ভারত কেন শেখ হাসিনার পাশে?

অমল সরকার

ভারত কেন শেখ হাসিনার পাশে?

অমল সরকার

ভারতে রাজনৈতিক বিবাদের শেষ নেই। রাজনৈতিক দলগুলি একশোটির মধ্যে ৯৯টি ক্ষেত্রে সহমত হতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশের বিপদে-আপদে বিশেষ করে শেখ হাসিনা সরকারের পাশে থাকার প্রশ্নে ভারতের ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে কোনও দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। তার পিছনে কাজ করে একটি অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতাবোধ।

 
ভারতের জন্য শেখ হাসিনার সরকারের কেন বিকল্প নেই। ঘুরিয়ে কথাটির অর্থ দাঁড়ায়, বাংলাদেশের মানুষ চতুর্থবারের জন্য মুজিব কন্যাকে ক্ষমতায় রেখে দিলে আমরা প্রতিবেশীরা উপকৃত হব।

তার মানে কি বাংলাদেশের মানুষ ভারতের স্বার্থের কথা বিবেচনায় রেখে সরকার নির্বাচন করবে? মোটেই এমন অন্যায় দাবি করা চলে না। কিন্তু ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের সম্পর্কের রসায়নটি সে দেশের নাগরিকদের বিবেচনায় রাখা দরকার।

একথা ঠিক নরেন্দ্র মোদীর ভারতের এখন বাংলাদেশ বাদে বাকি নিকট প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে।  

নেপাল-পাকিস্তান বহুদিন হল চিনের খপ্পরে পড়েছে। মালদ্বীপে হালে চিনপন্থী সরকার ক্ষমতায় এসেই নয়াদিল্লিকে চোখ রাঙাতে শুরু করেছে। ভুটানের সঙ্গেও জি শিংপিনের দেশের সখ্য বাড়ছে। এই ক্ষেত্রে ভারতের কূটনৈতিক ব্যর্থতা অবশ্যই আছে। একই সঙ্গে সত্যি বাংলাদেশে বাদে বাকিগুলিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্ধ ভারত বিরোধিতা অন্যতম কারণ।

জিয়াউর রহমানের সময় থেকেই বিএনপি নিজেদের ভারত বিরোধী শক্তি হিসাবে তুলে ধরেছে। একদা শাসক দল এবং প্রথমসারির পার্টির থেকে যে কূটনৈতিক অবস্থান অপ্রত্যাশিত। তারপরও ভারত বাংলাদেশের বিরোধী দলের জন্য দরজা বন্ধ করে দেয়নি। সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দিল্লি ঘুরে গিয়েছেন। কিন্তু একথা ভুলে গেলে চলবে না, কথা দিয়েও ঢাকা সফরে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেননি বেগম জিয়া। তারপরও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বিএনপি সুপ্রিমোর সঙ্গে দেখা করেন।

তবে এটাই ভারতের শেখ হাসিনার পাশে থাকার একমাত্র কারণ নয়। ভারতের আজকের নরেন্দ্র মোদী সরকার বলে নয়, বিগত আড়াই-তিন দশকে সব সরকারের সময়ে সম্পর্কের ধারাবাহিক অগ্রগতি পর্যালোচনা করলে লাভ-লোকসানের বিষয়টি স্পষ্ট হবে। নরেন্দ্র মোদী হামেশাই দাবি করে থাকেন, তাঁর সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় উঠেছে। আমি বলব, এই অনন্য সম্পর্কের ভিত গড়ে ছিলেন মনমোহন সিং তাঁর ‘লুক-ইস্ট’ পলিসির মাধ্যমে। মোদী সরকার সেই একই নীতির নাম দিয়েছে ‘অ্যাক্ট ইস্ট’।

বাংলাদেশের বিগত সাধারণ নির্বাচনের পর ভারতের একটি জনপ্রিয় ইংরেজি সংবাদ বাতায়নে দেশের হিন্দু জাতিয়তাবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এর প্রাক্তন সম্পাদক সেশাদ্রি চারি লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভারতের জন্য ভাল। ’ বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত গুরুত্বের প্রেক্ষিতে বাণিজ্যিক, নিরাপত্তা ও কৌশলগত উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেছিলেন তিনি। তাঁর কথায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ উদ্যোগ সফল করে তোলার জন্যও বাংলাদেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এই নীতির মূল কথা হল বাংলাদেশ-সহ পূর্ব ও উত্তর-পূর্বের দেশেগুলির সঙ্গেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলা।

বাংলাদেশে হাসিনার পনেরো বছর এবং ভারতে মনমোহন-মোদী সরকারের বিশ বছরের রাজত্বের তাৎপর্যপূর্ণ মিলটি হল, বৃহৎ পরিকাঠামো অর্থাৎ শিল্পতালুক, এক্সপ্রেসওয়ে, সেতু, উড়ালপুল, বন্দর, গভীর সমুদ্র বন্দর, বিমানবন্দর, আন্ডারপাস, রেল, মেট্রোরেলের প্রসার। নরেন্দ্র মোদী ভোটমুখী রাজ্যগুলিতে নিয়ম করে এই ধরনের প্রকল্পের উদ্বোধন করছেন যার অনেকগুলিই তাঁর পূর্বসূরির সময়ে শুরু অথবা পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পরিকাঠামোর উন্নয়নে ভারতে বড় ধরনের রাজনৈতিক বিবাদ নেই।
 
একই সময়ে বাংলাদেশে পরিকাঠামোর রূপবদলও চমৎকৃত হওয়ার মতো। পদ্মাসেতু দু’বার চাক্ষুষ করার সুযোগ হয়েছে আমার। সেটা শুধু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চমক নয়, প্রকল্পটির বাস্তবায়ন প্রশাসকের সাহসেরও নজির। কারণ সেতুটি নিয়ে বিবাদ, বিতর্ক, বাধা, ষড়যন্ত্র অজানা নয়। তাতে একটা বিষয় স্পষ্ট বাংলাদেশের প্রশাসনে কাঁকড়া সংস্কৃতি যে রূপ ধারণ করেছে ভারতে তুলনায় তা বেশ কম। পিছন থেকে টেনে ধরার সেই সংস্কৃতিকে পাশ কাটিয়ে পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্পের শেষ পর্যন্ত মাথা তুলে দাঁড়াতে পারাটা অনেক বড় অসাধ্য সাধন।

সাম্প্রতিক অতীতে ঢাকায় মেট্রো রেল, এক্সপ্রেসওয়ে, উড়াল এক্সপ্রেসওয়ে, চট্টগ্রামে কর্ণফুলি নদীর তলদেশে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম আন্ডারপাস চালু, গভীর সমুদ্র বন্দরের শিলান্যাস দেশটির অর্থনৈতিক ভিত আরও মজবুত করবে সন্দেহ নেই।  

সম্প্রতি দুই প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে ৭০ বছর বন্ধ থাকা আখাউড়া-আগরতলা রেলপথটি চালু করেছেন। এই প্রকল্পটি ছিল মমমোহন সরকারের ভাবনা, যা মোদীর হাত দিয়ে বাস্তবায়িত হল। পরিকাঠামোর অগ্রগতিতে এই যৌথভাবনা তিন দশক আগে শুরু হলে দুই দেশেরই চেহারা বদলে যেত।
কলকাতা থেকে এখন ট্রেনে অসম হয়ে আগরতলা যেতে ৩৮ ঘণ্টা লাগে। আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগের ফলে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে মাত্র ১২ ঘণ্টায় আগরতলা পৌঁছানো সম্ভব। আশা করা যায় অল্পদিনের মধ্যেই দু-দেশের মানুষ এই সুবিধা পাবেন। কলকাতায় আসতে একই সুবিধা কি বাংলাদেশের পূর্বাংশের মানুষ পাবেন না?

দুর্ভাগ্যের হল, দুই দেশের মানুষের উপকৃত হওয়ার কথাটি বাংলাদেশের বহু মানুষ পাশ কাটিয়ে যান। বিশেষ করে বিরোধী দলগুলি। তারা বলে,  হাসিনা প্রকল্প গড়ছেন ভারতের স্বার্থে। বর্তমান সরকার চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ভারতকে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। এরফলে ভারতের পণ্য অনেক সহজে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে কম খরচ ও সময়ে পৌঁছে দেওয়া যাবে। আশপাশের দেশগুলিতেও সহজে ভারতীয় পণ্য পৌঁছে যাবে। বাংলাদেশে আমি বহু মানুষকে শুধু এটুকু বলেই অনুযোগ করতে শুনেছি। তারা একবারের জন্যও বলেন না কলকাতা-সহ ভারতের একাধিক বন্দর বাংলাদেশও ব্যবহারের সুযোগ পাবে।

প্রশাসনিক পরিভাষায় একে বলে ট্রানজিট। কিন্তু সুস্থ থাকার সময় খালেদা জিয়া লাগাতার প্রচার করেছেন শেখ হাসিনা ভারতকে বাংলাদেশের ভিতর ‘করিডর’ দিচ্ছেন। অর্থাৎ সেগুলি শুধুমাত্র ভারত ব্যবহার করতে পারবে। বাস্তবে, সেটা ট্রানজিট এবং এর মাধ্যমে পণ্যমাশুল এবং অন্যান্য কর বাবদ বাংলাদেশ বিপুল অর্থ উপার্জন করছে। নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশ যে এখনও চিনের ঋণের জালে জড়িয়ে যায়নি তার জন্যও ভারতের কৃতিত্ব প্রাপ্য। তিস্তার জল নিয়ে সে দেশে বহু মানুষের ঘুম ছুটে গিয়েছে। তাঁরা একবারের জন্যও স্বীকার করেন না, জ্যোতি বসুর মধ্যস্থতায় হাসিনা ও দেবগৌড়ার সময় স্বাক্ষরিত গঙ্গা জল চুক্তি তিন বছর পর তিন দশর পেরবে।

শেখ হাসিনার সময়ে বাংলাদেশে জঙ্গি দমন অভিযানের মাধ্যমেও ভারত উপকৃত হয়েছে। সেশাদ্রি চারির কথার প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছে ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ মুখ্যমন্ত্রীর মুখে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারত বিরোধী শক্তিকে দমনে শেখ হাসিনার সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন উত্তর-পূর্ব ভারতের বৃহত্তম রাজ্য তথা দেশের ওই প্রান্তে শাসক দল বিজেপির প্রধান মুখ এবং নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহদের কাছের মানুষ অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। শেখ হাসিনার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর একান্ত বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রক কর্তৃক প্রচারিত প্রেস নোটে বলা হয়, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী সে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্যমান শান্তিপূর্ণ অবস্থা নিশ্চিতকরণে অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। ’

লেখক: ভারতীয় সাংবাদিক। এইসময় ও দ্য ওয়ালের নিয়মিত লেখক।  
news24bd.tv/ডিডি