত সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে স্বাগতিকদের কাছে হেরে শিরোপা হাতছাড়া হয় বাংলাদেশের। তবে বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে যে বাংলাদেশ সেরা, তা আরো একবার তারা প্রমাণ করেছে নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে। স্বাগতিকদের হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলার বাঘিনীরা। এরপর সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপেও ভারতকে হারিয়ে শিরোপার স্বাদ পায় ছোটনের দল।

টেবিল টেনিসের রাজকন্যা জোবেরা রহমান লিনু

গিনেস বুক অব রেকর্ডসে টেনিসের রাজকন্যা

জোবেরা রহমান লিনুকে বলা হয় দেশের টেবিল টেনিসের রাজকন্যা। এই কিংবন্তি টানা জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়ে নাম লিখিয়েছিলেন গিনেস বুক অব রেকর্ডসে। তিনি ১৬ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের কোনো নারীরই টানা ১৬ বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড নেই লিনু ছাড়া। ২০০১ সালে তিনি জিতেছিলেন ১৬ তম শিরোপা। গিনেস বুক অব রেকর্ডসে তার নাম উঠেছিল ২০০২ সালে।

প্রথম আন্তর্জাতিক স্বর্ণ জয়ী নারী

বাংলাদেশের প্রথম নারী হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন শ্যুটার কাজী শাহানা পারভীন। ১৯৯১ সালে কলম্বো এসএ গেমসে (তৎকালীন সাফ গেমস) পদক জিতেছিলেন এই তারকা নারী শ্যুটার। ওইবারই প্রথম এসএ গেমসে শ্যুটিং অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এই শ্যুটিংয়েই বাংলাদেশ বেশি পদক পেয়েছে এসএ গেমস থেকে।

নারী শিক্ষা

স্বাধীনতার পর নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি চোখে পড়ার মতো। শিক্ষা অধিদপ্তরের ‘অ্যানুয়াল রিপোর্ট অন পাবলিক ইন্সট্রাকশন ফর দ্য ইয়ার ১৯৭০-৭১’ প্রতিবেদন অনুসারে, তখন দেশের মোট শিক্ষার্থীর ২৮ শতাংশের কিছু বেশি ছিল ছাত্রী। সরকারের শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রীর হার প্রায় ৫১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকেও প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ছাত্রী। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মেয়েদের হার কিছুটা কম, ৩৮ শতাংশ।  

সরকারি প্রতিবেদন, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মতে, সরকারি সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি, অভিভাবকদের সচেতনতা এবং শিক্ষার মর্যাদা উপলব্ধি থেকে শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণের হার দিন দিন বাড়ছে।

কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী

‘অ্যানুয়াল রিপোর্ট অন পাবলিক ইন্সট্রাকশন ফর দ্য ইয়ার ১৯৭০-৭১’ প্রতিবেদন অনুসারে, ওই সময় দেশে মোট শিক্ষার্থীর ২৮.৪ শতাংশ ছিল মেয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ১৮৮টি অনুমোদিত ডিগ্রি কলেজে ৯ শতাংশের বেশি এবং তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩ শতাংশের মতো ছাত্রী ছিলেন। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ হাজার ৯৪৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে নারী ছিলেন ১ হাজার ২৯৪ জন। তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (এখন বুয়েট) ১ হাজার ৭১৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ছিলেন ১২ জন। ময়মনসিংহে অবস্থিত একমাত্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ হাজার ৭৮১ শিক্ষার্থীর মধ্যে কোনো ছাত্রীর তথ্য নেই প্রতিবেদনে। ১০টি আইন কলেজ ও দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ৩ হাজার ৭১৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ৩৬ জন, সরকারি তিব্বিয়া কলেজসহ ৯টি মেডিকেল কলেজে ৩ হাজার ৩৪৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ছিলেন ৬১১ জন। ২টি কমার্স কলেজ ও ৫টি কমার্শিয়াল স্কুলে ৪ হাজার ৩১ জনের মধ্যে ছাত্রী ৫৫ জন, চিত্রাঙ্কন ও হস্তশিল্পের ১টি কলেজ ও ২টি স্কুলে ২৯৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ছিল ৮৭ জন। ৬ হাজার ১৪৭টি সরকারি ও বেসরকারি সিনিয়র মাদ্রাসা, জুনিয়র মাদ্রাসা, হাফিজিয়া ও ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় ৭ লাখের বেশি শিক্ষার্থী থাকলেও ছাত্রীর সংখ্যা কত ছিল, সে তথ্য দেওয়া নেই প্রতিবেদনে।  

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নকালে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্পের অধীনে ১৯৮১ সালে প্রথম প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর গঠন করা হয়। এরপর ১৯৯২ সালে এটি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ এবং ২০০৩ সালে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় হিসেবে গড়ে ওঠে। ২০০৩ সালে প্রাথমিকে মেয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ছিল ৪৯ শতাংশ। মাধ্যমিকে গ্রামীণ পর্যায়ে প্রায় ৫৪ এবং শহরাঞ্চলে এ হার ৫১ শতাংশের কিছু বেশি ছিল।

২০১৫ সালে পেশাদারি শিক্ষায় ৩৯, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে (১৬২টি) ৪৩, দাখিলে ৫৯, আলিমে ৫৪ শতাংশের বেশি এবং কারিগরি শিক্ষায় মেয়ে শিক্ষার্থীর হার ছিল প্রায় ২৪ শতাংশ।

ব্যানবেইসের সর্বশেষ ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, ১৩ ধরনের পেশাগত শিক্ষায় ৫৪, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক (ভকেশনাল) শিক্ষায় ২৫ শতাংশের কিছু বেশি, ইংরেজি মাধ্যমে স্কুলে (১৪৫টি) প্রায় ৪৪ এবং দাখিলে ৬০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী মেয়ে।

ব্যানবেইসের ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৮ বছরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে মেয়েদের পাসের হার আড়াই গুণ বেড়েছে। ১৯৯০ সালে ৩০ শতাংশ মেয়ে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় পাস করেছিল। ২০১৯ সালে পাস করেছে ৮৩ শতাংশের বেশি মেয়ে। ১৯৯০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় পাস করেছিল ৩১ শতাংশ মেয়ে। আর ২০১৯ সালে পাস করেছে প্রায় ৭৫ শতাংশ মেয়ে।

ছেলেমেয়েদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হারও দিন দিন কমছে। ২০০৫ সালে ৪৭, ২০১০ সালে প্রায় ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। ২০১৯ সালে এ হার নেমে এসেছে প্রায় ১৮ শতাংশে।  

পোশাক শিল্পে নারী

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশে তৈরি পোশাক খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপিতে এ খাতের অবদান ১১ শতাংশ এবং রপ্তানিতে অবদান ৮৪.৫ শতাংশ; যা প্রায় ৪ হাজার ৭০০ কোটি ডলারেরও বেশি (বিজেএমইএ, ২০২২)। অপার সম্ভাবনার এই  খাতকে এগিয়ে নিচ্ছে নারী কর্মীরা। এ খাতে প্রায় ৪০ লাখ নারী কর্মী রয়েছেন।  

এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন বিজিএমইএ তালিকাভুক্ত ১৭৩টি গার্মেন্টস কারখানার ১ হাজার ২০৪ জন শ্রমিকের ওপর জরিপ চালিয়েছে। তারা বলছে, এসব কারখানায় গড়ে শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৯৫০ জন। সোয়েটার কারখানা, নিটওয়্যার কারখানা এবং অন্যান্য কারখানায় পুরুষ ও নারী কর্মচারীর অনুপাত ছিল যথাক্রমে ৪৬:৫৪, ৪২:৫৮ ও ৩০:৭০।

মেট্রোরেলের প্রথম চালক নারী

আওয়ামী সরকারের নেওয়া বিভিন্ন যুগান্তকারী উদ্যোগের মধ্য অন্যতম রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ। ২০২২ সালের ডিসেম্বর চালু হয় বহুল কাঙ্ক্ষিত মেট্রোরেল। এই মেট্রোরেলের প্রথম চালক ছিলেন মরিয়ম আফিজা। মরিয়ম আফিজা নোবিপ্রবি থেকে কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেন। মেট্রোরেলের মতো একটা স্থাপনার প্রথম চালক হিসেবে আফিজার উপস্থিতিকে নারী অগ্রগায়নকে আরও স্পষ্ট করে।

দেশের প্রথম নারী পাইলট রোকসানা

দেশে নারীরা বিমান চালাবে- এমনটা ভাবা যেত না স্বাধীনতার প্রাক্কালে। কিন্তু বাংলাদেশেই ১৯৭৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম নারী পাইলট হিসেবে নিয়োগপত্র পান সৈয়দা কানিজ ফাতেমা রোকসানা। ১৯৫৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জন্ম রোকসানার। সে সময় সমাজ ছিল রক্ষণশীল। সেখান থেকে স্বপ্ন দেখেছিলেন রোকসানা। রক্ষণশীলতা ভেঙে স্বাধীনতার মাত্র ৮ বছরের মাথায় পাইলট হিসেবে আকাশে ওড়েন তিনি।

ট্রেন চালক নারী

সালমা খাতুন (জন্ম: ১ জুন, ১৯৮৩) বাংলাদেশের প্রথম নারী ট্রেন চালক। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ রেলওয়েতে সহকারী চালক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তিনি দেশের প্রথম নারী হিসেবে ট্রেন চালনা পেশায় আসেন।

কূটনীতিতে ৯ নারী

কূটনীতিতেও পিছিয়ে নেই নারীরা। বিশ্বের ৯টি দেশে বাংলাদেশ মিশনের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তারা।  বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে প্রতিনিধিত্ব করছেন এখন ৯ জন নারী কূটনীতিক। জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রাবাব ফাতিমা। যুক্তরাজ্যে হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সাঈদা মুনা তাসনীম। মেক্সিকোতে রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম, মরিশাসে হাইকমিশনার রেজিনা আহমেদ, ব্রুনাইয়ে হাইকমিশনার নাহিদা রহমান সুমনা, ভিয়েতনামে রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ, পোল্যান্ডে রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা রহমান, জর্ডানে রাষ্ট্রদূত নাহিদা সোবহান ও ব্রাজিলে সাদিয়া ফয়জুননেসা। এছাড়াও মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মাশফি বিনতে শামস। ১৯৭৯ সাল থেকে বাংলাদেশের নারীরা পেশাদার কূটনীতিক হিসেবে কাজ শুরু করেন । সে সময় ফরেন সার্ভিসে প্রথম নারী কূটনীতিক হিসেবে যোগ দেন নাসিম ফেরদৌস। তবে বাংলাদেশে প্রথম নারী রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মাহমুদা হক চৌধুরী।  

বিজ্ঞানে ২ নারী

এশিয়ার সেরা ১০০ বিজ্ঞানীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের দুই নারী। সিঙ্গাপুরভিত্তিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সাময়িকী ‘এশিয়ান সায়েন্টিস্ট’ এ তালিকা তৈরি করেছে।

তালিকায় স্থান পাওয়া দুই বাংলাদেশি নারী বিজ্ঞানী হলেন-বাংলাদেশের চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) পরিচালক ও বিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গাওসিয়া ওয়াহিদুন্নেছা চৌধুরী।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অবদানে নারী

২০২৩ সালে  কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বিশ্বসেরা ১০০ জনের নাম ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রভাবশালী ম্যাগাজিন টাইম। এই তালিকায় স্থান পান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ড. রুম্মান চৌধুরী। তিনি ডেটা সায়েন্স ও সোশ্যাল সায়েন্সের সমন্বয়ে ‘অ্যাপ্লাইড অ্যালগরিদমিক এথিকস’ নিয়ে কাজ করেন। রুম্মান মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নৈতিকতা ও মেশিন লার্নিং বিষয়ে গবেষণার কাজ করেন।  

বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী নারীদের একজন

জান্নাতুল ফেরদৌস আইভি এ বছর বিবিসির তালিকাভুক্ত বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী নারীদের একজন নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি একাধারে চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও মানবাধিকারকর্মী। এক অগ্নিদুর্ঘটনায় তাঁর শরীরের ৬০ শতাংশ পুড়ে যায়। এই মর্মান্তিক ঘটনা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে তিনি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও অধিকারকর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। আইভি ‘ভয়েস অ্যান্ড ভিউস’ নামে একটি মানবাধিকার সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। সংস্থাটি অগ্নিদুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরে আসা নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে। এ পর্যন্ত ৫টি শর্টফিল্ম নির্মাণ করেন তিনি। এ ছাড়া তাঁর লেখা ৩টি উপন্যাসও প্রকাশিত হয়েছে।

ভবন নকশায় নারী 

নাজলী হোসেন বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব ভবন নকশার পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত। ২০২৩ সালে এশিয়ার শীর্ষ ১০ নারী স্থপতির তালিকায় স্থান পান তিনি। গত ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় পত্রিকা ‘উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউর ইন্ডিয়া’ এই সম্মাননা দেয়।

news24bd.tv/আইএএম