কোন পথে ব্রিকস?

ব্রিকস লিডারস

কোন পথে ব্রিকস?

মো. ইস্রাফিল আলম

দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে গত ২২ থেকে ২৪ আগস্ট অনুষ্ঠিত হলো ব্রিকসের ১৫তম সম্মেলন। পশ্চিমা আধিপত্য মোকাবিলার অংশ হিসেবে গঠিত ব্রিকসের এবারের সম্মেলন ছিল নানা দিক দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। সম্মেলনটিতে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ পৃথিবীতে বহুমেরুকরণ প্রতিষ্ঠা এবং যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা ব্লককে কতটুকু চ্যালেঞ্জ করবে সেটিই বিবেচ্য বিষয়।  

বিশ্বের চারটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন নিয়ে ২০০৯ সালে গঠিত হয় ব্রিক।

পরের বছর দক্ষিণ আফ্রিকা জোটটিতে যুক্ত হলে এর নামকরণ করা হয় ব্রিকস। উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং পারস্পারিক সহযোগিতা ও সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নিয়েই বৈশ্বিক এই জোটটি গঠিত হয়।

ব্রিকসে যুক্ত হতে যাচ্ছে আরও ছায়টি দেশ। দেশগুলো হলো আর্জেন্টিনা, মিশর, ইরান, ইথিওপিয়া, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।

এবারের সম্মেলন থেকে তাদের ব্রিকসে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। আগামী জানুয়ারিতে দেশগুলো ব্রিকসে যুক্ত হতে যাচ্ছে।  

ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

২০১৯ সালের নভেম্বরে ব্রাজিলে ব্রিকস সম্মেলনের পর করোনার কারণে পরের তিন বছর ভার্চুয়ালি জোটটির তিনটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। চার বছর পর এবার জোহানেসবার্গে ফের মিলিত হলেন জোটের নেতারা। এবারের সম্মেলন এমন একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হলো, যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বিশ্বে নতুন ভূ-রাজনৈতিক খেলা জমে উঠেছে। রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নতুন স্যাংশন আর অবরোধে বিশ্ব মুক্তবাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ডলারের বিপরীতে নতুন মুদ্রায় বৈশ্বিক লেনদেনের প্রয়োজনীয়তা গুরুত্ব পেয়েছে।   

ব্রিকসের অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবারের ব্রিকেস সম্মেলনকে ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, ব্রিকসের সম্প্রসারণ বিশ্ব শান্তি ও উন্নয়নের শক্তিকে বহুগুণে বৃদ্ধি করবে।  

বিশ্বে পশ্চিমা আধিপত্য মোকাবিলায় ব্রিকস সম্প্রসারণের পক্ষে সবচেয়ে শক্ত অবস্থানে ছিল চীন।  
লন্ডনের সোস চায়না ইনস্টিটিউটের পরিচালক স্টিভ সাং জানান, ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর নিজস্ব রাষ্ট্রকাঠামো ও রাজনীতিতে যথেষ্ট ভিন্নতা রয়েছে। এদের কোনোটি গণতান্ত্রিক, আবার কোনোটি অগণতান্ত্রিক। তবে শি মনে করেন তারা রাষ্ট্রকাঠামোতে অভিন্ন হলেও তাদের কেউ-ই পশ্চিমা-শাসিত বিশ্ব চায় না।     

এই চীনা বিশ্লেষক মনে করেন, ব্রিকস ব্লক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চীন একটি বিকল্প বিশ্ব ব্যবস্থার জন্ম দিতে চায়, যেখানে গণতান্ত্রিক বা অগণতান্ত্রিক যেটাই হোক না কেন, প্রত্যেক রাষ্ট্রের শাসকরা নিজের দেশে নিরাপদ বোধ করবে। তারা গণতান্ত্রিক ইউরোপ বা আমেরিকার দেওয়া কোনো ধরনের শর্তে না গিয়ে উন্নয়নের দিকে ধাবমান হবে।  

ব্রিকসে নতুন সদস্য আহ্বানকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি সিরিল রামাফোসা বলেন, আমরা নতুন নতুন দেশকে ব্রিকসে স্বাগত জানাই। নতুন ছয় দেশ যোগ দেওয়ার পর আরও দেশ এতে যুক্ত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।  

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা বলেন, পাশ্চাত্যের ‘নব্য-উদারনীতি’ উন্নয়নশীল দেশগুলোর মূল্যবোধের জন্য হুমকিস্বরূপ এবং বহুমেরু বিশ্বের জন্য বাধা বৃষ্টি করবে। এ ক্ষেত্রে আধিপত্যহীন সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিতে ব্রিকস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশা করেন। তবে পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়ে তিনি খুব সচেতন বলেও জানান।  

ব্রিকসের সম্প্রসারণকে ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেকে আমেরিকার পাল্টা হিসেবে বিবেচনা করলেও এমনি মনে করছেন না হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান। তিনি বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কারও ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এই জোট বিকশিত হচ্ছে না।

ওয়াশিংটনের কুইন্সি ইনস্টিটিউটের গ্লোবাল সাউথ প্রোগ্রামের পরিচালক সারং শিদোর জানান, ছয়টি নতুন সদস্যের মধ্যে কাউকেই তিনি আমেরিকাবিরোধী রাষ্ট্র হিসেবে দেখেন না। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, ব্রিকস দেশগুলো বৈচিত্র্যপূর্ণ। তাদের কেউ যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র; কেই কেউ আনুষ্ঠানিক মিত্র নয়, তবে তাদের মধ্যে দুই-তিনটি মার্কিনবিরোধী হতে পারে। সুতরাং এটাকে পূর্ণাঙ্গভাবে আমেরিকাবিরোধী জোট বলা যাবে না। ’

ব্রিকস সম্মেলন থেকে কী পেল বাংলাদেশ?

গত ১৪ জুন জেনেভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জানিয়েছিলেন, ‘বাংলাদেশ শিগগির ব্রিকসের সদস্যপদ পেতে পারে। ’ এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে দেশে ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় না গেলে কিছু যায়-আসে না। বন্ধুত্ব করার জন্য পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে, মহাদেশ আছে। ’

এই দুই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ধারণা করা হচ্ছিল, এবারের ব্রিকস সম্মেলনে বাংলাদেশকে জোটটির সদস্য করা হতে পারে। এটা নিয়ে বেশ গুঞ্জন ছিল। ধারণা করা হচ্ছিল, বাংলাদেশ হয়তো কোনো সবুজ সংকেত পেয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, ছয়টি দেশকে ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলেও সেখানে নেই বাংলাদেশের নাম। ফলে এটা বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতা কি না সেই প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।  

তবে এখনই এটাকে কূটনৈতিক ব্যর্থতা বলা যায় না। ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য একটি দেশকে যে শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশ এখনো সেই যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। এখনো আমরা এলডিসিভুক্ত দেশের কাতারে আছি। কিন্তু এখানে যে দেশগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সেগুলো উন্নয়নশীল দেশ। তাদের অর্থনীতির আকার ও মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি।  

আঞ্চলিক একটা ভারসাম্যও মাথায় রেখেও এটি করা হতে পারে। যেমন, আমন্ত্রণ জানানো নতুন ছয়টি দেশের মধ্যে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আমেরিকা- সব এলাকার দেশই রয়েছে।  

তবে এই সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগদান ব্রিকসের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি করেছে। যা আগামীতে জোটটির সদস্যভুক্তিতে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।  

ব্রিকস সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দ্য সিলভা, মোজাম্বিকের প্রেসিডেন্ট ফিলিপে জ্যাকিন্টো নিউসি, তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট ড. সাইমা সুল্লুুহু, ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির সঙ্গে পৃথক দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। সেখানে পারস্পরিক স্বার্থে দ্বিপাক্ষিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন প্রধানমন্ত্রী।  

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপর জোর দিয়েছেন। তারাও বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট দিলমা ভানা রুসেফ নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন।  

অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রীর দক্ষিণ আফ্রিকা সফর কিছুটা হলেও ব্রিকসের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে অবদান রাখবে। জোহানেসবার্গ সফর শেষে আগামীকাল রোববার (২৭ আগস্ট) দেশে ফেরার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর।

ডলারের বিপরীতে দুই মুদ্রা চালু 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থা বড় ধাক্কা খায়। এমন অবস্থায় ডলারের বিপরীতে পাল্টা মুদ্রা চালুর বিষয়টি গুরুত্ব পেতে থাকে। বিশেষ করে ব্রিকস দেশগুলো নতুন মুদ্র চালুর বিষয়টি নিয়ে বেশ তৎপর হয়ে ওঠে। ব্রিকস নিয়ন্ত্রিত নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এনডিবি) প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ সম্প্রতি জানিয়েছেন, ডলারের বিকল্প হিসেবে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন বাড়ানোর পরিকল্পনা হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকান ও ব্রাজিলীয় মুদ্রায় ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্রিকস।  

রুসেফ বলেন, স্থানীয় মুদ্রায় ঋণ দেওয়ার ফলে ঋণগ্রহীতারা ঝুঁকিমুক্ত থাকবে। সুদহারের তারতম্যও এড়াতে পারবে। স্থানীয় মুদ্রা শুধু ডলারের বিকল্প নয়, এর বাইরে আরও বিভিন্ন পদ্ধতি স্থাপনের চেষ্টা করা হচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে চিন্তা না করে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ থেকে নিজেদের আলাদা করার চেষ্টা করছে ব্রিকস ব্যাংক। তিনি বলেন, ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যরা যে শর্ত দেয় আমরা সেগুলোকে এড়িয়ে চলি। প্রতিটি দেশের নিজস্ব নীতিকে আমরা সম্মান করি।  

ধারণা করা হচ্ছে, স্থানীয় মুদ্রায় তহবিল সংগ্রহ করতে পারলে এনডিবি মার্কিন অর্থবাজারের ওপর নির্ভরতা কমাতে পারবে। স্থানীয় মুদ্রায় ঋণ দিতে বাণিজ্য ও আর্থিক লেনদেনে ডলারের বিকল্প হিসেবে এটি উৎসাহিত করবে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো মার্কিন আধিপত্যকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিকল্প হিসেবে এটি বেশ কাজে দেবে।  

ব্রিকস সদস্য দেশগুলো ২০১৫ সালে তাদের নিজস্ব অর্থ-শক্তিতে নিজেদের ব্যাংক চালু করে৷ পরে এর নাম পাল্টে করা হয় নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি)।  ব্রিকসের ৫টি রাষ্ট্রের পাশাপাশি ২০২১ সালে এই ব্যাংকের নতুন সদস্য হিসেবে যোগ দেয় বাংলাদেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশর।

news24bd.tv/আইএএম