মসজিদুল আকসা যখন নির্মাণ করা হয়

সংগৃহীত ছবি

মসজিদুল আকসা যখন নির্মাণ করা হয়

 আতাউর রহমান খসরু

পবিত্র মক্কা ও মদিনার পর মসজিদুল আকসা মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্র স্থান। নানা তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট্যের কারণে মসজিদুল আকসা মুসলমানদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন মসজিদুল আকসা অসংখ্য নবী-রাসুলের স্মৃতিধন্য পুণ্যভূমি এবং মুসলমানদের প্রথম কিবলা। হিজরতের পর ১৭ মাস পর্যন্ত মুসলমানরা মসজিদুল আকসার দিকে ফিরে নামাজ আদায় করত।

রাসুলুল্লাহ (সা.) মিরাজের রাতে মসজিদুল আকসায় গমন করেন। এ ছাড়া আল আকসা ইসলামী শিক্ষা ও মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতির তীর্থভূমি। মুসলিম শাসকদের জনকল্যাণমূলক বহু কাজের স্মৃতিচিহ্ন ধারণ করে আছে পবিত্র এই ভূমি।
কোরআনের বর্ণনায় আল আকসা

পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে আল আকসা ও ফিলিস্তিন ভূমির বর্ণনা এসেছে, যা এই পবিত্র ভূমির বিশেষ মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত করে।

যেমন ইরশাদ হয়েছে, ‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। ’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ১)
মসজিদুল আকসার নির্মাণকাল

খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে মসজিদুল আকসা নির্মিত হয়। এটা পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীনতম মসজিদ।

আবু জর গিফারি (রা.) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! সর্বপ্রথম কোন মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি বললেন, মসজিদুল হারাম। আমি বললাম, অতঃপর কোনটি? তিনি বললেন, মসজিদুল আকসা। আমি বললাম, এ দুইয়ের নির্মাণের মাঝখানে কত পার্থক্য? তিনি বললেন, ৪০ বছর। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৪২৫)
মসজিদুল আকসার নির্মাতা

মসজিদুল আকসা সর্বপ্রথম কে নির্মাণ করেন তা নিয়ে মতভিন্নতা আছে।

এর মধ্যে প্রধান মত তিনটি। তা হলো, মানবজাতির পিতা আদম (আ.), নুহ (আ.)-এর ছেলে সাম ও মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.)। তবে গবেষক আলেমরা আদম (আ.)-কে মসজিদুল আকসার নির্মাতা হওয়ার মতকে প্রাধান্য দেন। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) মসজিদুল হারাম ও মসজিদুল আকসার নির্মাণকালের পার্থক্য বলেছেন ৪০ বছর। আর নির্ভরযোগ্য তথ্য মতে, আদম (আ.) মসজিদুল হারামের নির্মাতা ছিলেন।
পুনর্নির্মাণ, সংস্কার ও পরিচর্যা

মসজিদুল হারামের মতো মসজিদুল আকসাও একাধিকবার পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়। আদম (আ.)-এর পর খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে ইবরাহিম (আ.) এর পুনর্নির্মাণ করেন। তাঁর বংশধরদের ভেতর ইসহাক ও ইয়াকুব (আ.) পবিত্র এই মসজিদের পরিচর্যা করেন। অতঃপর খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার বছর আগে সুলাইমান (আ.) মসজিদুল আকসা পুনর্মির্মাণ করেন।

আল-আকসার আয়তন

১৪৪ একর ভূমির ওপর আল আকসা কম্পাউন্ড অবস্থিত, যা প্রাচীন জেরুজালেম শহরের ১৬.৬ ভাগের এক ভাগ। আল আকসা কম্পাউন্ড অর্ধ-আয়তাকার। এর পশ্চিম দিক ৯৪১ মিটার, পূর্ব দিক ৪৬২ মিটার, উত্তর দিক ৩১০ মিটার এবং দক্ষিণ দিক ২৮১ মিটার প্রশস্ত। কম্পাউন্ডের ভেতরে মসজিদুল আকসা ছাড়াও একাধিক ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। যেমন—সোনালি বর্ণের কুব্বাতুস সাখরা। উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান ৭২ হিজরিতে এটি নির্মাণ করেন। এর পাশেই কিবলি মসজিদ নির্মাণ করেন খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক। কিবলি মসজিদ নির্মাণ করতে ১০ বছর (৮৬-৯৬ হি.) সময় লেগেছিল। কুব্বাতুস সাখরা মূল অবয়বে টিকে থাকলেও কিবলি মসজিদ একাধিকবার পুনর্নির্মাণের প্রয়োজন হয়েছিল। যেমন ১৩০ হিজরি ও ৪২৫ হিজরির ভূমিকম্পের পর।

আল-আকসার স্থাপনাগুলো

আল আকসা কম্পাউন্ডে ছোট-বড় ২০০ স্থাপনা রয়েছে। যার মধ্যে আছে মসজিদ, গম্বুজ, আঙিনা, মিহরাব, মিম্বার, আজানের স্থান, কূপ ইত্যাদি। এসব স্থাপনার মধ্যে কুব্বাতুস সাখরার অবস্থান আল আকসা কম্পাউন্ডের ঠিক মধ্যখানে। কিবলি মসজিদের অবস্থান সর্বদক্ষিণে। এই মসজিদের সাতটি আঙিনা ও বারান্দা রয়েছে। কম্পাউন্ডের প্রবেশপথ ছয়টি। কম্পাউন্ডের ভেতর ২৫টি সুপেয় পানির কূপ। রয়েছে বেশ কয়েকটি পানির ফোয়ারা। পাথর আচ্ছাদিত কায়েতবাই ফোয়ারাটিই সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন। আরো আছে ৪০টি উঁচু আসন। যেখানে বসে প্রাজ্ঞ আলেমরা ধর্মীয় জ্ঞানের পাঠদান করে থাকেন। এসব স্থাপনা বিভিন্ন শাসনামলে নির্মিত।

মুসলমানদের আল-আকসা বিজয়

১৫ হিজরি মোতাবেক ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম বাহিনী ফিলিস্তিন ভূমি জয় করেন এবং আল আকসা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়। বিজয়ের পর খলিফা ওমর (রা.) ফিলিস্তিন সফর করেন। তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন আবু উবাইদা আমের ইবনুল জাররাহ, সাআদ বিন আবি ওয়াক্কাস, খালিদ বিন ওয়ালিদ ও আবু জর গিফারি (রা.)-সহ সাহাবিদের একটি দল। ওমর (রা.) একটি সন্ধিচুক্তির অধীনে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে আল আকসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি নিজে উপস্থিত থেকে পবিত্র পাথর ও আল আকসার আঙিনা পরিষ্কার করেন। তিনি আল আকসা মসজিদের দক্ষিণে ছোট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।

বিভিন্ন শাসনামলে আল-আকসা

খোলাফায়ে রাশেদার পর উমাইয়া শাসনের সূচনা হয়। উমাইয়া শাসকদের রাজধানী ছিল দামেস্ক। দামেস্ক ফিলিস্তিনের নিকটবর্তী হওয়ায় উমাইয়া খলিফারা আল আকসাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তাঁদের সময়ে আল আকসার মৌলিক অবকাঠামোগত বহু উন্নয়ন হয়। উমাইয়াদের পর আব্বাসীয় খলিফাদের শাসনাধীন হয় আল আকসা। কিন্তু তাঁদের রাজধানী বাগদাদ হওয়ায় মসজিদুল আকসার ব্যাপারে তাঁদের মনোযোগ অনেকটাই কম ছিল। তবে তাঁরা প্রয়োজনীয় সংস্কার ও স্থানীয় ধর্মীয় কর্মকাণ্ডগুলোতে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।

৯৭০ খ্রিস্টাব্দে রামাল্লার যুদ্ধে আব্বাসীয় বাহিনী মিসরে ফাতেমি বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। এর মাধ্যমেই ফিলিস্তিন ভূমির পতন শুরু হয়। ফাতেমিরা ছিল শিয়া ইসমাইলিয়া মতবাদের অনুসারী। যাদের বেশির ভাগ আলেম মুসলিম মনে করেন না। ফাতেমীয় শাসকরা মসজিদুল আকসার ওপর নানা ধরনের বিধি-নিষেধ আরোপ করে এবং ফিলিস্তিন ভূমিতে ইসলামী শিক্ষাধারা বন্ধ করে শিয়া মতবাদ প্রচারের সুযোগ করে দেন। ফাতেমীয় শাসক হাকিমের শাসনামলের শেষভাগে ১০২১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আল-কুদস ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চায় তার অতীত ঐতিহ্যের সবটুকু হারিয়ে ফেলে।

১০৭৩ খ্রিস্টাব্দে ফিলিস্তিন সেলজুকদের শাসনাধীন হয়। তারা ছিল সুন্নি মতবাদে বিশ্বাসী। ফলে আল আকসা তার হারানো মর্যাদা ফিরে পেতে শুরু করে এবং ফিলিস্তিনে আবারও বিশুদ্ধ ইসলামী জ্ঞানের চর্চা শুরু হয়। ধারণা করা হয়, ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দে আল আকসায় ইমাম গাজালি (রহ.)-এর আগমন ঘটে এবং তিনি কয়েক বছর অবস্থান করেন। কিন্তু এই সুদিন দীর্ঘস্থায়ী হলো না। ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা আল আকসা দখল করে। তারা মসজিদুল আকসাসহ ইসলামী ঐতিহ্যগুলো ধ্বংস করতে তৎপর হয়।

১১৮০ খ্রিস্টাব্দে মিসরের শাসক সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.) ক্রুসেডারদের হাত থেকে ফিলিস্তিন ভূমি মুক্ত করেন। বিজয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে মসজিদুল আকসা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। পরবর্তী জুমা থেকে সেখানে নামাজ শুরু হয়। তিনি নিজ হাতে গোলাপজল দিয়ে আল আকসা পরিষ্কার করেন। তিনি বিজয়ের প্রতীক হিসেবে একটি মিম্বার তৈরি করেন এবং এ ছাড়া আল আকসা কম্পাউন্ডের ভেতর একাধিক শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। সালাহুদ্দিন আইয়ুবি ও তাঁর বংশধররা ক্রুসেডারদের একাধিক আক্রমণ থেকে ফিলিস্তিন ভূমিকে রক্ষা করেছিল। মামলুকরা আইয়ুবীয়দের উত্তরাধিকারী হলে তারা আল আকসার নিরাপত্তায় আত্মনিয়োগ করে। ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে ফিলিস্তিন ভূমি উসমানীয় শাসকদের নিয়ন্ত্রণে আসে, যা ১৯১৭ সাল পর্যন্ত অটুট ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয়ের মাধ্যমে পবিত্র এই ভূমির নিয়ন্ত্রণ চলে ব্রিটেনের হাতে। ফলে  ফিলিস্তিনে দীর্ঘ মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে।

এই রকম আরও টপিক

সম্পর্কিত খবর