বাংলাদেশ ব্যানানা রিপাবলিক নয়

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশ ব্যানানা রিপাবলিক নয়

অনলাইন ডেস্ক

প্রফেসর ইউনূসের বিষয়ে বিদেশিদের খোলা চিঠি নীতি-নৈতিকতা বিরোধী এবং রাজনৈতিক আচরণের নিয়ম-নীতির পরিপন্থী কাজ বলে মন্তব্য করেছেন সাংবাদিক, রাজনীতি ও কূটনীতি বিশ্লেষক সৈয়দ বদরুল আহসান।

বুধবার ইউরিপোর্টার এর এক প্রতিবেদনে বদরুল আহসান উল্লেখ করেন, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে হয়রানীর প্রতিবাদস্বরূপ বিশ্বের ১৭০ জনের বেশি বিশিষ্ট ব্যক্তি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি খোলা চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং একইসাথে এটি সংবাদপত্রে একটি বিজ্ঞাপন হিসাবে প্রচার করে। কিন্তু তখন তারা বুঝতে পারেনি যে এই ধরনের কাজটি ইচ্ছাকৃত ছিল। শুধু বাংলাদেশের নেত্রীই নয়, এটা যে পুরো জাতিকে অপমান করার শামিল সেটা স্পষ্ট।

প্রফেসর ইউনূস ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন এবং বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে সম্মানিত তিনি। গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে তার অবদান বাংলাদেশের সামাজিক পটভূমিতে উল্লেখযোগ্য ল্যান্ডমার্ক হিসেবে রয়ে গেছে।

কিন্তু সমস্যাটা হলো, ১৭০ জনের বেশি বিশিষ্ট জনের চিঠিটি শেখ হাসিনার সরকারকে এমনভাবে চাপে ফেলতে চেয়েঠিলো যেটা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক নিয়ম বিরোধী। প্রকৃতপক্ষে চিঠির ভাষা ও বিষয়বস্তু কেবল মর্মান্তিক নয়, আপত্তিকরও।

চিঠির লেখকরা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গিয়ে একজন ব্যক্তিকে রক্ষায় কথা বলছেন। যে ব্যক্তি তার আর্থিক বিষয় সম্পর্কিত আইনি সমস্যার সাথে লড়াই করছেন।

অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান আদালতের কার্যক্রম অবিলম্বে স্থগিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন জানিয়েছেন চিঠির লেখকরা। শেখ হাসিনাকে তাদের পরামর্শ, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো নিরপেক্ষ বিচারকের একটি প্যানেল দ্বারা পর্যালোচনা করা হোক। এই পর্যালোচনার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কয়েকজন বিশেষজ্ঞকে বোর্ডে আনা উচিত বলেও মত তাদের।

চিঠিতে তারা উল্লেখ করেন, 'আমরা নিশ্চিত যে (ইউনূসের) বিরুদ্ধে দুর্নীতি বিরোধী এবং শ্রম আইনের যে কোনো মামলার পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার ফলে তাকে খালাস দেওয়া হবে। '

চিঠির লেখকরা সম্ভবত এই পয়েন্টটি মিস করেছেন, যেটা হলো একবার আইনের দ্বারস্থ হলে সেটা সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়াতেই শেষ করতে হয়। বিশ্বের কোথাও এমন কোনো আইনি ব্যবস্থা নেই যেখানে একটি মামলা একবার শুরু হলে সেটা কার্যধারা থেকে অপসারণ করা হয়েছে কিংবা 'নিরপেক্ষ বিচারকদের প্যানেল'-এর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তাহলে সেটা হবে আইনের সঙ্গেই প্রতারণা। এছাড়া, একটি দেশের স্বাভাবিক আইনে পরিচালিত একটি মামলা স্থগিত করা এবং এর বিবরণ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের কাছে পর্যালোচনার জন্য হস্তান্তর করাও আইনসিদ্ধ নয়।

চিঠিটা একাধিক উপায়ে বাংলাদেশ সরকারকে ঘায়েল করা এবং বাংলাদেশের জনগণকে একদল লোকের সামনে নতজানু করে রাখার প্রয়াস মাত্র। যারা অবশ্যই প্রফেসর ইউনূসের সুবিধার কথা আগে প্রাধান্য দিচ্ছেন। যদি এমন হয়ে থাকে তাহলে সেটা হবে আইনের শাসন থেকে বিচ্যুতি।

চিঠিতে অনেক নোবেল বিজয়ী এবং অন্য যারা স্বাক্ষর করেছেন স্পষ্টতই তাদের স্বার্থ শুধুমাত্র ইউনূসকে রক্ষা করা নয়। এছাড়াও তাদের ভিন্ন স্বার্থ রয়েছে যা ওই চিঠিতে স্পষ্ট। চিঠিতে তারা উল্লেখ করেছেন, 'আমরা বিশ্বাস করি আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। '

চিঠির অসঙ্গতিগুলো ভুল হিসেবে বিবেচ্য নয়। ওই চিঠির পেছনের উদ্দেশ্যটি মিস করার মতো নয়। কারণ আগামী বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফের ক্ষমতায় আসার দ্বার উন্মুক্ত। এই চিঠির উদ্দেশ্য সুষ্ঠু নির্বাচন নয়, বরং বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত করার উদ্দেশ্য বলেই বিবেচিত। চিঠির লেখকরা কেন ড. ইউনূসের মামলার সঙ্গে নির্বাচনের যোগসূত্র বেছে নিয়েছেন তা একটি উদ্বেগজনক প্রশ্ন।

এখানে স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক বিচক্ষণতা স্পষ্টতই কাজ করেনি। আরও অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলো যেসকল ব্যক্তি এই চিঠিটি লিখেছেন তাদের অনেকেই বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে পছন্দ করছেন না এবং বিষয়টি তারা কখনও গোপনও করেননি।

চিঠির লেখকদের উদ্দেশে বলতে হয়, বাংলাদেশ সরকারের এমন প্রকাশ্য নিন্দা যে বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়ার কারণ হবে, সেটা তারা বুঝতে পারেননি। এটা তাদের ব্যর্থতা এবং বিষয়টি দুঃখজনক। বাংলাদেশের জনগণ আজীবন তাদের ঐতিহ্যের জন্য গর্বিত একটি জাতি। তবে তারা চিঠির ভাষা ও বিষয়বস্তু দেখে হতবাক। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, চিঠির লেখকরা অতীতেও অন্যান্য দেশের সরকার প্রধানদের কাছে একই ধরনের খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এই পর্যবেক্ষণগুলো খেয়াল করলে দেখা যায়:

*এই বৈশ্বিক ব্যক্তিত্বরা কী কখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো রাষ্ট্রপতির কাছে এমন একটি খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন যেটায় কয়েক দশক ধরে গুয়ানতানামোতে বিনা বিচারে বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার দাবি জানানো হচ্ছে?

*এই বিশিষ্ট ব্যক্তিরা কী ২০০৩ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন? যেখানে কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই স্বাধীন দেশ ইরাকে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছিলো। তারপরেও সাদ্দাম হোসেনকে বিচারের নামে প্রহসনের শিকার করে এবং তাকে ফাঁসির মঞ্চে পাঠানো হয়?

*এই চিঠির লেখকরা কী কখনও পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের হয়রানি বন্ধ করে তার বিরুদ্ধে ১৫০-এর বেশি মামলা প্রত্যাহার এবং তাকে আটক থেকে মুক্ত করার দাবিতে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কাছে একটি উন্মুক্ত বার্তা পাঠানোর প্রয়োজন বলে মনে করেছেন?

*চিঠির লেখকরা নিজেদেরকে আইনের শাসনে বিশ্বাসী বলে মনে করে। তারা কী কখনো মার্কিন ও কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই খুনিকে আশ্রয় দেয়ার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন? যেখানে দুই খুনি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই দিন কাটাচ্ছেন। এই চিঠির লেখকরা অবশ্যই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অভিযুক্তদের বর্বর ভূমিকার বিষয়ে অবগত।

*বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে এই ধরনের একটি চিঠি পাঠানো হয়েছিল যাতে তার রাজনৈতিক জোটের কর্মীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করা হয়। যারা সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের পরপরই আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে তাণ্ডব চালিয়েছিল?

*এই ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলারা কী রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির বিরুদ্ধে সমস্ত আইনি প্রক্রিয়া বাদ দেয়া এবং তাকে মুক্ত করার বিষয়ে কোনো চিঠি পাঠাতে পারেন না?

*জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ইস্যুতে এই চিঠি লেখকরা কই ছিলেন? তারা কী যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর জন্য কোনো খোলা চিঠি প্রস্তুত করেছে? যেখানে তারা বলতে পারেন মিডিয়ার স্বাধীনতার স্বার্থে অ্যাসাঞ্জকে তার পেশাগত কাজ ঠিকভাবে করার জন্য মুক্তি দেওয়া হোক।

*এই চিঠির লেখকদের মধ্যে কতজন মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কর্তৃক বন্দী অং সান সু চির মুক্তির বিষয়ে কথা বলেছেন? তারা কী সেদেশের জান্তা সরকারের কাছে একজন  জাতীয় নেতাকে মুক্ত করার বিষয়ে কথা বলেছেন? তারা কী কয়েকলাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাদের বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কোনো প্রশ্ন রেখেছেন?

*বছরের পর বছর ধরে সাংবাদিকরা মিশরের কারাগারে বন্দী। রাষ্ট্রপতি আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির কাছে কী তাদের স্বাধীনতার জন্য কোন খোলা চিঠি পাঠানো হয়েছিল?

*কয়েক বছর আগে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে খুন হন সাংবাদিক জামাল খাশোগি। এই নোবেল বিজয়ী এবং বৈশ্বিক নেতারা কি সৌদি সরকারকে চিঠি লিখে এই ট্র্যাজেডির সত্যতা তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন?

*২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর হাতে এলটিটিই-এর পরাজয়ের পর তামিল সংখ্যালঘুদের উপর যে অত্যাচারের অবসান ঘটানো হয়েছিল এবং তামিলদের দুঃখ-দুর্দশার জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার দাবিতে শ্রীলঙ্কার কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো খোলা চিঠি পাঠানো হয়নি।

আসল বিষয় হলো, বিচারের জন্য ভণ্ডামির পথ বেছে নেয়া কোন সমাধান নয়। যে ব্যক্তিরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিটি লিখেছিলেন, তারা স্পষ্টতই প্রফেসর ইউনূস সম্পর্কে তাদের উদ্বেগ বিচক্ষণতার সাথে ও কূটনৈতিক উপায়ে সরকারকে জানাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ীকে টেনে এনে বাংলাদেশকে বিশ্বের সামনে দাঁড় করানোর একটি অপকৌশল বেছে নিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যানানা রিপাবলিক (কলা প্রজাতন্ত্র) নয়। আইন অনুযায়ী অধ্যাপক ইউনূসের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। বাংলাদেশ একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ। বিশ্বের কোনো শক্তির কাছে বাংলাদেশ তার কাঁধ নত করবে না। সকল সমস্যার সমাধান দেশ তার নিজস্ব আইনি এবং সাংবিধানিক ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাধান করতে পারে এবং করবে।

বাংলাদেশ সরকারকে বাধাগ্রস্ত করতে ইউনূস ইস্যুতে ১৭০ এর বেশি বৈশ্বিক ব্যক্তিত্বদের চেষ্টা কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে এবং যা অনাকাঙ্ক্ষিত। বিষয়টি সমাধানের জন্য তাদের আরও ভালো চিন্তা করা উচিত ছিল। তারা যেভাবে অনুমান করেছিলেন কৌশলটি আসলে সেভাবে কাজ করেনি।


-লেখক: সৈয়দ বদরুল আহসান
লন্ডনভিত্তিক সাংবাদিক, লেখক এবং রাজনীতি ও কূটনীতি বিশ্লেষক।