মোটা চাল যেভাবে হয়ে যায় মিনিকেট

সংগৃহীত ছবি

মোটা চাল যেভাবে হয়ে যায় মিনিকেট

অনলাইন ডেস্ক

দেশের বাজারে এখন মিলছে পাথরবিহীন চকচকে সরু চাল। দিন দিন মিনিকেট নামে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এই চাল। তবে চাল সাধারণত এতটা পরিষ্কার আর সরু থাকে না। চালকে পরিষ্কার ও ঝকঝকে করার দুটি পদ্ধতি রয়েছে যাকে পলিশ বলা হয়।

এ বিষয়ে রাজধানীর বাবুবাজার এলাকায় চালের পাইকারী ব্যবসায়ী ও অটো রাইসমিলের মালিক হাজী আলমগীর হোসেন বলেন, বাজারে প্রচলিত যে ধারণা আছে যে, মোটা চালকে কেটে সরু করা হয় সেটি আসলে ঠিক নয়। চাল কেটে সরু বা লম্বা করা যায় না। তবে চালকে পরিষ্কার ও ঝকঝকে করার পদ্ধতি রয়েছে যাকে পলিশ বলা হয়। এই পদ্ধতিতে চালের উপরের যে আবরণটা তুলে ফেলা হয় যার কারণে চালটা চকচকে ঝকঝকে করা হয়।

তিনি বলেন, বাজারে চকচকে চালের চাহিদা থাকার কারণে রাইসমিলগুলো এটি করে থাকে। গৃহিনীদের কাছে পাথরবিহীন, এই চকচকে চাল বেশ জনপ্রিয়। এসব চালের মধ্যে রয়েছে মিনিকেট, নাজিরশাইল, বাসমতি ইত্যাদি। এসব চাল মূলত, ইরি-২৮,ইরি-২৯, রঞ্জিত, শম্পাকাটারি, পঞ্চাশ ও অন্যান্য জাতের ধান পলিশ করে বানানো হয়।

আলমগীর হোসেন বলেন, দুই উপায়ে চালকে পলিশ করা হয়। একটি হচ্ছে প্রচলিত পদ্ধতি অর্থাৎ ধান পাকার পর সেটিকে মাড়াই, সিদ্ধ ও রোদে শুকানোর পর হাস্কিং মেশিনে ভাঙানো হয়। এতে ধানের খোলস আলাদা হয়ে চালটা বেরিয়ে আসে। এই চালের উপরে লাল আবরণ থাকে। সাথে বিভিন্ন ধরণের কাঁকড়-পাথর ও মরা চাল থাকে। এই চাল দেখতেও ঘোলাটে হয়। এই ঘোলাটে বা লালচে চাল বাজার থেকে কিনে সেটিকে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমে বাছাই ও পলিশ করা হয়।

তিনি বলেন, প্রথমে লালচে চালটা কিনে এনে আমরা মেশিনে দিলে কালো চাল আলাদা হয়ে যায়, লাল আমরিট (চাল) আলাদা হয়ে যায়, ভাঙ্গা (চাল) আলাদা হয়ে যায়। আমরা এর সঙ্গে একটা পলিশার বসাই। এটা উপরের আবরণ ছেটে দেওয়ার জন্য আমরা এটা ফ্রেশ করে নিয়ে আসি।  

'এছাড়া অটোমেশিনে আরও সহজেই চাল প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এতে কাঁচা ধান মেশিনে দিলে সেটি প্রক্রিয়াজাত হয়ে সরু চাল হিসেবে বের হয়ে আসে। এই অটোমেটিক মেশিনের সঙ্গে পাথর আলাদা করার মেশিন এবং চাল পলিশার মেশিন যুক্ত করা থাকে। '

আলমগীর হোসেন বলেন, তবে অনেক সময় মিল মালিকরা চাল চকচকে করার জন্য নানা রকমের রাসায়নিক ব্যবহার করে থাকেন। এরমধ্যে চালকে সাদা করার জন্য ফিটকিরি ব্যবহার করা হয়। পাঁচ কেজি পানির সঙ্গে ফিটকিরি মিশাইয়া হালকা স্যালাইন দিয়ে দিলে চালটা পরিষ্কার আরও বেশি হয়। আবার অনেক রাইস মিল মালিকরা ইউরিয়া সারের পানি মিশিয়েও চাল সাদা করেন। যে চাল বেশিবার ঘষা হয় সেটি বেশি মসৃন হয়ে পিচ্ছিল ভাব আসে। তবে এতে কোন মোম ব্যবহার করা হয় না।

তিনি বলেন, প্রেসার যত বেশি দিবে, চাল তত পরিষ্কার হবে। তবে চাল পলিশ করার সময় কিছুটা ঘাটতি হয়। ৫০ কেজি চাল পলিশ করলে আধা কেজি ওজন কম হয়। চাল পলিশ করানোর পর এর যে উপজাত পণ্য বের হয় সেটিও আলাদা করে বিক্রি করা যায়। এই উপজাত পণ্যের মধ্যে রয়েছে তুষ, চালের গুঁড়া ইত্যাদি। এই উপজাত পণ্যগুলো আবার আলাদা করে বিক্রি করেন মিল মালিকরা।

তিনি জানান, এক বস্তা তুষ বিক্রি হয় ১৮শ থেকে ১৯শ টাকায়। যারা এসব উপজাত পণ্য কেনেন তারা আগে থেকেই মিল মালিকদের কাছে বায়না দিয়ে রাখেন। এই উপজাত পণ্যগুলো থেকে আবার বিভিন্ন ধরণের পণ্য উৎপন্ন হয়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভোজ্যতেল। বাজারে রাইস ব্রান অয়েল হিসেবে যে ভোজ্যতেল পাওয়া যায় সেটি উৎপাদতি হয় চালের এই উপজাত পণ্য থেকেই। এছাড়া গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগীর খাবার হিসেবেও ব্যবহৃত হয় এসব পণ্য।

পুষ্টিবিদরা বলছেন, চালের উপরের আবরণ ফেলে দিয়ে সেটি সরু করা হলে চালটি অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়ে না। তবে এর কিছু পুষ্টিগুণ কমে যায়।

বাংলাদেশ ডায়েট কাউন্সেলিং সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা পুষ্টিবিদ সৈয়দা শারমিন আক্তার বলেন, চাল থেকে আমরা যে ভিটামিন বি পাই সেটি আসলে চালের আবরণ বা বাইরের অংশেই বেশি থাকে। তাই আবরণটি ফেলে দেয়া হলে চালে ভিটামিন বি এর পরিমাণ কমে যায়। চালের ভেতরের অংশে ভিটামিন বি বা থায়ামিনের পরিমাণ থাকলেও সেটি বেশ কম। শুধু ভিটামিন বি নয়, চাল সরু করা হলে চালে যে ফাইবার থাকে সেটির পরিমাণও কমে যায়।

চাল সরু করার সময় চালে যদি রাসায়নিক হিসেবে ফিটকিরি বা ইউরিয়া ব্যবহার করা হয় তাহলে সেটির প্রভাব স্বাস্থ্যের উপর পড়ে কিনা সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

পুষ্টিবিদ সৈয়দা শারমিন আক্তার বলেন, ফিটকিরির কোন প্রভাব স্বাস্থ্যের উপর পড়ে না। কারণ পানি বিশুদ্ধ করতেও আমরা অনেক সময় ফিটকিরি ব্যবহার করে থাকি। এটার আসলে দেহের উপর কোন ক্ষতিকর প্রভাব নেই। তবে চাল সরু করার প্রক্রিয়ায় ইউরিয়া ব্যবহার করা হলে সেটি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

তিনি বলেন, ইউরিয়া হচ্ছে দেহের বর্জ্য পদার্থ। এটা যদি খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে সেটা অবশ্যই ক্ষতির কারণ হবে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা।