গাজীপুরের নির্বাচন কী ‘পাতানো খেলা’?

সংগৃহীত ছবি

গাজীপুরের নির্বাচন কী ‘পাতানো খেলা’?

সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্বের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়া, জাহাঙ্গীরকে দল থেকে স্থায়ী বহিষ্কার, দুদকের তলবসহ নানা কারণে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত সেই জাহাঙ্গীরের মা-ই জয়লাভ করেছেন। সর্বসাধারণ ধারণা করছিল, যেকোনোভাবে আওয়ামী লীগ হয়তো আজমত উল্লাকে জিতিয়ে নিয়ে আসবে। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মার্কিন চাপ এবং বিরোধী দলের দাবির মুখে সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।

আবার এই সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব- সেটি প্রমাণ করার জন্য সরকার এই নির্বাচন সুষ্ঠু করেছে কি না তা নিয়েও অনেকের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।       

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‌‘গাজীপুরে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। এ নির্বাচন নিয়ে কারও মনে কোনো প্রশ্ন নেই। তবে গুজব আছে, এর মধ্যে পাতানো খেলা হয়ে থাকতে পারে।

না হলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খানই জিততেন। ’

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. আব্দুল লতিফ বলেন, ‘এ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় উদ্ঘাটিত হয়েছে। আর তা হলো মানুষের ক্ষোভ, দুঃখ ও হতাশা এতটাই তীব্র যে, তারা সরকারি দলের একজন নেতাকে পছন্দ করেননি। বিজয়ী প্রার্থী তার তুলনায় অনেক দুর্বল ছিলেন। তবু সেখানকার জনগণ ক্ষমতাসীনদের পছন্দকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। নির্বাচন অনেকটাই স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে। সারা দেশে সুষ্ঠু ভোট হলে এবং জনগণ ভোট দেওয়ার ক্ষমতা ও সুযোগ পেলে কী অবস্থা হবে, এখান থেকে ক্ষমতাসীনদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। তবে এ নির্বাচনের মাধ্যমে কিন্তু শাসন বা সরকারের কোনো পরিবর্তন হবে না। সে জন্য হয়তো নির্বাচন কমিশন তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পেরেছে। ’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আমেরিকার ভিসা নীতি এ নির্বাচনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। গাজীপুর নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে মার্কিন ভিসা নীতি আসায় সরকার ও নির্বাচন কমিশনও বাধ্য হয়েছে নিরপেক্ষ ভোট করার। যদিও ভোটে বিরোধী দল বলতে কেউ ছিল না। দুই প্রার্থীই ক্ষমতাসীন দলের মতাদর্শের। তবু শেষ মুহূর্তে এ নির্বাচনের ফল উল্টে দেওয়ার একটা চেষ্টা করা হয়েছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। ’

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এটি ছিল একটি রুটিন নির্বাচন। এর মাধ্যমে ক্ষমতার কোনো পালাবদলের সুযোগ বা সম্ভাবনাও ছিল না। ফলে ভোটে যা হওয়ার, তাই হয়েছে। এতে সরকার, নির্বাচন কমিশনারসহ সবাই সন্তুষ্ট। ’

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম বলেন, ‘গাজীপুর নির্বাচন অত্যন্ত সুন্দর ও ভালো হয়েছে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে ইসি যা যা করার, তার সবই করেছে। তারা নির্বাচনের ঠিক আগের দিনও একজন কাউন্সিলর প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করে কড়া বার্তা দিতে সক্ষম হয়। সিসিটিভিতে পর্যবেক্ষণ করে তারা আরও বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। তবে ভোট গ্রহণে ইভিএমের ত্রুটি ও গতিহীনতায় ভোটারদের ভোগান্তি ছিল। ভোটার উপস্থিতি আরও বেশি হওয়া দরকার। কিন্তু সরকারবিরোধীরা ভোটে অংশ না নেওয়ায় হয়তো সেটি হয়নি। সব দল ভোটে গেলে ভোটাররা আরও স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতেন। ’

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘গাজীপুর নির্বাচন আপাতদৃষ্টিতে শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও নিরপেক্ষ হলেও সেটি কি আসলে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে? এ নির্বাচনে ভোটারদের সামনে তেমন কোনো বিকল্প ছিল না। আর বিকল্প না থাকলে সেটিকে গ্রহণযোগ্যও বলা যায় না। নির্বাচন হচ্ছে বিকল্প থেকে বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকা। গাজীপুরে সেটি ছিল না। এখানে বড় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী একই দল সমর্থিত। সেখানে বিরোধীরা ছিল না। সেজন্য এ নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হলেও তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। একই দলের প্রার্থী থাকায় প্রশাসনও এতে তেমন কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। এ নির্বাচনে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছিল না। সেজন্য আগামীতেও জাতীয় নির্বাচন যে অবাধ ও সুষ্ঠু হবে—এই নির্বাচন সেই বার্তা দেয় না। কারণ, জাতীয় নির্বাচনের হিসাব-নিকাশও ভিন্ন। তিনি আরও বলেন, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির খড়্গ শুরু হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন না করলে তাদের মাশুল দিতে হবে। ’

সুজন সম্পাদক বলেন, ‘সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর একটি অনাস্থা তৈরি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে একটি অসমতল মাঠ তৈরি করা হয়েছে। সেজন্য সরকারপ্রধানের অধীনে নির্বাচনের চিন্তা বাদ দিয়ে নিরপেক্ষ একটি সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন নিয়ে সমান্তরাল ও সমতল মাঠ তৈরি করতে হবে। ’
news24bd.tv/আইএএম