একনজরে কিংবদন্তি গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার

সংগৃহীত ছবি

একনজরে কিংবদন্তি গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার

অনলাইন ডেস্ক

‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘গানের খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’, সহ অসংখ্য বাংলা গানের গীতিকার, চলচ্চিত্র পরিচালক গাজী মাজহারুল আনোয়ার মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। রোববার (৪ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ৬টার দিকে  ৭৯ বছর তার মৃত্যু হয়। দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে বেতার, টেলিভিশন, সিনেমাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রায় ২০ হাজার গান রচনা করেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। ১৯৪৩ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার তালেশ্বর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার।

 

স্বাধীনতা ও দেশপ্রেম নিয়ে তিনি অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান লিখেছেন। ১৯৬৭ সালে সুভাষ দত্তের ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ চলচ্চিত্রে ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’ গানটি দিয়ে চলচ্চিত্রের গান লেখা শুরু করেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। এখন পর্যন্ত তার রচিত গানের সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি। তার গানে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, প্রকৃতি, জীবনবোধ, প্রেম, বিরহ, স্নেহ, অনুভূতির কথা।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার মূলত জমিদার বংশের সন্তান। তার দাদা ছিলেন জমিদার। পরিবারের প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকলেও তিনি ছোটবেলা থেকেই দেশ, প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি দারুণ আগ্রহী ছিলেন। সেই আগ্রহ থেকে তার ভেতরে জন্ম নেয় সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনা। যা তাকে ধীরে ধীরে পরিণত করে একজন গীতিকারে।

মাত্র ২১ বছর বয়সেই গাজী মাজহারুল আনোয়ার গীতিকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৬৪ সালে তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানে তার লেখা প্রথম গান প্রচার হয়। সেই থেকে শুরু। তারপর কেটে গেছে অর্ধশতাধিক বছর। আর তিনি সৃষ্টি করেছেন হাজার হাজার গান। মুগ্ধ করেছেন প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা গানের ইতিহাসকে। বাংলা চলচ্চিত্রের গানে গাজী মাজহারুল আনোয়ার অনন্য। তার ধারে কাছেও আর কেউ নেই।

পরিচালক মাজহারুল আনোয়ার
১৯৬৫ সালে চলচ্চিত্রে যুক্ত হওয়ার পর গাজী মাজহারুল আনোয়ার চিত্রনাট্য, গান, সংলাপ ও কাহিনি রচনা শুরু করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই তার অবদান ছড়িয়ে আছে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি অঙ্গনে। ১৯৬৭ সালে চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত হওয়ার পর থেকে কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গান লেখাতেও দক্ষতা দেখান তিনি। তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র নান্টু ঘটক ১৯৮২ সালে মুক্তি পায়। তার পরিচালিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ৪১টি। চলচ্চিত্রগুলো হচ্ছে- নান্টু ঘটক(১৯৮২), শাস্তি(১৯৮৪), চোর (১৯৮৫), সন্ধি (১৯৮৭), স্বাক্ষর (১৯৮৮), শর্ত (১৯৮৯), স্বাধীন (১৯৯০),  সমর (১৯৯২), শ্রদ্ধা (১৯৯৪) , স্নেহ (১৯৯৪), আম্মা (১৯৯৪), পরাধীন (১৯৯৪), তপস্যা (১৯৯৪), উল্কা (১৯৯৪), ক্ষুধা (১৯৯৪), রাগী (১৯৯৯), আর্তনাদ (১৯৯৯), জীবনের গল্প (১৯৯৯), এই যে দুনিয়া (২০০৭), পাষানের প্রেম (২০১১), হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউ (২০১১)। এছাড়া আরও অনেক সিনেমার পরিচালক হিসেবে কাজ করেন।

সিনেমার গানে মাজহারুল আনোয়ার
গীতিকার হিসেবে যেসব সিনেমায় কাজ করেন কার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- পীচ ঢালা পথ (১৯৬৮), আবির্ভাব (১৯৬৮), নীল আকাশের নিচে (১৯৬৮), ক খ গ ঘ ঙ (১৯৭০), দীপ নেভে নাই (১৯৭০), দর্প চূর্ণ (১৯৭০), বিনিময় (১৯৭০), স্বরলিপি (১৯৭১), অবুঝ মন (১৯৭২), রংবাজ (১৯৭৩), সাধারণ মেয়ে (১৯৭৫), চাষীর মেয়ে (১৯৭৫), জয় পরাজয় (১৯৭৬), সূর্যগ্রহণ (১৯৭৬), দি রেইন (১৯৭৬), নয়নমণি (১৯৭৬), অনন্ত প্রেম (১৯৭৭), গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮), অশিক্ষিত (১৯৭৮), ডুমুরের ফুল (১৯৭৮), দি ফাদার (১৯৭৯), সূর্য সংগ্রাম (১৯৭৯), মহানগর (১৯৮১), লাল কাজল (১৯৮২), পুরস্কার (১৯৮৩), নতুন বউ (১৯৮৩), নাজমা (১৯৮৩), পেনশন (১৯৮৪), অভিযান (১৯৮৪), মা ও ছেলে (১৯৮৫), সারেন্ডার (১৯৮৭), রাজলক্ষী শ্রীকান্ত (১৯৮৭), যোগাযোগ (১৯৮৭), আগমন (১৯৮৭), রাঙা ভাবী (১৯৮৯), জীনের বাদশা (১৯৮৯), ছুটির ফাঁদে (১৯৯০), অন্ধ বিশ্বাস (১৯৯২), তুমি আমার (১৯৯৪), দেনমোহর (১৯৯৪), আশা ভালোবাসা (১৯৯৫), আঞ্জুমান (১৯৯৫), বাবার আদেশ (১৯৯৫), স্বপ্নের পৃথিবী (১৯৯৬), অজান্তে (১৯৯৬), দুর্জয় (১৯৯৬), তোমার জন্য পাগল (১৯৯৭), কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি (২০০৩), মান্না ভাই (২০০৪), হৃদয়ের কথা (২০০৬), বিদ্রোহী পদ্মা (২০০৬), তুমি কত সুন্দর (২০০৮), এ চোখে শুধু তুমি (২০০৮), সমাধি (২০০৮), বধূবরণ (২০০৮), যদি বউ সাজগো (২০০৮), তুমি আমার স্বামী (২০০৯), হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউ (২০১১), রাজা সূর্য খাঁ (২০১২), জজ ব্যরিস্টার পুলিশ কমিশনার (২০১৩), নিঃস্বার্থ ভালোবাসা (২০১৩), এপার ওপার (২০১৫), পুত্র এখন পয়সাওয়ালা (২০১৫), বিগ ব্রাদার (২০১৫), লালচর (২০১৫), মাটির পরী (২০১৬)। এছাড়াও আরও অসংখ্যা সিনেমায় গীতিকার হিসেবে কাজ করেন এই কিংবদন্তী গীতিকার।

মাজহারুল আনোয়ারের কালজয়ী গান
১৯৬২-৬৩ সালে মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় গাজী মাজহারুল আনোয়ারে লিখেছিলেন প্রথম গান ‘বুঝেছি মনের বনে রং লেগেছে’। গানটির সুর করেছিলেন নাজমূল হুদা বাচ্চু ও শিল্পী ছিলেন ফরিদা ইয়াসমিন। ১৯৬৪ সালে রেডিও পাকিস্তানে গান লিখে ৫০ টাকা আয়ের মাধ্যমে পেশাদার গীতিকার হিসেবে জীবন শুরু করেন তিনি।  

আরও পড়ুন : চলে গেলেন কিংবদন্তি গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার

উল্লেখযোগ্য গানগুলো হলো- জয় বাংলা বাংলার জয়, আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার, একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল, একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়, গানের খাতায় স্বরলিপি লিখে, আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল, এই মন তোমাকে দিলাম, তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়, শুধু গান গেয়ে পরিচয়, ইশারায় শীষ দিয়ে, চোখের নজর এমনি কইরা, চলে আমার সাইকেল হাওয়ার বেগে, ও পাখি তোর যন্ত্রণা, জন্ম আমার ধন্য হলো, প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ। এছাড়াও তিনি অসংখ্য জনপ্রিয় গান লিখেছেন।

এছাড়া বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০ বাংলা গানের মধ্যে তিনটি গানের রচয়িতা গুণী এই গীতিকবি। গানগুলো হচ্ছে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’ ও ‘একবার যেতে দে না’।

সম্মাননা
গাজী মাজহারুল আনোয়ার ২০০২ সালে একুশে পদক এবং ২০২১ সালে সংস্কৃতিতে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি স্বাধীন দেশের সর্বপ্রথম পুরস্কার বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, একাধিকবার বাচসাস পুরস্কার, বিজেএমই অ্যাওয়ার্ড, ডেইলি স্টার কর্তৃক লাইফ টাইম অ্যাওয়ার্ডসহ তার অর্জিত পুরস্কারের সংখ্যা ১১০।
news24bd.tv/আলী