ভারসাম্যপূর্ণ ও বৈচিত্রপূর্ণ দেখতে চায় ভারত

বৈশ্বিক জিডিপির ৬০ শতাংই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের: শ্রিংলা

করোনা পরবর্তী বিশ্বে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সম্মৃদ্ধি ফিরিয়ে আনতে ইন্দো-প্যাসিফিক’ অঞ্চল ঘিরে সব দেশের অংশগ্রহণ চায় ভারত। সম্প্রতি লন্ডনে ‘পলিসি এক্সেঞ্জ’ গবেষণা কেন্দ্রে দেয়া এক বক্তব্যে ভারতের এমন অবস্থান তুলে ধরেন দেশটির পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে নিজেদের লক্ষ উদ্দেশ্য ও বিস্তর পরিকল্পনা তুলে ধরেন।   

ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের বক্তব্য অনুযায়ী, বহু বছর আগেই ভারতের পররাষ্ট্র নীতিতে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ শব্দটি জায়গা করে নিয়েছে। লিখিত বক্তব্যে শ্রিংলা বলেন, একজন ভারতীয় সমুদ্র গবেষক প্রথম নব্বইয়ের দশকে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগর ধারনাটির সূচনা করেন যেটি সাম্প্রতিককালে ভৌগলিক অভিধানে ‘ইন্দো প্যাসিফিক’ টার্ম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এটি মূলত শেষ এক দশকে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি লাভ করেছে।  

ভারত তার একাধিক অংশীদার দেশগুলোর সাথে যৌথ বিবৃতিতে এই ‘টার্ম’ বা ধারনাটি ব্যবহার করেছে। শ্রিংলা বলেন, শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সীমাবদ্ধ না রেখে অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, জাপান এবং অবশ্যই যুক্তরাজ্যকে এর সাথে সম্পৃক্ত করেছে ভারত। তিনি বলেন, এই অঞ্চলকে গুরুত্ব দিয়েই আমাদের মন্ত্রণালয়ে সম্প্রতি ইন্দো-প্যাসিফিক বিভাগ এবং সমুদ্র বিভাগ খোলা হয়েছে।

শ্রিংলা বলেন, ভারত কেবল ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ ধারনাকে মূলধারায় নিয়ে আসেনি। আরো সুনিদ্দিষ্ট করে বলতে গেলে, এটি অন্যদেরকে এই অঞ্চল সম্পর্কে সম্পর্ণভাবে বোঝার জন্য উৎসাহিত করেছে। ভারতের কাছে, ইন্দো-প্রশান্ত মহসাগর এমন এক বিশাল সমুদ্রসীমা যা উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূল থেকে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল পর্যন্ত প্রসারিত। তিনি বলেন, আজ আমাদের সাথে আরও অনেক অনেক দেশ এই ইন্দো-প্যাসিফিক ধারনার সাথে যুক্ত হচ্ছে।

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, স্নায়ুযুদ্ধের সময় ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরকে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছিলে। নানা রকম ধ্যান ধারনা ও সামরিক ব্লকে সজ্জিত করা হয়েছিল এবং এই ‘ব্লক’ চিন্তার অধীনস্থ করা হয়েছিল। ভারতবর্ষ এটি তখন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলো না।

তিনি বলেন, বৌদ্ধ ধর্মের মতোই ভারতের বিখ্যাত ধর্মীয়-ঐতিহ্যগুলো ইন্দো-প্রশান্ত মহসাগর দিয়ে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে গেছে। প্রাচীন-চিত্তাকর্ষক অনেক হিন্দু মন্দির-ই ভিয়াতনামে দেখা যায়।    

এক হাজার বছর আগে সুমাত্রা, পূর্ব চীন, আব্বাসী সম্রাজ্য(বর্তমান ইরাক)সহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে ভারতীয় উপকূল থেকে বাণিজ্য জাহাজ প্রেরণের ইতিহাস তুলে ধরেন শ্রিংলা। বলেন, এই অভিজ্ঞতাগুলোই আমাদের অতীত, আমাদের ভবিষ্যত; এই অভিজ্ঞতাগুলোই ইন্দো-প্যাসিফিক সম্পর্কে আমাদের ধারণা নির্ধারণ করে দিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ঘনিষ্ট দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্য নিশ্চয়ই আমাদের প্রশংসা করবে।

বাংলাদেশের নিযুক্ত ভারতের সাবেক এই হাই কমিশনার বলেন, একবিংশ শতাব্দীতে এসে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের আন্তঃসংযুক্ততা পুরোপুরি কাজ করতে চলেছে। এর পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও এই অঞ্চলের সার্বিক কল্যাণ।

শ্রিংলা বলেন, মোট বিশ্ব বানিজ্যের আনুমানিক ৬৫ শতাংশ-ই গোটা ইন্দো-প্যাসিফিক মহাসাগর ঘিরে। সে হিসেবে বৈশ্বিক জিডিপির ৬০ শতাংশ অবদান রাখছে এই অঞ্চল। তিনি আরো বলেন, ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ হয় পানি পথে। আমাদের মতোই অন্য অনেকেরই আটলান্টিক থেকে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় পথটি অত্যন্ত কার্যকরী। তাছাড়া চীনের উত্থান এবং সেই সাথে বৈশ্বিক ভারসাম্যতা পুনরুদ্ধারের আবশ্যিকতা এই অঞ্চলের কৌশলের সাথে যুক্ত হয়েছে।

তিনি জানান, ভারতের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথম ২০১৮ সালে সিঙ্গাপুরে ‘সাগর’ মতবাদ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি এই মতবাদকে সংক্ষেপে এই অঞ্চলের সবার জন্য ‘সুরক্ষা ও প্রবৃদ্ধি’ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। এটি মূলত পুরো অঞ্চলের সাপ্লাই চেইন বা সরবরাহ ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত করা, একক কোন দেশের উপর একচেটিয়া নির্ভরতা না এবং সংশ্লিষ্ট সব দেশগুলোর সম্মৃদ্ধি নিশ্চিত করা।

ভিারতের পররাষ্ট্র সচিব জানান, ২০১৯ সালে ব্যাংককে ইস্ট-এশয়ান সামিটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘সাগর’ মতবাদকে আরো খানিকটা এগিয়ে নেন এবং ‘ইন্দো-প্যাসিফিক মহাসাগরীয় উদ্যোগ’ ঘোষণা করেন। উদ্যোগ শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে ভারত একটি বিধি-ভিত্তিক আঞ্চলিক স্থাপত্য গড়ে তোলার পরিকল্পনা করে যেদি মূলত সাতটি স্তম্ভের উপর নির্মিত হবে।

আর সেগুলো হলো- সমুদ্রসীমা সুরক্ষা; সমুদ্র পরিবেশ; সমুদ্র সম্পদ; সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ভাগাভাগি; দুর্যোগ ঝূঁকি কমানো ও মোকাবিলা; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা; বাণিজ্য কানেক্টিভিটি এবং সমুদ্রপথে পরিবহন।

তিনি বলেন, ভারত এই মৌলিক নীতিগুলো ধরে কাজ করেছে। জাহাজ চলাচলে স্বাধীনতা ও সুরক্ষা আরো শক্তিশালি করার চেষ্টা করেছে। যেমন- এডেন উপসাগরে পাইরেসি বিরোধী অভিযান বা শান্তিরক্ষা প্রচেষ্টা। তিনি বলেন, যতটা পারা যায় এই অঞ্চলের সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে আমরা প্রশিক্ষণ, যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য উপাদান সরবরাহ করছি। গত ছয় বছরে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, মায়ানমার, মরিশাস এবং সিশেলস-এ উপকূল নজরদারির জন্য রাডার সিস্টেম সরবরাহ করেছে ভারত। এই দেশগুলো ছাড়াও মোজাম্বিক এবং তানজানিয়া ভারতীয় টহল নৌকা ব্যবহার করে।

শ্রিংলা বলেন, আমদের প্রতিরক্ষা প্রশিক্ষণ কর্মসূচীও বেড়েছে। এগারোটি দেশে পাঠানো হয়েছে ভ্রাম্মমাণ প্রশিক্ষক দল। ভিয়েতনাম থেকে সাউথ আফ্রিকা এবং প্রতিবেশী বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও শ্রিংলংকায় কাজ করেছে তারা।     ‘মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগকালে ত্রাণ বিতরন’ (এইচএডিআর) ক্ষেত্রেও শুধু সক্ষমতা তৈরি করেনি ভারত, নিজেকে সহজাত এবং স্বভাবজাত বন্ধু হিসবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেন, এ বছর শুরুতে যখন কোভিড-১৯ হানা দিলো, তখন ভারত তার বন্ধুদেশগুলোকে যতখানি সম্ভব সাহায্য করেছে। কুয়েত, মালদ্বীপসহ বিভিন্ন দেশের অনুরোধে দ্রুত ও তাঃক্ষণিক মেডিকেল টিম পাঠানো হয়েছে। লকডাউনের মধ্যেও মরিশাস, সিশেলস, মাদাগাস্কার এবং কমোরাসের মতো দ্বীপরাষ্ট্র গুলোর জন্য উপসাগরীয় অঞ্চলে খাদ্য সরবরাহ প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রেখেছে ভারত সরকার।

দীর্ঘ বক্তব্যে শিংলা উল্লেখ করেন, ভারত এই অঞ্চলের যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সম্মৃদ্ধি এবং সরবরাহ প্রক্রিয়ার উন্নয়নে কাজ করেছে। সব সময় প্রাধান্য দিয়েছে এই অঞ্চলেরর মানুষের প্রয়োজনীয়তা, ন্যায়বিচার, টেকশই পরিবেশ ও সামাজিক বাস্তবতাকে।

তিনি বলেন, আমাদের কোনভাবেই ভুলে যাওয়া উচিৎ না যে এই ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অনেক দেশ উপনিবেশিকতাবাদে ভুগেছে। আমাদের মাঝে তার কিছু দাগ এখনো থেকে গেছে যেটি মুছে ফেলা দরকার। আমরা যখন এগুলো নিয়ে কাজ করছি তখন আমারা এমন কিছু করবা যেটের মাধ্যমে নিজেদের উপর অন্যের নির্ভরশীলতা বা অপরিহার্যতা বা জিম্মি অবস্থা তৈরি না হয়।  

আমাদের এ ব্যাপারে বদ্ধপরিকর হওয়া দরকার। বিশেষ করে এই উদ্বেগগুলো এখন আরো প্রাসঙ্গিক; কারন, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল করোনা দুর্যোগকালে বা পরবর্তীতে সরবরাহ চেইন স্বাভাবিক বা স্থিতিশীল এবং বৈচিত্রপূর্ণ রাখতে চায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- জাপান ও অস্ট্রেলিয়ান বন্ধুদের সাথে যেভাবে এই অঞ্চল ‘সাপ্লাই চেইন রেজিলিয়েন্স ইনিশিয়েটিভ’ নিয়ে কাজ করছে।

শ্রিংলা বলেন, ভারত সব অংশীদার দেশগুলোর সাথে অংশীদারিত্ব তৈরি করেছে। এটি একটি বিস্তৃত সংস্কার, যেটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে পশ্চিম ভারত মহাসাগর হয়ে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত।

ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে তৈরি ‘কোয়াড’ এর মতো বিভিন্ন আঞ্চলিক ও বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর নেটওয়ার্কের কার্যকর ভুমিকা তুলে ধরেন শ্রিংলা।

লিখিত বক্তব্যে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সবশেষে বলেন, আশা করি, আমাদের তালিকায় পরবর্তী দেশ হবে যুক্তরাজ্য এবং শিগগির তারা তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল চূড়ান্ত করবে। তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি, বৈশিষ্ট এবং ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা দিয়ে তৈরি কৌশল ভারতের নিজস্ব এবং দীর্ঘস্থায়ী ইন্দো-প্যাসিফিক লক্ষের মতোই হবে।

news24bd.tv কামরুল