ধ্বংসস্তূপ থেকে ১০ দিনের শিশুকে নিয়ে বেঁচে ফেরার গল্প

এই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছিলেন নেকলে ও তার পরিবার : সংগৃহীত ছবি

ভূমিকম্প

ধ্বংসস্তূপ থেকে ১০ দিনের শিশুকে নিয়ে বেঁচে ফেরার গল্প

অনলাইন ডেস্ক

তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের এক সপ্তাহ পেরিয়েছে। এতে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৩৪ হাজারেরও বেশি মানুষ। এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন অনেক মানুষ। তাদের উদ্ধারে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন উদ্ধারকারীরা।

 এর মধ্যেই আবার ঘটছে আশ্চার্য সব ঘটনা। যেমন তুরস্কে ভূমিকম্পের ১০১তম ঘণ্টায় ছয়জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে জন্ম নেওয়া এক শিশু বেঁচে আছে। মায়ের দুধে বেঁচে ছিল ১৮ মাসের শিশু মাশাল। এমনই একটি আশ্চার্য ঘটনা নিয়ে এই প্রতিবেদন।
 

২৭ জানুয়ারি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন হাতায় প্রদেশের সামান্দাগ শহরের বাসিন্দা নেকলা কামুজ। সন্তানের নাম রাখেন ইয়াগিজ যার অর্থ সাহসী। সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিলো। এর ঠিক ১০ দিন পরের কথা। সন্তানের খাওয়াতে ঘুম থেকে জেগেছিলেন নেকলা। হঠাৎ ভূমিকম্পের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলো সব। নিজেকে আবিষ্কার করলেন ধ্বংসস্তূপের নিচে।  

উদ্ধারের পর ইয়াগিজ

আধুনিক একটি ৫ তলা ভবনের দুই তলায় স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে থাকতেন তিনি। তিনি জানান, এটি একটি 'ভালো ভবন' ছিল। আমি নিরাপদ বোধ করতাম। তবে সেই ভুল ভাঙতে বেশি সময় নেয়নি।  

তিনি বলেন, ভূমিকম্প যখন শুরু হয় আমি আমার স্বামীর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি। সেও তখন অন্য রুম থেকে আমার আরেক সন্তানকে নিয়ে আমাদের কাছে আসার চেষ্টা করে। তখনই একটি ওয়ারড্রব তাদের ওপরে এসে পড়ে। তাদের নড়াচড়া করার সুযোগ ছিল না।

ভূমিকম্প যখন শেষ হলো তখন আমি ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া অবস্থায় আবিষ্কার করি। আমার সন্তান তখনো আমার কোলে। আমি আমার স্বামী ও ছেলেকে ডাকলাম। তবে তারা কোনো সাড়া দিলো না।  নেকলার পাশেই একটি ওয়ারড্রব পড়ে যাওয়ায় ভবনের ছাদ তাদের চাপা দিতে পারেনি। সেখানেই পরবর্তী চার দিন কেটেছে তার।  

প্রথম দিন

ধ্বংসাবশেষের নিচে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছু দেখার সুযোগ নেই। তবে তার অন্য ইন্দ্রিয় কাজ করা শুরু করে। তিনি বুঝতে পারেন ইয়াগিজ শ্বাস নিচ্ছে। প্রচণ্ড ধুলায় শ্বাস নিতে কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে তা ঠিক হয়ে যায়।  

তিনি বুঝতে পারেন তার ছেলেদের খেলনার ওপরে পড়েছেন তিনি। ফলে যায়গাটা একটু গরম ছিলো। প্রথম দিন দূর থেকে মানুষের গলার শব্দ শোনেন। তিনি চিৎকার করে ডাকেন, ওয়ারড্রবে আঘাত করে শব্দ করেন যাতে উদ্ধারকারীরা তাকে শুনতে পায়। তবে কোন উত্তর আসে না বাইরে থেকে। আতঙ্কিত নেকলা বুঝতে পারেন হয়তো কেউই তাদের উদ্ধারে আসবে না।  

ধ্বংসাবশেষের নিচে

ধ্বংসাবশেষের নিচে ঘুটঘুটে অন্ধকারে সময়ের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন নেকলা। জীবনটা তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। নেকলা বলেন, যখন আপনার একটি সন্তান হয় তখন কত কিছু পরিকল্পনা করেন। তারপর হটাৎ নিজেকে ধ্বংসস্তূপের নিচে দেখতে পান।  

তিনি জানতেন যাই হোক না কেন ইয়াগিজকে দেখভাল করতে হতে তার। তিনি তাকে বুকের দুধ খাওয়াতে থাকেন। তবে নিজের জন্য খাওয়ার কিছুই ছিল না তার কাছে। এক পর্যায়ে নিজের বুকের দুধ খাওয়ার ব্যার্থ চেষ্টাও করেন তিনি।  

একসময় অনেক দূর থেকে ড্রিল মেশিনের শব্দ ভেসে আসে তার কানে। তিনি মানুষের চলাচলের শব্দ এবং কথা বলতে শোনেন। তিনি নিজের সর্বশেষ শক্তিটুকু শেষ না করে অপেক্ষা করেন। তিনি কখনো ভাবেননি বেঁচে ফিরতে পারবেন তবে ইয়াগিজের উপস্থিতি তাকে আশাবাদী করেছিলো। ইয়াগিজ বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়েই কাটিয়েছে। কান্নাকাটি করলে তাকে দুখ খাইয়ে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন নেকলা।  

উদ্ধার

এভাবেই কেটেছে ৯০ ঘণ্টা। একসময় নেকলা কুকুর ডাকার শব্দ পান। তার কাছে স্বপ্নের মত লাগে বিষয়টি। কিন্তু এর পরপরই মানুষের গলা ভেসে আসে তার কানে। তিনি কি ঠিক আছো? ঠিক থাকলে একবার শব্দ করো। কোন এ্যাপার্টমেন্টে থাকো তুমি? এভাবেই তাকে খুঁজে পায় উদ্ধারকারীরা।  

সতর্কতার সাথে গর্ত করে তাকে খুঁজে বের করে উদ্ধারকারীরা। অন্ধকারে উদ্ধারকারীদের লাইট গিয়ে পড়ে নেকলের চোখে। বের করে আনা হয় তাকে। ইয়াগিজকে আগে উদ্ধার করা হয়। তার পর সাবধানে বের করা হয় নেকলেকে। বের হয়ে বড় একটি জটলা দেখতে পান তিনি তবে কাউকেই চিনতে পারেন না তিনি। এ্যম্বুলেন্সের করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।  

উদ্ধারের পর

হাসপাতালে নেওয়ার পর তার পরিবারের অন্য সদস্যরা জানান তার স্বামী ইরফান ও ৩ বছরের ছেলে ইগিত কেরিমকে উদ্ধার করা হয়েছে। তার অন্য একটি হাসপাতালে রয়েছেন। ইরফান পায়ে ব্যাথা পেয়েছেন তবে ভালো আছেন।  

উদ্ধারের পর স্বামী ও সন্তানদের সঙ্গে নেকলে 

আশ্চার্যজনকভাবে নেকলা ও শিশু ইয়াগিজ শারীরিকভাবে কোনো আঘাত পাননি। ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালে থাকার পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে ফিরে যাওয়ার জন্য তার বাড়ি অক্ষত নেই। পরিবারের সদস্যরা একটি তাবুর মত বানিয়েছেন যেখানে থাকছেন ১৩ জন। তাদের সবাই ভূমিকম্পে ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। ছোট্ট একটি চুলায় রান্না করে আর গল্প করেই সময় কাটছে তাদের।  

নেকলে বলেন, আমার জীবনের জন্য আমার সন্তানের কাছে কৃতজ্ঞ। ও যদি এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে না পারতো তাহলে হয়তো আমিও পারতাম না। তার একটিই চাওয়া, তার সন্তানকে যেন এমন পরিস্থিতি আর না পড়তে হয়। তিনি বলেন, আমি খুবই আনন্দিত যে ইয়াগিজ এটা মনে রাখতে পারবে না।  

news24bd/আজিজ