জমজম কূপ ও কাবাঘরের পূর্বাপর ঘটনা

প্রতীকী ছবি

জমজম কূপ ও কাবাঘরের পূর্বাপর ঘটনা

মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ

ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, ইবরাহিম (আ.) (আল্লাহর নির্দেশে নির্বাসিত করার লক্ষ্যে) ইসমাঈল এবং তাঁর মাকে নিয়ে বের হলেন। তাঁদের সঙ্গে একটি থলে ছিল, যাতে পানি ছিল। ইসমাঈল (আ.)-এর মা মশক থেকে পানি পান করতেন। ফলে শিশুর জন্য তাঁর স্তনে দুধ বাড়তে থাকে।

অবশেষে ইবরাহিম (আ.) মক্কায় পৌঁছে হাজেরাকে একটি বিরাট গাছের নিচে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। অতঃপর ইবরাহিম (আ.) আপন পরিবারের (সারার) কাছে ফিরে চললেন। তখন ইসমাঈল (আ.)-এর মা কিছু দূর পর্যন্ত তাঁর অনুসরণ করলেন। অবশেষে যখন কাদা নামক স্থানে পৌঁছলেন, তখন তিনি পেছন থেকে ডেকে বলেন, হে ইবরাহিম! আপনি আমাদের কার কাছে রেখে যাচ্ছেন? ইবরাহিম (আ.) বলেন, আল্লাহর কাছে।


হাজেরা (আ.) বলেন, আমি আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।
বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর হাজেরা (আ.) ফিরে এলেন, তিনি মশক থেকে পানি পান করতেন আর শিশুর জন্য দুধ বাড়ত। অবশেষে যখন পানি শেষ হয়ে গেল। তখন ইসমাঈল (আ.)-এর মা বললেন, আমি যদি গিয়ে এদিক-সেদিকে তাকাতাম! তাহলে হয়তো কোনো মানুষ দেখতে পেতাম।

বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর ইসমাঈল (আ.)-এর মা গেলেন এবং সাফা পাহাড়ে উঠলেন আর এদিকে ওদিকে তাকালেন এবং কাউকে দেখেন কি না এ জন্য বিশেষভাবে তাকিয়ে দেখলেন। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। তখন দ্রুতবেগে মারওয়া পাহাড়ে এসে গেলেন এবং এভাবে তিনি কয়েক চক্কর দিলেন। পুনরায় তিনি বললেন, যদি গিয়ে দেখতাম যে, শিশুটি কী করছে। অতঃপত তিনি গেলেন এবং দেখতে পেলেন যে, সে তার অবস্থায়ই আছে।

সে যেন মরণাপন্ন হয়ে গেছে। এতে তাঁর মন স্বস্তি পাচ্ছিল না। তখন তিনি বলেন, যদি সেখানে যেতাম এবং এদিক-সেদিকে তাকিয়ে দেখতাম। সম্ভবত কাউকে দেখতে পেতাম। অতঃপর তিনি গেলেন, সাফা পাহাড়ের ওপর উঠলেন এবং এদিক-সেদিক দেখলেন এবং গভীরভাবে তাকিয়ে দেখলেন। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। এমনকি তিনি সাতটি চক্কর পূর্ণ করলেন।
তখন তিনি বলেন, যদি যেতাম তখন দেখতাম যে সে কী করছে। হঠাৎ তিনি একটি শব্দ শুনতে পেলেন। অতঃপর তিনি মনে মনে বললেন, যদি আপনার কোনো সাহায্য করার থাকে তবে আমাকে সাহায্য করুন। হঠাৎ তিনি জিবরাঈল (আ.)-কে দেখতে পেলেন। বর্ণনাকারী বলেন, তখন তিনি (জিবরাঈল) তাঁর পায়ের গোড়ালি দ্বারা এরূপ করলেন অর্থাৎ গোড়ালি দ্বারা জমিনের ওপর আঘাত করলেন। বর্ণনাকারী বলেন, তখনই পানি বেরিয়ে এলো। এ দেখে ইসমাঈল (আ.)-এর মা অস্থির হয়ে গেলেন এবং গর্ত খুঁড়তে লাগলেন। বর্ণনাকারী বলেন, এ প্রসঙ্গে আবুল কাসিম [রাসুলুল্লাহ (সা.)] বলেছেন, হাজেরা (আ.) যদি একে তার অবস্থার ওপর ছেড়ে দিতেন তাহলে পানি বিস্তৃত হয়ে যেত।

বর্ণনাকারী বলেন, তখন হাজেরা (আ.) পানি পান করতে লাগলেন এবং তাঁর সন্তানের জন্য তাঁর দুধ বাড়তে থাকে। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর জুরহুম গোত্রের একদল উপত্যকার নিচু ভূমি দিয়ে অতিক্রম করছিল। হঠাৎ তারা দেখল কিছু পাখি উড়ছে। তারা যেন তা বিশ্বাসই করতে পারছিল না আর তারা বলতে লাগল এসব পাখি তো পানি ব্যতীত কোথাও থাকতে পারে না। তখন তারা সেখানে তাদের একজন দূত পাঠাল। সে সেখানে গিয়ে দেখল, সেখানে পানি মজুদ আছে। তখন সে তার দলের লোকদের কাছে ফিরে এলো এবং তাদের সংবাদ দিল। অতঃপর তারা হাজেরা (আ.)-এর কাছে এসে বলল, হে ইসমাঈলের মা। আপনি কি আমাদের আপনার নিকট থাকা অথবা (বর্ণনাকারী বলেছেন), আপনার নিকট বসবাস করার অনুমতি দেবেন? [হাজেরা (আ.) তাদের বসবাসের অনুমতি দিলেন এবং এভাবে অনেক দিন কেটে গেল]। অতঃপর তাঁর ছেলে বয়ঃপ্রাপ্ত হলো। তখন তিনি (ইসমাঈল) জুরহুম গোত্রেরই একটি মেয়েকে বিয়ে করলেন।

বর্ণনাকারী বলেন, পুনরায় ইবরাহিম (আ.)-এর মনে জাগল তখন তিনি তাঁর স্ত্রীকে (সারাহ) বলেন, আমি আমার পরিত্যক্ত পরিজনের অবস্থা সম্পর্কে খবর নিতে চাই। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর তিনি এলেন এবং সালাম দিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ইসমাঈল কোথায়? ইসমাঈল (আ.)-এর স্ত্রী বলল, তিনি শিকারে গিয়েছেন। ইবরাহিম (আ.) বললেন, সে যখন আসবে তখন তুমি তাকে আমার এ নির্দেশের কথা বলবে, ‘তুমি তোমার ঘরের চৌকাঠখানা বদলিয়ে ফেলবে। ’ ইসমাঈল (আ.) যখন এলেন, তখন স্ত্রী তাঁকে খবরটি জানালেন, তখন তিনি স্ত্রীকে বলেন, তুমি সেই চৌকাঠ। অতএব তুমি তোমার পিতামাতার কাছে চলে যাও।

বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর ইবরাহিম (আ.)-এর আবার মনে পড়ল। তখন তিনি তাঁর অন্য স্ত্রী (সারাহ)-কে বলেন, আমি আমার নির্বাসিত পরিবারের খবর নিতে চাই। অতঃপর তিনি সেখানে এলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, ইসমাঈল কোথায়? ইসমাঈল (আ.)-এর স্ত্রী বলল, তিনি শিকারে গিয়েছেন। পুত্রবধূ তাঁকে বলেন, আপনি কি আমাদের এখানে অবস্থান করবেন না? কিছু পানাহার করবেন না? তখন ইবরাহিম (আ.) বললেন, তোমাদের খাদ্য ও পানীয় কী? স্ত্রী বলল, আমাদের খাদ্য হলো গোশত আর পানীয় হলো পানি। তখন ইবরাহিম (আ.) দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! তাদের খাদ্য ও পানীয় দ্রব্যের মধ্যে বরকত দিন। ’

বর্ণনাকারী বলেন, আবুল কাসিম রাসুল (সা.) বলেছেন, ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়ার কারণেই বরকত হয়েছে। বর্ণনাকারী বলেন, আবার কিছুদিন পর ইবরাহিম (আ.)-এর মনে তাঁর নির্বাসিত পরিজনের কথা জাগল। তখন তিনি তাঁর স্ত্রী (সারাহ)-কে বললেন, আমি আমার পরিত্যক্ত পরিজনের খবর নিতে চাই। অতঃপর তিনি এলেন এবং ইসমাঈলের দেখা পেলেন, তিনি জমজম কূপের পেছনে বসে তাঁর একটি তীর মেরামত করছেন। তখন ইবরাহিম (আ.) ডেকে বলেন, হে ইসমাঈল! তোমার রব তাঁর জন্য একখানা ঘর নির্মাণ করতে আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। ইসমাঈল (আ.) বলেন, আপনার রবের নির্দেশ পালন করুন। ইবরাহিম (আ.) বলেন, তিনি আমাকে এ-ও নির্দেশ দিয়েছেন যে তুমি যেন আমাকে এ বিষয়ে সহায়তা করো। ইসমাঈল (আ.) বলেন, তাহলে আমি তা করব অথবা তিনি অনুরূপ কিছু বলেছিলেন। অতঃপর উভয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ইবরাহিম (আ.) ইমারত (ঘর) বানাতে লাগলেন আর ইসমাঈল (আ.) তাঁকে পাথর এনে দিতে লাগলেন আর তাঁরা উভয়ে এ দোয়া করছিলেন, হে আমাদের রব! আপনি আমাদের এ কাজ কবুল করুন। আপনি তো সব কিছু শোনেন ও জানেন।

বর্ণনাকারী বলেন, এর মধ্যে প্রাচীর উঁচু হয়ে গেল আর বৃদ্ধ ইবরাহিম (আ.) এতটা উঠতে দুর্বল হয়ে পড়লেন। তখন তিনি (মাকামে ইবরাহিম) পাথরের ওপর দাঁড়ালেন। ইসমাঈল তাঁকে পাথর এগিয়ে দিতে লাগলেন আর উভয়ে এ দোয়া পড়তে লাগলেন, হে আমাদের রব! আপনি আমাদের এ কাজটুকু কবুল করুন। নিঃসন্দেহে আপনি সব কিছু শোনেন ও জানেন। (সুরা : আল-বাকারা, আয়াত : ১২৭; বুখারি, হাদিস : ৩৩৬৫)

শিক্ষা

আল্লাহর নির্দেশকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তাঁর সন্তুষ্টির জন্য প্রয়োজনে স্ত্রী-পুত্রসহ সব কিছু ত্যাগ করতে হবে। সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট থাকতে হবে এবং তাঁর ওপর ভরসা করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই ধৈর্যহারা হওয়া চলবে না। পরিবার ও সন্তান-সন্ততির জন্য দোয়া করতে হবে। একক নয়; বরং যৌথ উদ্যোগে সামাজিক কাজ সম্পাদন করতে হবে। হাজেরার মতো সুদৃঢ় ঈমানের অধিকারিণী হওয়ার জন্য মা-বোনদের সচেষ্ট হতে হবে। আল্লাহর আনুগত্য ও ধৈর্যের পরিণাম সর্বদা কল্যাণকরই হয়।

এই রকম আরও টপিক