সুবিধার অভাবে অন্য দেশে চলে যাচ্ছে বিদেশি পর্যটক

সংগৃহীত ছবি

সুবিধার অভাবে অন্য দেশে চলে যাচ্ছে বিদেশি পর্যটক

অনলাইন ডেস্ক

দেশের পর্যটন গন্তব্যগুলোতে বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকায় বিদেশি পর্যটক আসা কমে যাচ্ছে। কম খরচে ভ্রমণ ও বিনোদেনের সুবিধা পেয়ে পর্যটকরা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশের পর্যটকরাও উচ্চ ব্যয়ের কারণে এবার কক্সবাজারসহ দেশের প্রধান গন্তব্যগুলো এড়িয়ে পাশের দেশে ঈদের ছুটি কাটাতে গেছে। দেশে পর্যটকবান্ধব পরিবেশ ও অন্য সুযোগ-সুবিধা গড়ে না ওঠায় এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

তাঁরা বলছেন, এটা ‘উদ্বেগজনক’। তাই বিদেশি পর্যটকদের সুবিধা বাড়াতে নীতি সহায়তা চেয়েছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীও বলেছেন, ‘আমরা এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছি। এ ক্ষেত্রে আমাদেরও উদার নীতি গ্রহণ করতে হবে।

তবে আমাদের যে কৃষ্টি-কালচার, এগুলো মেনেই তা করতে হবে। ’

মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোও বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) লাস ভেগাসের আদলে ‘অ্যারাবিয়ান স্ট্রিপ’ নামের একটি ক্যাসিনো খুব শিগগির চালু হতে যাচ্ছে।

ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের পর্যটন খাতে যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। অথচ স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এসেও খাতটি নবজাতক পর্যায়ে রয়ে গেছে। ২০২১ সালে দেশের জিডিপিতে ভ্রমণ ও পর্যটন খাতের অবদান ছিল মাত্র ২.২ শতাংশ আর কর্মসংস্থানে অবদান ১.৮ শতাংশ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রধান পর্যটন গন্তব্যগুলোয় দুর্বল অবকাঠামো, প্রশাসন ও স্থানীয় অধিবাসীদের পর্যটনমনস্ক না হওয়া, পর্যটনের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবে দেশের পর্যটনশিল্প এগোতে পারছে না।

করোনার আগে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ভ্রমণে আসা শীর্ষ ১২ দেশের তালিকা করেছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (বিটিবি)। সরকারি এই সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, শীর্ষ ১২ দেশের তালিকায় আছে যথাক্রমে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্য, জাপান, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, নেপাল ও সৌদি আরব। বিটিবির তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটক এসেছিল ছয় লাখ ২১ হাজার ১৩১ জন, ২০২০ সালে এক লাখ ৮১ হাজার ৫১৮ জন এবং ২০২১ সালে এক লাখ ৩৫ হাজার ১৮৬ জন। অর্থাৎ করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও ২০২০ সালের তুলনায় বিদেশি পর্যটক কমেছে ৪৬ হাজার ৩৩২ জন। ২০২২ সালের তথ্য এখনো দিতে পারেনি সংস্থাটি।

করোনা শেষে প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিদেশি পর্যটকের ঢল নামলেও বাংলাদেশে উল্টো চিত্র কেন, জানতে চাইলে দেশের পর্যটন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি শিবলুল আজম কোরেশী বলেন, দেশে পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্ত চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া হোটেলে যাতায়াত, খাবারসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যয় প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বেশি। এই খাতে সরকারের নজর একেবারে নেই বললেই চলে। পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে যে যার মতো ভাড়া নিচ্ছে, এ ক্ষেত্রে কঠোর নজরদারি দরকার। পর্যটন এলাকার হোটেল, মোটেল, বার, স্পা, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, সাগরে ক্যাসিনো, বিনোদনকেন্দ্রসহ বিভিন্ন সুবিধা বাড়াতে সরকারকে ট্যাক্স-ভ্যাট কমাতে হবে। দ্রুত অনলাইন ভিসা চালু এবং আগমনী ভিসার (অন অ্যারাইভাল) পরিধি বাড়াতে হবে।

ট্যুরিজম ডেভেলপার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টিডাব) চেয়ারম্যান সৈয়দ হাবিব আলী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে যে পর্যটন করপোরেশন আইন করে দিয়ে গেছেন, সেখানে পর্যটন খাতে থিম পার্কের কথা বলা আছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত এসব খাতে অগ্রগতি হয়নি। কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, কুয়াকাটা, সুন্দরবনের মতো জনপ্রিয় গন্তব্যগুলোতে সন্ধ্যার পর কোনো বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। পর্যটকদের জন্য বার, স্পার মতো সেবার অনুমোদন পাওয়া কঠিন, যেগুলো গড়ে উঠছে অবৈধ ও দায়সারাভাবে। কিছু তারকা হোটেলে অ্যালকোহলের ব্যবস্থা থাকলেও তা খুবই উচ্চমূল্যের।

ভারতের গোয়া, নেপালের মতো দেশে ভাসমান ক্যাসিনো আছে, যেখানে অনেক পর্যটক আছে। এমনকি মুসলিম দেশ মালয়েশিয়ার গেন্টিং হাইল্যান্ডে ক্যাসিনোসহ বিদেশি পর্যটকদের জন্য নানা সুবিধা আছে। পর্যটকদের পাশাপাশি যারা ব্যবসা করবে, তাদেরও নিরাপত্তা দিতে হবে সরকারকে। বেসরকারি খাতকে পর্যটন ব্যবসার প্রসারে অবকাঠামো ও নীতি সহায়তা দিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পর্যটন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম নেটওয়ার্ক (ডাব্লিউটিএন) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের মহাসচিব সৈয়দ গোলাম কাদীর বলেন, ‘সব দরজা বন্ধ করে দিয়ে পর্যটন হবে না। নেপালের রেস্টুরেন্টগুলোতে ডিনারের সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখে পর্যটকরা। কিন্তু আমাদের দেশে এমন কোনো ব্যবস্থা নেই। কক্সবাজারে একটা গলফ কোর্স, পার্ক, বিনোদনকেন্দ্র, অ্যাডভেঞ্চার ট্যুর নেই। আমরা বারবার বলছি যে বিদেশি পর্যটকদের জন্য ডিউটি-ফ্রি সুবিধায় বৈধভাবে অ্যালকোহল আনার ব্যবস্থা রাখা হোক। কিন্তু আমরা সেখানে ৫০০ শতাংশ ডিউটি বসিয়ে রেখেছি। একটি বিয়ার খেতেই একজন পর্যটকের এক থেকে দেড় হাজার টাকা পড়ে যায়। এটা একজন বিদেশি প্রত্যাশা করে না। আমরা কক্সবাজারকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তর করছি। সেখানে যারা আসবে তারা তো ক্যাসিনো খেলতে চাইবে, অ্যালকোহলসহ নানা সুবিধা চাইবে। এগুলো দেশের মানুষের জন্য নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। উদার না হলেও সতর্কভাবে বিদেশি পর্যটকদের উপযোগী সুবিধা চালু করা উচিত। ’

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বলেন, মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ শেষ পর্যায়ে। বাংলাদেশকে আটটি অঞ্চলে এবং ৫৩টি ক্লাস্টারে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ১৯টি ক্লাস্টারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে টাঙ্গুয়ার হাওর, পদ্মা সেতু, কক্সবাজারের শাহপরীর দ্বীপ, সুন্দরবনের শরণখোলা এবং পাহাড়পুরের সোমপুর বিহারে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু হবে আগামী অর্থবছর থেকেই। সেখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আনতেও বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে।

জানতে চাইলে পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী গতকাল বলেন, ‘সৌদি আরব, মালয়েশিয়াসহ অনেক মুসলিম দেশ বিদেশি পর্যটকদের নানা সুবিধা দিতে অগ্রসর হচ্ছে। আমরা পিছিয়ে আছি। বিদেশি পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। সাবরাংয়ে তাদের জন্য এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন করা হচ্ছে, যেখানে বিনোদনের সব রকম সুবিধা থাকবে। এ ছাড়া সোনাদিয়া ইকো পার্ক হচ্ছে। ’ প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, ‘আমরা পর্যটন মহাপরিকল্পনা করছি, সেটি চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। এটি বাস্তবায়ন করা হলে বিভিন্ন পর্যটন গন্তব্যে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক থেকে শুরু করে বিভিন্ন সুবিধা গড়ে তোলা হবে। ’

জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) দেশের পর্যটন খাতের অবদান ৩.০২ শতাংশ বলে উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ট্যুরিজম স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট-২০২০ প্রতিবেদনে, স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৭৬ হাজার ৬৯০ কোটি টাকার বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশীয় পর্যটকরা পর্যটনের পেছনে আনুমানিক ৭৪ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকার বেশি খরচ করেছে। অনুমান করা হচ্ছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ২৯ লাখ ২১ হাজার বাংলাদেশি বিদেশ সফরে গেছে। বহির্গামী পর্যটনের জন্য খরচ হয়েছে ৩৩ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকার বেশি।

news24bd/ARH

এই রকম আরও টপিক