অটিজম শিশুদের স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপির গুরুত্ব

আজ বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

অটিজম শিশুদের স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপির গুরুত্ব

হাফিজুর রহমান

আজ ২ এপ্রিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি দিবস। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে সারা বিশ্বের অটিস্টিক ব্যক্তিদের সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নিতে ও উৎসাহিত করতে দিবসটি পালন করা হয়।  এবারের অটিজম দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‌'Moving from surviving to Thriving বা বেঁচে থাকা থেকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাওয়া'।

বাংলাদেশেও সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন অটিজম সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিবসটি পালন করা হয়।

অটিজমের সাধারণ লক্ষণ
অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (এএসডি) হলো একটি স্নায়বিক এবং বিকাশজনিত ব্যাধি। মানুষ কিভাবে অন্যদের সাথে যোগাযোগ করে, ভাবের আদান-প্রদান করে, শেখে এবং সঠিক আচরণ করে তা একে প্রভাবিত করে।  অনুমান করা হয়, মস্তিষ্কের যে অঞ্চলগুলো ভাষা বিকাশের সাথে সম্পর্কিত, অটিজমের ফলে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলে অস্বাভাবিকতার জন্য অটিস্টিক শিশুদের বোধের বিকাশ ঘটে না।

অটিজমের সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে- সামাজিক যোগাযোগে অসুবিধা, মৌখিক ও অমৌখিক যোগাযোগের অসুবিধা, স্টেরিওটাইপ শারীরিক নড়াচড়া, সংবেদনশীলতার সমস্যা ইত্যাদি। অটিজমের সাথে যুক্ত আরো অনেক লক্ষণ আছে। যেমন:

  • চোখে চোখে অথবা মানুষের দিকে কম তাকানো।  
  • মনোযোগের ঘাটতি।
  • সমবয়সীদের সাথে মিশতে কিংবা খেলতে না পারা।
  • শারীরিক নড়াচড়া ও শব্দ কপি করতে না পারা।
  • স্বাদ, গন্ধ, শব্দে অধিক কিংবা অল্প সংবেদনশীলতা।
  • বয়স অনুযায়ী বুঝতে কিংবা চিনতে না পারা।
  • শব্দ উচ্চারণ জনিতসমস্যা।
  • কোন কিছু শিখে আবার ভুলে যাওয়ার প্রবণতা।
  • মৌলিক চাহিদাগুলো সঠিকভাবে প্রকাশ করতে না পারা।
  • একা একা থাকতে পছন্দ করা।  
  • প্রশ্ন করলে সঠিকভাবে উত্তর দিতে না চাওয়া ইত্যাদি।

উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন অটিস্টিক শিশুদের ভাষার সমস্যা থাকে। তাদের ভাষার রূপতাত্ত্বিক উপাদানের বিভিন্ন ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও-

  • তাদের অতীতকালের ব্যবহারে সমস্যা দেখা যায়।
  • অনেক শিশুর ভাষার পুণরাবৃত্তির সমস্যা থাকে।
  • কর্তা ক্রিয়ার অন্বয় মেনে বাক্য ব্যবহার করতে পারে না। যেমন : স্যার চেয়ারে বসে আছে এটা না বলে 'স্যার চেয়ারে বসে আছি' বলে।
  • তারা সরল বাক্য বেশি বলে। জটিল বা যৌগিক বাক্য বুঝতে ও বলতে তাদের অনেক সমস্যা হয়।
  • আবেগ, অনুভূতি, সংবেদনশীল শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে তারা অদক্ষ হয়ে থাকে।
  • সর্বনাম ও সম্বন্ধ বাচক শব্দের ব্যবহারে তারা অনেক ভুল করে। তুমি/সে বলে না, নাম বেশি বলে।
  • অটিস্টিক শিশু শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গবাচক শব্দগুলো ভালো সনাক্ত করতে পারে ও বলতে পারে কারণ এগুলো মূর্ত। কিন্তু তারা টাকা চিনতে পারে না, কারণ টাকার বিষয়টি অনেকটা বিমূর্ত।

স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি
যোগাযোগ বৈকল্য ব্যক্তিদের এবং খাবার গলাধঃকরণ সমস্যার জন্য বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থাই হচ্ছে স্পিচ এ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি। একজন স্পিচ থেরাপিস্ট অটিস্টিক শিশুদের স্ক্রিনিং, রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। একজন স্পিচ থেরাপিস্টের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা। হতে পারে সেটি মৌখিক অথবা অমৌখিক। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক অভিভাবক মনে করেন, একজন স্পিচ থেরাপিস্ট শিশুর মুখের কথা বলানোর কাজ করবে। স্পিচ থেরাপিস্টরা মূলত শব্দ উচ্চারণ শেখানোর পাশাপাশি ভাষার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করেন। যেমন: কোন কিছু বোঝা এবং বুঝে তা প্রকাশ করা। সেক্ষেত্রে শিশুর লেভেল অনুযায়ী, মুখে বলেও চাহিদা প্রকাশ করতে পারে অথবা ইশারা ব্যবহার করে।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ

  • শিশুটি যেন একা একা না থাকে সেজন্য তার সাথে অনেক সময় দিন। ওই সময় শিশুটির সাথে দুই একটি শব্দ ব্যবহার করে কথা বলুন।
  • শিশুর সাথে খেলাধুলা করুন। এটা হতে পারে কাল্পনিক খেলা, লুকোচুরি, দেয়া-নেয়া ইত্যাদি টাইপের খেলা।
  • সেলফোন এবং টিভি দেখা হতে বিরত রাখুন।  
  • তাদের সমবয়সীদের সাথে মিশতে এবং খেলতে উৎসাহ দিন।
  • সময় পেলেই নতুন নতুন পরিবেশে বেড়াতে নিয়ে যান।
  • শিশুটিকে বাসার সবাই এক নামে ডাকুন।
  • বাসার আসবাবপত্র সম্পর্কে ধারণা দিন।
  • অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে ধারণা দিন, চেনানো চেষ্টা করুন।
  • বিভিন্ন ধরনের ছড়া শেখানোর চেষ্টা করুন।
  • শিশুটি কি করছে তার সামনে সেগুলো নিয়ে কথা বলুন। আপনারা কি করছেন সেগুলো নিয়েও ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করে কথা বলুন।
  • oral motor imitation চর্চা যেমন: জিহ্বা নড়াচড়া, গাল ফুলানো, ফুঁ দেয়া, ঠোঁটের নড়াচড়া ইত্যাদি অভ্যস্ত করান।
  • বিভিন্ন ধরনের শব্দ কপি করতে উৎসাহ করাতে sound imitation যেমন : আ/শব্দ, ই/ শব্দ, উ/শব্দ রপ্ত করান ।
  • মুখের দিকে তাকিয়ে জিহ্বার উচ্চারণ স্থান দেখিয়ে শব্দ উচ্চারণ করানোর চেষ্টা করান।
  • প্রথমে শিশুদের ঠোঁটের শব্দ বলতে উৎসাহ দিন। যেমন : প, ব, ম।
  • কোন কাজের শেষে উৎসাহ দিন, প্রশংসা করুন। হতে পারে সেটি কোন খাবার দেয়া, হাততালি বা হাইফাইড দেয়া।

লেখক : কনসালটেন্ট, স্পিচ এ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট
ইএমআই স্পেশাল স্কুল এন্ড থেরাপি সেন্টার, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা।  
কিডি সিটি স্পেশাল স্কুল, খিলগাঁও, ঢাকা।

news24bd.tv/health