'দ্রুত চিকিৎসায় স্ট্রোক রোগীকে বাঁচানো সম্ভব'

সংগৃহীত ছবি

'দ্রুত চিকিৎসায় স্ট্রোক রোগীকে বাঁচানো সম্ভব'

অনলাইন ডেস্ক

উচ্চ রক্তচাপ, বহুমূত্র রোগ বা ডায়াবেটিস, অস্বাস্থ্যকার জীবনযাপনের কারণে স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। দেশের প্রতি চারজনের একজন স্ট্রোকের ঝুঁকিতে। বছরে প্রায় ২০ লাখ মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে। পঙ্গুত্বের অন্যতম প্রধান কারণ স্ট্রোক।

অথচ আক্রান্ত হওয়ার পর সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা শুরু করা গেলে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব। পঙ্গুত্ব্বের ঝুঁকিও কমানো সম্ভব।

কালের কণ্ঠ ও ইউনাইটেড হসপিটাল আয়োজিত ‘জরুরি স্ট্রোক ব্যবস্থাপনা: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন বক্তারা।

কালের কণ্ঠের সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে ইউনাইটেড হাসপাতাল লিমিটেডের স্ট্রোক সেন্টারের সমন্বয়ক এস এম সাদলী।

এস এম সাদলী বলেন, বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ স্ট্রোকের আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ৫৫ লাখ লোক প্রতিবছর স্ট্রোকের কারণে মারা যাচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী ২৫ বছরের বেশি বয়সী ৪ জনের মধ্যে ১ জন তাদের জীবদ্দশায় স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তার ডায়াবেটিস না থাকলেও বা হাইপারটেশন না থাকলেও। স্ট্রোক যে কোনো বয়সের মানুষের হতে পারে।

এস এম সাদলী বলেন, আমাদের একটা ভ্রান্ত ধারণা থাকে, শুধুমাত্র বয়স্ক মানুষদের স্ট্রোক হয়। তা ঠিক নয়। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। স্ট্রোক হতে পারে দুইভাবে। মস্তিকের রক্তনালি যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সে জায়গায় রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। এটাকে বলা হয় ইস্কেমিক স্ট্রোক, যা মোট স্ট্রোকের ৮৫ শতাংশ। আরেকটা হলো হেমোরেজিক স্ট্রোক যা মোট স্ট্রোকের ১৫ শতাংশ। মস্তিকের রক্তনালি কোনো কারণে ছিঁড়ে রক্তক্ষরণ হবে আমাদের ব্রেইনে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব এ এম পারভেজ রহিম বলেন, সারা দেশের মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে তিনভাবে কাজ করে থাকে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবায় দেশের প্রতিটি ওয়ার্ড পর্যায়ে ১৫ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক, ৬৪টি জেলায় জেলা হাসপাতাল ও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপনের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ রোগের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
 ইউনাইটেড হাসপাতাল লিমিটেডের আউটরিচ মার্কেটিং বিভাগের প্রধান মো. ফজলে রাব্বী খান বলেন, স্ট্রোক চিকিৎসায় ইউনাইটেড হাসপাতাল একটি পরিপূর্ণ সেবা চালু করতে যাচ্ছে। দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর অভিজ্ঞতা ও ব্যবস্থাপনা দেখেই স্ট্রোকের চিকিৎসায় একটি বড় উদ্যোগ নিয়েছে ইউনাইটেড হাসপাতাল। স্ট্রোকের সব ধরনের ডাক্তারি সুবিধা চালুর পাশাপাশি স্বল্প ব্যয়ে চিকিৎসা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এই বিভাগ চালু করেছে।  

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু নাসের রিজভী বলেন, ২৯শে অক্টোবর ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক ডে কে সামনে রেখে এ ধরনের আয়োজন সত্যিই প্রসংশনীয়। বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউরোসার্জনস থেকে প্রতিবছরই সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয। স্ট্রোকের প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় সচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমের বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও নেউরো স্পাইন সোসাইটি অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীকে সঠিক সময়ে নিয়ে আসা হলে দ্রুত সময়ে সে ভালো হয়ে যেতে পারে। চিকিৎসার পর এসব রোগীদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পুর্নবাসন প্রক্রিয়া। ৫৫ বছর পর ঝুঁকি বেশি হয় এবং প্রতি দশকে ঝুঁকি দ্বিগুণ বেড়ে যায়।

ইউনাইটেড হাসপাতাল লিমিটেডের কমিউনিকেশন এ্যান্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মাসুদ আহমেদ বলেন, স্ট্রোকের রোগীর চাপ কমাতে বেশি সচেতনতা প্রয়োজন। রোগীকে সময়ের মধ্যে আনা গেলে সুস্থভাবে সারিয়ে তোলা সম্ভব। আর সেই সময় হলো সাড়ে চার ঘণ্টা। সচেতনতা বৃদ্ধির এ জায়গাটায় তৈরি কাজ করতে হলে প্রাইভেট হাসপাতালের সঙ্গে সরকারি হাসপাতালে এগিয়ে আসতে হবে।  

ইউনাইটেড হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট আলীম আক্তার ভূঁঞা বলেন, সুগার কমে যাওয়া, ব্রেইন টিউমার হওয়া, ইনফেকশন হওয়া বা হঠাৎ শরীরের এক অংশ দুর্বল হয়ে যাওয়া-এ ধরনের বিভিন্ন রোগ যেটাকে স্ট্রোকের মতো মনে হয় কিন্তু আসলে স্ট্রোক না। এটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য রোগীকে হাসপাতালে আসতে হবে। প্যারালাইসিস হওয়া, হঠাৎ মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরানো, কথা বলতে সমস্যা হওয়া, শরীরের নিয়ন্ত্রণে সমস্যা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, হঠাৎ বমি হওয়া এসব স্ট্রোকের লক্ষণের মধ্যে রয়েছে। যখনি এ সমস্যাগুলো দেখা দেবে তখন দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে হবে।

ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক শিরাজী শাফিকুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। প্রতিটি ক্লিনিকে ৬ হাজার রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়। এসব ক্লিনিকে যদি উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের পরীক্ষা করা হয়, তাহলে এই রোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। খাদ্যাভাস পরিবর্তন, ওষুধ এবং জীবনযাত্রা পদ্ধতি পরিবর্তন করা সম্ভব হয় তাহলে ৭০ শতাংশ স্ট্রোকের রোগী কমানো সম্ভব।

গবেষণা দেখা দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ১১.৩৯ জন লোক স্ট্রোকে আক্রান্ত। ২০ লাখ মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত। ৬ বছরের ঊর্ধ্বে ৭ শতাংশ মানুষের স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়ছে। ৪০ বছরের ওপরের লোকদের আরো বেশি সাবধান করা। যে ৫ বা ১০ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা নিতে আসে তাদের কথা না ভেবে ৯৫ ভাগ স্ট্রোকের ঝুঁকিতে থাকাদের কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে চিকিৎসা দিতে হবে।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের নিউরোলজী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক  মো. ইব্রাহিম খলিল বলেন, স্ট্রোক বর্তমানে বিশ্বে পঙ্গুত্বের অন্যতম কারণ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। প্রতি চার জনে একজন মানুষের জীবনে একবার স্ট্রোকের ঝুঁকি থাকে। তাই আমাদের খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আনা জরুরি। সবজি, ফলমূল, নিরামিষ এবং মাছ খেতে হবে। লবণযুক্ত খাবার এবং লাল মাংস পরিহার করতে হবে। চর্বি জাতীয় খাবার বাদ দিতে হবে।  

ইউনাইটেড হাসপাতালের নিউরোসার্জারী বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ফজলে মাহমুদ বলেন, আমার কাছে মনে হয়, স্ট্রোক হয়ে যাওয়ার পর একজন মানুষের পুনর্বাসন (রিহ্যাব) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়ে তেমন একটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। যারা স্ট্রোক করে তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করছে।  

ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যাপক ডা. মালিহা হাকিম বলেন, প্রতি এক লাখের মধ্যে ১০.৭ জন নারীর স্ট্রোক করে থাকে। গর্ভকালীন সময়ে এক লাখে ৩০ জন নারী স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। স্বাভাবিক একজন নারী আর গর্বকালীন সময়ে নারীদের স্ট্রোকের ঝুঁকি ৩ শতাংশ বেড়ে যায়। কমিউনিটি পর্যায়ে যদি স্ট্রোকের প্রাথমিক ধারণা দেওয়া যায় তাহলে স্ট্রোক তবে এটি কমে আসবে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ির খাওয়ার কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি ৯ গুণ বেড়ে যায়। একই সময় উচ্চ রক্তচাপের কারণেও ঝুঁকি থাকে।  

বিএসএমএমইউর নিউরোসার্জারি অনুষদের ডীন ও বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউরোসার্জনস সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, আমরা কাউকে বোঝাতে পারছি না যে, স্ট্রোক একটি প্রাণঘাতী রোগ। স্ট্রোকের প্রাথমিক চিকিৎসার যে ব্যবস্থা হওয়া দরকার, সেটি হয়নি। তবে আসার কথা বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্যখাতের প্রতি সদিচ্ছা আছে।  

ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরোসায়েন্স এন্ড হাসপাতালের ক্লিনিকাল নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক  ডা. এম এস জহিরুল হক চৌধুরী বলেন, স্ট্রোকের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। গণমাধ্যমকে এসব বিষয়ে বেশি প্রচার করতে হবে। স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায় এবং স্ট্রোকের চিকিত্সা আছে। ফলমূল, শাক-সবজি শতকরা ৬০ শতাংশ ঝুঁকি কমাতে পারে। ৭০ শতাংশ মানুষ হাইফারটেনশনের কারণে স্ট্রোক করেছেন। এই ক্ষেত্রে ডায়বেটিস একটি বিরাট বিষয়। হতাশা, চাপ ইত্যাদি স্ট্রোকের কারণ হিসেবে কাজ করে। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস কমাতে হবে।  

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউরোসার্জনসের সেক্রেটারি মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, স্ট্রোক হলো বিশ্বে বিকলাঙ্গ হওয়ার এক নম্বর কারণ। এটা আসলে ক্যান্সার না। আর এমন কিছু না যে, ভালো হয় না। এই রোগ প্রতিরোধে সামাজিক অন্দোলন প্রয়োজন। স্ট্রোক যখন কিডনিতে হয়, কিডনির সমস্যা হতে পারে। যখন পায়ে হয়, তখন পায়ে রক্তনালীর অসুবিধা হয়। এ জন্য আমাদের মাথার স্ট্রোক যেমন জানা দরকার, হার্টের বিষয়েও জানা দরকার পায়েরটা জানা দরকার।

গতকাল বুধবার বেলা ১১টায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় কালের কণ্ঠ কার্যালয়ে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন ইউনাইটেড হাসপাতাল লিমিটেডের ব্র্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের ম্যানেজার শাহরিয়ার মো. ওসমান নাওয়েদ।